leadT1ad

ফরেন অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষণ/পাকিস্তানের নীরব সেনা অভ্যুত্থান: সামরিক শাসনের এক নতুন মডেল

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

২৭ তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে কার্যত একটি নীরব সেনা অভ্যুত্থান ঘটে যায়।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার যুদ্ধ শেষ করার জন্য ২০ দফার একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এসময় তাঁর পাশে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। পরিকল্পনার মাঝপথে তিনি থেমে আরও দুজন নেতার নাম উল্লেখ করেন। তাঁরা হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ট্রাম্প বলেন, এই দুই নেতা তাঁর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন।

এই উল্লেখ খুব সংক্ষিপ্ত হলেও তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এতে ট্রাম্পের পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশটির রাজনৈতিক বাস্তবতাও প্রতিফলিত হয়েছে। ট্রাম্প পাকিস্তানের বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সবচেয়ে শক্তিশালী জেনারেলকেও এক কাতারে রেখেছেন। এতে স্পষ্ট হয় যে, শেহবাজ শরিফ নামমাত্রভাবে দেশ পরিচালনা করলেও প্রকৃত ক্ষমতা আসিম মুনিরের হাতে।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পাকিস্তান বেসামরিক ও সামরিক শাসনের মধ্যে বারবার দোদুল্যমান থেকেছে। সর্বশেষ অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৯৯ সালে, যখন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেন। ২০০৮ সালে দেশটি আবার বেসামরিক শাসনে ফেরে। এরপর থেকে ধারাবাহিক বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা কিছুটা স্বাধীনভাবে শাসন করতে পেরেছিল এবং অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি মুক্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। কোনো প্রকাশ্য অভ্যুত্থান ছাড়াই এখন জেনারেলরাই ক্ষমতায়।

এই ব্যবস্থাকে অনেকেই ‘মুনির মডেল’ বলে অভিহিত করছেন। এটি এক ধরনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরেই স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৮ সালে সরাসরি সামরিক শাসন শেষ হওয়ার পর এটি পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন। এ ব্যবস্থায় সেনাবাহিনী আর আড়ালে থেকে সুতা টানে না। তারা বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকাশ্যেই দেশ পরিচালনা করছে। নীতি প্রণয়ন, কূটনীতি পরিচালনা এবং অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তারা নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা খাতে আগের মতোই প্রধান ভূমিকা ধরে রেখেছে।

এই ক্ষমতাকাঠামো এখন আইনি রূপও পেয়েছে। নভেম্বর মাসে পার্লামেন্ট একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করে। এতে আসিম মুনিরকে সেনাবাহিনীর সব শাখার সর্বোচ্চ প্রধান করা হয়। তাঁকে আজীবনের জন্য আইনি সুরক্ষা এবং নতুন করে পুনর্নবায়ণযোগ্য পাঁচ বছরের মেয়াদ দেওয়া হয়। ফলে চাইলে তিনি আরও মোট ১০ বছর এই পদে থাকতে পারবেন। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ এ বিষয়ে সোজাসাপ্টা মন্তব্য করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এখনকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা একটি হাইব্রিড কাঠামো, যেখানে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক সরকার ‘ক্ষমতার সহ-মালিক।’ তিনি নির্দ্বিধায় আরও বলেন, ‘এই হাইব্রিড ব্যবস্থা দারুণ কাজ করছে।’

সেনাপ্রধানের সমর্থকরা অবশ্য গত এক বছরের সাফল্য তুলে ধরে এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন। মুনিরের নেতৃত্বে পাকিস্তান নতুন করে আইএমএফের ঋণ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং চীনের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে নতুন বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতিও এসেছে। সামরিক নেতৃত্বাধীন স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিল এখন সরকারের প্রধান প্ল্যাটফর্ম। এই পর্ষদ দ্রুত বিনিয়োগ অনুমোদন দিতে কাজ করছে, বিশেষ করে জ্বালানি, কৃষি ও খনিশিল্পে।

রাষ্ট্রকে গিলে খাওয়া

২০২২ সালের এপ্রিলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনাস্থা ভোটে সংসদ থেকে অপসারিত হন। তখন অনেকে মনে করেছিলেন, তাঁর পতনের পেছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল। পরবর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন শেহবাজ শরিফ, সম্পূর্ণভাবে সামরিক সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। বেসামরিক সরকারের ক্ষমতা আসলে জেনারেলদের অনুমোদনের মাধ্যমে টিকে ছিলেন। সেনাবাহিনী সবচেয়ে কঠিন সমস্যাগুলো সামলায়। যেমন, ধ্বংসের পথে থাকা অর্থনীতি স্থিতিশীল করা, রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা করা। অন্যদিকে বেসামরিক রাজনীতিবিদরা সংসদীয় ব্যবস্থার বাহ্যিক রূপটুকু বজায় রাখতেন।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর এই বাস্তবতা আরও স্পষ্ট হয়। ইমরান খানের দল নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞার কারণে দলীয় প্রতীক নিয়ে প্রার্থী দিতে পারেনি। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে এবং সর্বাধিক আসন পায়। তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে শেহবাজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ একটি নাজুক জোট গঠন করে সরকারে ফিরে আসে। এই জোটে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং কয়েকটি ছোট দলও ছিল।

জাতীয় সংসদের গণিত অনুযায়ী সরকার বৈধতা পেলেও তাদের বাস্তব ক্ষমতা ছিল সামরিক পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভরশীল। সেনাবাহিনী রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে, বিচারিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্কেও মধ্যস্থতা করে। এই প্রভাবের মাধ্যমে তারা ঠিক করে কোন বেসামরিক জোট ক্ষমতায় আসতে পারে এবং তারা কতদূর পর্যন্ত শাসন করতে পারবে।

বেসামরিক নেতারা এই পথে হাঁটেন কারণ, শরিফ সরকারের এক মন্ত্রী ২০২৩ সালে বলেন, ‘আমরা জানি, সেনাবাহিনী ছাড়া ইমরান খানকে সরানো সম্ভব নয়।’ ২০২৩ সালের আগস্টে ইমরান খান গ্রেপ্তার হন। রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির তথ্য গোপন করার অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত বরা হয়। তিনি তখন থেকেই কারাগারে আছেন। কারাগারে থাকলেও তিনি এখনো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক।

দুই বছর পরও ইমরান খান কারাগারে আছেন। তিনি জনসমক্ষে প্রায় অদৃশ্য। তাঁর বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রক্রিয়াকে অনেক পাকিস্তানি অন্যায্য মনে করেন। ২০২২ সালে তাঁকে সরানো এবং রাজনৈতিক সংকট স্থিতিশীল করার যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল, তা এখন অনেক দূরে সরে গেছে। কিন্তু সেই দুর্বলতার মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে যে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তা আর বেসামরিক নেতৃত্ব ফিরে পায়নি। বরং সেই ক্ষমতা আরও বেড়েছে। যা এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকেই গ্রাস করেছে।

ফিল্ড মার্শালের সেই গ্রীষ্ম

২০২৫ সালের মে মাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আসে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। এর জেরে দুই দেশের মধ্যে স্বল্প সময়ের হলেও তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েক দিনের লড়াইয়ের পর দুই পক্ষই যুদ্ধ থামাতে সম্মত হয় এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। পাকিস্তান এটিকে বিজয় বলে দাবি করে। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও তা-ই মনে করে। একইভাবে ভারতও নিজস্ব বিজয়ের ধারণা তৈরি করে।

তবে যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে দ্বন্দ্বের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল যুদ্ধবিরতির পেছনের কূটনীতি। পরে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে কাজ করে যুদ্ধ থামিয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা কার্যত আলোচনার বাইরে ছিলো। বহুদিনের গোপন সত্যটি এবার প্রকাশ্য সত্য হয়ে উঠে—যুদ্ধ ও শান্তির চূড়ান্ত ক্ষমতা পাকিস্তানের জেনারেলদের হাতেই। এর পরের কয়েক মাসে রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তা দেখা যায়।

জুন মাসে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে মুনিরকে স্বাগত জানান। সেখানে কোনো বেসামরিক নেতা উপস্থিত ছিলেন না। ইতিহাসে এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত সরকার থাকা অবস্থায় শুধু পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানান। সেনাবাহিনীর বিবরণ অনুযায়ী, বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিরাপত্তা বিষয়ক সীমায় আটকে থাকেনি। সেখানে বাণিজ্য, জ্বালানি, প্রযুক্তি, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং বিরল খনিজ নিয়েও আলোচনা হয়। যেসব বিষয় আগে বেসামরিক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল, সেগুলো এখন সরাসরি সেনাপ্রধানের টেবিলে পৌঁছেছে।

গ্রীষ্মের শেষে মুনির নতুন অর্থনৈতিক কূটনীতির নেতৃত্ব নিতে শুরু করেন। জুলাই মাসে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেন। এতে পাকিস্তানের ওপর এই অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম কম শুল্কহার—১৯ শতাংশ আরোপের সিদ্ধান্ত হয়। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সি, খনিশিল্প এবং জ্বালানি প্রকল্প নিয়েও আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়।

এই সব আলোচনা এখন চলছে স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিলের মাধ্যমে। এটি ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি বেসামরিক-সামরিক যৌথ সংস্থা। এর উদ্দেশ্য বিদেশি বিনিয়োগ এবং কৌশলগত শিল্পখাতের তদারকি কেন্দ্রীভূত করা। কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী হলেও সেনাপ্রধান এর সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অ্যাপেক্স কমিটির সদস্য। আরও একজন কর্মরত জেনারেল এর জাতীয় সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন।

এই নতুন কাঠামোর মাধ্যমেই একের পর এক বড় চুক্তি বাস্তবায়িত হতে শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন, যা একটি সামরিক মালিকানাধীন কোম্পানি, যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি-ভিত্তিক ইউ এস স্ট্র্যাটেজিক মেটালস কোম্পানির সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বিরল খনিজ রপ্তানি চুক্তি সই করে। ইসলামাবাদে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, মুনির নিজেই এই চুক্তির তদারকি করেছেন।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে আসিম মুনির ও শেহবাজ শরীফের সাক্ষাত।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে আসিম মুনির ও শেহবাজ শরীফের সাক্ষাত।

পরবর্তী ঘটনা আরও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ২৬ সেপ্টেম্বর মুনির আবারও ওয়াশিংটনে যান। এবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শরিফ। যৌথ হোয়াইট হাউস বৈঠক হয়। কয়েক মাসের ব্যবধানে এটি ট্রাম্পের সঙ্গে মুনিরের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ছড়ায় যে ছবিটি, তাতে দেখা যায় মুনির যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে পাকিস্তানের বিরল খনিজ এবং মূল্যবান পাথরসমূহের একটি ট্রে উপহার দিচ্ছেন। এটি শুধু উপস্থাপনার একটি উপকরণ ছিল না; এটি ছিল নতুন ধরনের কূটনীতির ঘোষণা। পাকিস্তানের নতুন কূটনীতিতে সেনাবাহিনীই এখন গ্যারান্টর, মধ্যস্থতাকারী এবং চুক্তি সম্পাদন করে।

অতীতের সঙ্গে এর পার্থক্য স্পষ্ট। ২০১৯ সালে ইমরান খান হোয়াইট হাউসে গেলে তৎকালীন সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া ইউনিফর্ম পরে সঙ্গে ছিলেন বটে, কিন্তু পেছনে অবস্থান করেছিলেন। তাকে খুব কমই আনুষ্ঠানিক ছবিতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৫ সালে মুনির আর পেছনে থাকেননি। তিনি পুরো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তিনি ছিলেন নীতিনির্ধারণের সহ-স্থপতি। এমনটাই স্বাভাবিক, কারণ পাকিস্তানের নতুন ব্যবস্থায় আর ক্ষমতার অবস্থান নিয়ে কোনও ভান নেই।

ওভাল অফিসের বৈঠকের তিন দিন পর ট্রাম্প তাঁর গাজা পরিকল্পনা তুলে ধরার সময় শাহবাজ শরিফ ও আসিম মুনির—দুজনের নামই উল্লেখ করেন। এতে ইসলামাবাদ সন্তুষ্ট হয়। এই উল্লেখ সরকারের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বদলের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করে। যুক্তরাষ্ট্র যখন দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে, তখন পাকিস্তান নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে তুলে ধরতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কে পরিবর্তনের মুহূর্তেও, পাকিস্তান উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক এবং একমাত্র পারমাণবিক-সক্ষম মুসলিম-অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে তার বিশেষ অবস্থানকে কাজে লাগাতে পারে। এতে ওয়াশিংটন আঞ্চলিক সংকট সামলাতে, উপসাগরে কূটনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে এবং যেসব পক্ষকে সরাসরি প্রভাবিত করা কঠিন—তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে সুবিধা পায়। ফলে বহু বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এখন পাকিস্তানকে বেশি কার্যকর অংশীদার হিসেবে দেখছে। এ পরিবর্তন পাকিস্তানি কূটনীতিতে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার শীর্ষে উঠার কৌশলকে আরও বৈধতা দেয়।

এই পরিবর্তন অতীত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়; বরং পুরোনো ধারা নতুন আকারে ফিরেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা অতীতে দ্রুত সিদ্ধান্তের প্রয়োজনে পাকিস্তানের শক্তিশালী নেতাদেরই পছন্দ করতেন—৬০-এর দশকে আইয়ুব খান, ৮০-র দশকে জিয়া-উল-হক, এবং ৯/১১–এর পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মুশাররফ।

তবে আজকের পার্থক্য হলো—মুনির তাঁদের মতো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেননি। বরং সেনাবাহিনী এখন আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই নিজের প্রভাব স্থাপন করেছে। তারা বিনিয়োগ সংস্থাগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে, পররাষ্ট্রনীতি গড়ে দিচ্ছে, কমান্ড কাঠামো পুনর্গঠন করছে এবং সেনাপ্রধানকে বেসামরিক ক্ষেত্রেও মূল সিদ্ধান্তকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। আর বিদেশের বহু অংশীদারও এখন মনে করেন, সামরিক নেতৃত্বের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সুবিধাজনক।

সেনাবাহিনীর কাছে এই প্রকাশ্য ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করাও যুক্তিসঙ্গত। মুনির সাধারণ সেনাপ্রধান নন। তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এ বছর ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হয়েছেন। তাঁকে তিন বাহিনীর সর্বাধিনায়কও করা হয়েছে। অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই তিনি এখন সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি।

তবে তাঁর উত্থানের পেছনে একটি বৈপরীত্য আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা কমেছিল। ইমরান খানের অপসারণ ও পরবর্তী অস্থিরতার পর বহু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা হারায়। ২০২৩ সালের মে মাসে খানের সমর্থকেরা লাহোরে কর্পস কমান্ডারের বাসভবনসহ সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়—যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এতে জেনারেলরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে আড়ালে থেকে আর লাভ নেই। বরং তাঁরা নিজেদেরকে খলনায়ক নয়, স্থিতিশীলতার শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন। তাদের ক্ষমতার চর্চাকে গোপন কৌশল নয়, বরং দেশের জন্য প্রয়োজনীয় ‘শক্ত অবস্থান’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

তাদের হিসাব পরিষ্কার। ভারতের সঙ্গে মে মাসের উত্তেজনার পর সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। তখন জেনারেলরা বুঝতে পারেন—অর্থনৈতিক কূটনীতি, বিনিয়োগ চুক্তি এবং অন্যান্য উদ্যোগে যদি জনআস্থা পেতে হয়, তবে সেগুলো প্রকাশ্যেই পরিচালনা করতে হবে। আগে যেসব আলোচনায় তারা নীরবে প্রভাব রাখত, এখন সেগুলোর কৃতিত্বও প্রকাশ্যে নিতে চায়।

দৃশ্যমান হাত

পাকিস্তান আগেও সামরিক শাসন দেখেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি সরাসরি আয়ুব, জিয়া বা মুশাররফের আমলের পুনরাবৃত্তি নয়। এবার কোনো অভ্যুত্থান হয়নি। সংবিধান স্থগিত হয়নি। সংসদও বাতিল হয়নি। সেনাবাহিনী এখন গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর থেকেই কাজ করছে, বাইরে থেকে নয়। জেনারেলরা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা দখল না করেও কার্যত রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আর এই রূপান্তর দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।

অদৃশ্য শক্তি দৃশ্যমান হওয়াটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। এতে বড় রাজনৈতিক পক্ষগুলোর প্রণোদনা বদলে যায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন চাপের মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক মহলেও পাকিস্তানের অবস্থান ভিন্নভাবে মূল্যায়িত হয়। এই ব্যবস্থাকে প্রকাশ্যে আনার ফলে সামরিক আধিপত্যই স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভুমিকা সীমিত হয়ে যেতে পারে। সংসদ অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার মঞ্চে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রীও এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী হয়ে ওঠেন, যা অন্য কোথাও নেওয়া হয়। ইমরান খানকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য যে সমঝোতা করা হয়েছিল, সেটিই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

তবে সেনাবাহিনীর এই দৃশ্যমান অবস্থান নতুন ধরনের দায়বদ্ধতাও তৈরি করছে। যখন সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে নীতি নির্ধারণ করে, তখন ফলাফলের দায়ও তাদের গ্রহণ করতে হয়। অর্থনীতি থেমে গেলে, বিনিয়োগ ব্যর্থ হলে বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে—জেনারেলরা আর অদক্ষ মন্ত্রিসভাকে দোষ দিতে পারে না। প্রদর্শিত ক্ষমতার সঙ্গে ব্যর্থতার জবাবদিহিও জুড়ে যায়।

এই পরিবর্তন ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। সামরিক নেতৃত্ব বারবার জনমত জরিপের কথা বলছে। তারা সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের সিদ্ধান্ত দৃঢ়ভাবে ব্যাখ্যা করছে। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সাফল্যের কৃতিত্বও নিজেদের নিতে চাইছে। এতে বোঝা যায়—ফল না মিললে দায়ভার তাদের ওপর বর্তানোর ঝুঁকি তারা আগের তুলনায় বেশি উপলব্ধি করছে।

প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলো উপেক্ষা করাও দ্বিমুখী ফল দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বিশেষ বিনিয়োগ সহায়তা কাউন্সিলকে ধরা যায়। বিদেশি বিনিয়োগ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৌশলগত শিল্প বিষয়ক সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়ায় সিদ্ধান্ত দ্রুত হতে পারে। বিনিয়োগকারীরাও কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারে। কিন্তু ক্ষমতার এই একীকরণ মন্ত্রণালয়গুলোকে দুর্বল করতে পারে। বেসামরিক দক্ষতা কমে যেতে পারে। সংসদীয় নজরদারি, গণমাধ্যমের সমালোচনা এবং বিরোধী দলের পর্যবেক্ষণ—গণতন্ত্রকে সংশোধনের যে প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়—তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পাকিস্তানের অতীত সামরিক শাসন এ বিষয়ে স্পষ্ট উদাহরণ—সামরিক সরকার কখনো স্বল্পমেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু অর্থনীতি দুর্বল হলে বা সংকট দেখা দিলে প্রতিষ্ঠানগত সুরক্ষা না থাকায় পরিস্থিতি দ্রুত ভেঙে পড়ে।

ইমরান খানের দুই বছরের কারাবাস সেনাবাহিনীর অবস্থানকে আরও জটিল করেছে। এখন যখন তারা প্রকাশ্যে শাসন করছে, তখন শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে—খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি বৈধ বিচারিক বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নির্ধারিত হবে, নাকি তাঁকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাদ রাখা হবে। দুই পথই ঝুঁকিপূর্ণ। পুনর্বাসন নতুন শাসন কাঠামোকে অস্থিতিশীল করতে পারে। আর অনন্তকাল তাকে আটকে রাখলেও ঝুঁকি আছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশসহ কিছু রাষ্ট্র সামরিক নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে, তবুও সেনাপ্রধানের দৃশ্যমান নেতৃত্ব পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি সীমিত করতে পারে। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ আরও সামরিকীকৃত হবে। বেসামরিক কূটনৈতিক চ্যানেলের চেয়ে সেনা-নিয়ন্ত্রিত পথ প্রাধান্য পাবে। এতে আলোচনা কঠিন হবে এবং উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকিও বাড়বে।

মধ্যপ্রাচ্যেও প্রভাব পড়বে। পাকিস্তান সম্প্রতি সৌদি আরবের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। সামরিক নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান অন্যান্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হিসাব-নিকাশে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়বে। এতে ইরানের সঙ্গে নীতিগত সংঘাত বাড়তে পারে। এমনকি পাকিস্তান নিজের পছন্দের বাইরে অন্যদের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

মঞ্চটি সম্পূর্ণ আলোকিত

এর আগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থা সেনাবাহিনীকে পর্দার আড়ালে রেখে দায়মুক্ত শাসনের সুযোগ দিয়েছে। ব্যর্থতার দায় বহন করেছে বেসামরিক নেতৃত্ব। মুনির মডেল সেই সমঝোতাকে উল্টে দিয়েছে। সামরিক শক্তিকে প্রকাশ্যে এনে—হোয়াইট হাউসে সেনাপ্রধানকে সামনে রেখে, শুল্কনীতি ও জ্বালানি অনুসন্ধানের কেন্দ্রে বসিয়ে, খনিজ ও প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনার টেবিলে দাঁড় করিয়ে—সেনাবাহিনী গতি ও দক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এতে সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্বের দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে। এটি শুধু নীরব অভ্যুত্থান নয়, বরং আরও পরিশীলিত একটি প্রক্রিয়া—কৌশলগত একীকরণ। সেনাবাহিনী এখন তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠানগতভাবে স্থায়ী করেছে।

পরিহাস হলো—শহবাজ শরিফ এখন এমন এক ব্যবস্থার প্রধান, যার বিরুদ্ধে তার বড় ভাই নওয়াজ শরিফ একসময় লড়াই করেছিলেন। নওয়াজ প্রতিবার ক্ষমতায় এসে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন। ১৯৯৮ সালে সেনাপ্রধান জাহাঙ্গীর করামত সংবিধানভিত্তিক একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন, যা তুরস্কের মডেলের মতো শাসনব্যবস্থায় সামরিক মতামতকে আনুষ্ঠানিক করত। নওয়াজ এটিকে ক্ষমতার সীমা অতিক্রম হিসেবে দেখেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি করামতকে পদত্যাগ করতে বলেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে সেই প্রথম কোনো সেনাপ্রধানকেই সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।

শেহবাজের আমলে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। ‘সহ-মালিকানা’ বা ‘সহায়তা’ জাতীয় ভদ্র ভাষা সরিয়ে দিলে দেখা যায়, এই তথাকথিত হাইব্রিড মডেল আসলে পুরোনো সত্যের নতুন রূপ। সেনাবাহিনীই পুরোটা পরিচালনা করছে এবং বেসামরিক নেতৃত্ব সেই ব্যবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। পার্থক্য হলো—এবার পর্দা টানা নেই। মঞ্চ পুরোপুরি আলোকিত। সবাই স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে, ক্ষমতার আসল নিয়ন্ত্রণ কার হাতে।

(ফরেন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত মাহরিন জাহরা-মালিকের লেখার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক)

Ad 300x250

সম্পর্কিত