গাজায় ফিলিস্তিনিরা যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ২৪ ঘণ্টা পার করেছে। মঙ্গলবার থেকে বুধবার পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৬ জন শিশু।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলাগুলো গাজার বিভিন্ন স্থানে চালানো হয়েছে। এই হামলা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোর একাধিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা। ফলে পরিস্থিতি আবারও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ অবস্থা কী
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, বুধবার দুপুর নাগাদ তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশে যুদ্ধবিরতিতে ফিরে গেছে। তবে প্রয়োজনে আবারও হামলার প্রস্তুতি রেখেছে।
তারা দাবি করেছে, ৩০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে। এসব লক্ষ্যবস্তু নাকি ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে থাকা যোদ্ধাদের ঘাঁটি’ ছিল।
কিন্তু বাস্তবে এসব হামলায় বহু আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে। গাজার মধ্যাঞ্চলে একই পরিবারের অন্তত ১৮ সদস্য নিহত হয়েছেন—যাদের মধ্যে শিশু সন্তান, বাবা-মা ও দাদা-দাদি সবাই ছিলেন।
নাগরিক প্রতিরক্ষা কর্মীরা আবারও ধ্বংসস্তূপে হাত দিয়ে বা ছোট সরঞ্জাম ব্যবহার করে জীবিত ও মৃতদের খোঁজ চালিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি পরিবারের কয়েকটি তাঁবুতেও হামলা হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত অন্তত ৬৮ হাজার ৬৪৩ জন নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৫ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের ব্যাখ্যা কী
মঙ্গলবার ইসরায়েল জানায়, হামাসের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (আইসিআরসি) কাছে হস্তান্তরিত এক বন্দির মৃতদেহের পরিচয় নিয়ে অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। লাশটি যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে এখনো যে ১৩ জনের মৃতদেহ ফেরতে দিতে হবে তাদের কারো ছিল না।
ইসরায়েলি ফরেনসিক বিশ্লেষকরা নিশ্চিত করেন, দেহাবশেষটি ওফির জারফাতি নামে যে ইসরায়েলির কথা বলা হচ্ছে তার নয়। তাকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার সময় গাজায় নেওয়া হয়েছিল। তার আংশিক দেহাবশেষ সেই বছরের নভেম্বরে উদ্ধার করা হয়েছিল। ফলে দেখা যায়, হামাসের দেওয়া লাশটি অন্য কারো।
এ ঘটনায় ইসরায়েলি সরকার ক্ষোভ প্রকাশ করে। বিশেষ করে জোট সরকারের অতিদক্ষিণপন্থী মন্ত্রীরা হামাসবিরোধী অবস্থান আরও জোরালো করেন এবং গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহারের দাবি জানান। বন্দিদের পরিবারের সংগঠনগুলোও ক্ষোভ প্রকাশ করে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান জানায়।
এর কিছুক্ষণ পর হামাসের সামরিক শাখা কাস্সাম ব্রিগেড ঘোষণা করে, তারা রাত ৮টার দিকে এক ইসরায়েলি বন্দির দেহাবশেষ ফেরত দেবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ‘শক্তিশালী প্রতিশোধমূলক হামলার’ নির্দেশ দিলে সেই পরিকল্পনা স্থগিত হয়।
২৮শে অক্টোবর দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসে একজন ইসরায়েলি বন্দীর দেহাবশেষের সন্ধানে হামাসের ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। ছবি: রয়টার্স।দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহ শহরে তীব্র গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইসরায়েল দাবি করে, এটি হামাস যোদ্ধাদের আক্রমণ ছিল, যদিও হামাস তা অস্বীকার করে।
ইসরায়েল আরও অভিযোগ তোলে যে, হামাস বন্দির মৃতদেহ ‘নাটকীয়ভাবে ফেরত দেওয়ার’ চেষ্টা করেছে। তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায় হামাস যোদ্ধারা একটি দেহ কবর দিচ্ছে এবং পরে রেড ক্রসকে ডেকেছে।
রেড ক্রস (আইসিআরসি) এক বিবৃতিতে জানায়, তাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগে সেখানে একটি মৃতদেহ রাখা হয়েছে—এ ব্যাপারে তারা অবগত ছিলেন না।
এই ঘটনাগুলো ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতিতে অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাস আরও গভীর করেছে। গাজায় প্রতিদিনই মানবিক বিপর্যয় বাড়ছে, আর যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধবিরতিতে কী আছে?
চুক্তি অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে হামাস গাজায় থাকা অবশিষ্ট ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে কয়েক দিনের মধ্যেই হস্তান্তর করেছে।
এছাড়া হামাস ১৫ জন মৃত ইসরায়েলি বন্দির দেহাবশেষও হস্তান্তর করেছে। তবে আরও ১৩ জনের দেহাবশেষ এখনো উদ্ধার বা হস্তান্তর হয়নি।
ইসরায়েল কিছু মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশ করতে দিয়েছে, কিন্তু সরবরাহ প্রতিদিনের নির্ধারিত ৬০০ ট্রাকের অনেক নিচে রয়েছে—যা দুর্ভিক্ষের মুখে থাকা জনগণের জন্য প্রয়োজনীয়।
ইসরায়েল তাবু ও মোবাইল ঘর প্রবেশে বাধা দিলেও তাদের বন্দিদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করতে কিছু ভারী যন্ত্রপাতি প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে।
সব দেহাবশেষ হস্তান্তর সম্পন্ন হলে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরু হতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন ও গাজা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা।
তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার জানিয়েছেন, তারা কোনো স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের অনুমতি দেবেন না এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনা উপেক্ষা করে পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছেন।
হামাসের বক্তব্য
হামাস অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল গাজায় পুনরায় হামলার অজুহাত তৈরির জন্য ‘মিথ্যা কারণ’ দেখাচ্ছে।
গত দিনের হামলার আগেই দলটি জানায়, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল অন্তত ১২৫ বার তা লঙ্ঘন করেছে।
১০ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২১১ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫৯৭ জন আহত হয়েছে, পাশাপাশি ৪৮২টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
হামাস আরও বলেছে, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দিদের দেহাবশেষ উদ্ধার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে এবং সেটিকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে।
যুদ্ধবিরতির পর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিহতের পরিসংখ্যান। ছবি: আল-জাজিরা।তাদের দাবি, ইসরায়েল পর্যাপ্ত ভারী যন্ত্রপাতি প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এবং অনুসন্ধান দলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় প্রবেশও রোধ করছে।
কাস্সাম ব্রিগেড জানিয়েছে, তাদের যোদ্ধারা মঙ্গলবার অনুসন্ধান অভিযানে দুজন মৃত বন্দির দেহাবশেষ—আমিরাম কুপার ও সাহার বারুচ—উদ্ধার করেছে।
হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি দল জানিয়েছে, তারা গাজার প্রশাসন একটি টেনোক্রেটিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত। তবে তারা জোর দিয়ে বলেছে, সশস্ত্র প্রতিরোধ ইসরায়েলের দীর্ঘ দখল ও বর্ণবাদী বৈষম্যের প্রতিক্রিয়া।
গাজার সাধারণ মানুষের অবস্থা
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা ইসরায়েলি হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের জীবিকা ও অবকাঠামো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজার কোথাও এখন পুরোপুরি নিরাপদ নয়। ফলে জনগণ আবারও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে যে, হামলা আরও বাড়তে পারে। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও নজরদারি ড্রোন সারাক্ষণ গাজা আকাশে ঘোরাফেরা করছে।
এখন কী হবে
যুক্তরাষ্ট্র বারবার ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, এমনকি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পরও ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ তুলে ধরে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি এখনও বিপদের মুখে নয়।’
মধ্যস্থতাকারী কাতার আগেও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চুক্তি দুর্বল করার অভিযোগ করেছে। তবু কাতার ও মিসর একযোগে কাজ করছে যাতে যুদ্ধবিরতি টিকে থাকে।
সূত্র: আল-জাজিরা