ব্রাজিলে চলমান জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের করিডোরজুড়ে জলবায়ু কর্মীরা ‘বাম (বিএএম)!’ লেখা ব্যাজ পরছেন। এটি পুরনো কোনো সুপারহিরো কমিকের প্রতি সমর্থন নয়। বরং তারা বেলেম অ্যাকশন মেকানিজম (বিএএম)-এর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো দেশগুলোকে নিম্ন-কার্বন অর্থনীতির দিকে ন্যায়সংগত রূপান্তর নিশ্চিত করতে সাহায্য করা।
কপ৩০–এ জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রবক্তাদের কাছে ‘বাম’ নিশ্চিত করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাদের মতে, ন্যায়সংগত রূপান্তর অগ্রাধিকার না পেলে জলবায়ু কার্যক্রম অনিচ্ছাকৃতভাবে শ্রমিক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়কে পিছিয়ে দেবে।
বর্তমান উত্তোলন-নির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থা ও দূষণকারী শিল্পগুলো কিছু জনগোষ্ঠীর অন্যদের তুলনায় বেশি ক্ষতি করে। সামনের সবুজ অর্থনীতিতে এসব বৈষম্য পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয়। বরং সমৃদ্ধি বাড়াতে হবে এবং বৈষম্য কমাতে হবে।
এই সপ্তাহে আন্দোলনকারীরা বড় সাফল্য পেয়েছেন। বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলো বিএএম-এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
তাহলে ‘বাম’ কী? এবং কপ৩০–এ এটি এত গুরুত্ব পাচ্ছে কেন?
ন্যায়সংগত রূপান্তর কী?
ন্যায়সংগত রূপান্তর বা ‘জাস্ট ট্রানজিশন’ ধারণাটি যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলন থেকে এসেছে। বিশেষ করে জ্বালানি ও রাসায়নিক খাতের শ্রমিকরা দাবি করেছিলেন যে দূষণকারী খাত থেকে পরিবেশবান্ধব খাতে পরিবর্তনের সময় শ্রমিকদের সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
পরবর্তীতে নাগরিক সংগঠনগুলো এই ধারণা বিস্তৃত করে। এখন এতে শুধু জ্বালানি খাতের শ্রমিক নয়, বরং জলবায়ু নীতির ফলে পরিবর্তনের মুখোমুখি হওয়া সব মানুষের কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এর মধ্যে রয়েছে স্থানান্তরকালীন খনিজ খাতের শ্রমিক, খনিজ উত্তোলন এলাকার বাসিন্দা এবং কৃষি খাতে পরিবেশবান্ধব প্রচেষ্টার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।
কপ আলোচনায় ন্যায়সংগত রূপান্তর কখন অন্তর্ভুক্ত হয়?
২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির প্রস্তাবনায় প্রথম এটি উল্লেখ করা হয়। তখন পক্ষগুলো সম্মত হয়েছিল যে কর্মসংস্থান, মর্যাদাপূর্ণ কাজ এবং জাতীয় অগ্রাধিকার অনুযায়ী ন্যায়সংগত রূপান্তর বিবেচনায় রাখতে হবে।
এতে স্বীকার করা হয় যে পরিকল্পনা ছাড়া নিম্ন-কার্বন অর্থনীতিতে রূপান্তর শ্রমিক ও বিভন্ন জনগোষ্ঠীকে পিছিয়ে দিতে পারে। তবে প্রস্তাবনার ভাষা বাধ্যতামূলক নয়, তাই বাস্তবায়নের পথও তৈরি হয়নি।
২০১৮ সালে কাটোভিৎসের জলবায়ু সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ কমিটি বিষয়টি আলোচনায় আনেন।
২০২১ সালে মিশরের কপ২৭–এ পক্ষগুলো ‘জাস্ট ট্রানজিশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম’গঠন করে। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশগুলোকে ন্যায়সংগত রূপান্তরের নকশা তৈরি করতে সাহায্য করা এবং জলবায়ু কার্যক্রমের অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি কমানো।
পরের বছর দুবাইয়ে, কর্মকর্তারা এই কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করেন এবং নিয়মিত সংলাপ আয়োজনের বিষয়ে সম্মত হন। তবে এগুলোর কোনোটিই দেশগুলোর জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করেনি।
‘বাম’ সমর্থকরা বলছেন, তাদের পরিকল্পনা এই শূন্যস্থান পূরণ করবে।
‘বাম’ কী করবে?
‘বাম’-এর সমর্থকদের মতে, ন্যায়সংগত রূপান্তরের জন্য দেশগুলোর ওপর বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে একটি নতুন প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে বৈশ্বিক পর্যায়ে ন্যায়সংগত রূপান্তর—সম্পর্কিত প্রচেষ্টা বিচ্ছিন্ন এবং অসঙ্গত।
অ্যাকশনএইডের বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রধান তেরেসা অ্যান্ডারসন বলেন, এখন পর্যন্ত কেউই এই বিষয়ে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছে না।
তিনি বলেন, ‘বাম’ এই সমস্যার সমাধান করবে।
‘বাম’ দেশগুলোকে ন্যায়সংগত রূপান্তর-সংক্রান্ত কাজ সমন্বয় করতে বাধ্য করবে। এতে বৈশ্বিকভাবে কী ঘটছে এবং কারা প্রভাবিত হচ্ছে, এসব বিষয়ে সবার স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে।
এটি দেশগুলোর মধ্যে ন্যায়সংগত রূপান্তরের সেরা অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পথ তৈরি করতে চায়।
এছাড়া নীতিগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করতেও লক্ষ্য রাখে, বিশেষত নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে প্রশাসনিক সক্ষমতা সীমিত।
বাম নতুন কোনো জলবায়ু অর্থায়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করবে না। তবে এটি অগ্রাধিকার দেবে ঋণমুক্ত আর্থিক সহায়তাকে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তি ভাগাভাগি নিশ্চিত করবে।
এগুলো সেই মূল্যবোধ, যেগুলো প্যারিস চুক্তিতেই দেশগুলো রক্ষা করার অঙ্গীকার করেছিল।
নাগরিক সমাজে কারা বাম-কে সমর্থন করছে?
এই বছরের শুরুতে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন বাম-এর ধারণা তৈরি করে। এটি তৈরি করেছে ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক, যা বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশবাদী সংগঠনের জোট।
এছাড়া যুক্ত রয়েছে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার কনস্টিটুয়েন্সি, যা লিঙ্গ ন্যায়বিচারভিত্তিক বহু সংগঠনের জোট এবং জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত।
শ্রম আন্দোলন, যুব আন্দোলন এবং গ্লোবাল ক্যাম্পেইন টু ডিমান্ড ক্লাইমেট জাস্টিস-এর মতো জলবায়ু ন্যায়বিচার জোটও ‘বাম’-এর অংশীদার।
কপ৩০-এ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি জোটও ‘বাম’-এর সমর্থনে যোগ দিয়েছে বলে জানান অ্যান্ডারসন।
তিনি বলেন, তাদের সমষ্টিগত সিদ্ধান্তগ্রহণ পদ্ধতির কারণে তারা আগে যোগ দিতে পারেনি। সরাসরি বৈঠক করার পর তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
তারা জানায়, ‘বাম’-এর মতো একটি কাঠামো তাদেরও প্রয়োজন।
কোন কোন রাষ্ট্র বাম-এর বিরোধী? আর কারা সমর্থক?
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, কিছু ক্ষমতাশালী দেশ এখনো বাম-এর বিরোধিতা করছে।
এর মধ্যে যুক্তরাজ্য ও জাপানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক এই সপ্তাহে এ দুই দেশকে ব্যঙ্গাত্মক ‘ফসিল অব দ্য ডে’ পুরস্কার দিয়েছে প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন না দেওয়ায়।
ফিলিপাইন ‘বাম’-এর প্রথম শক্তিশালী সমর্থক ছিল। এখন আরও অনেক দেশ এতে যুক্ত হয়েছে।
মঙ্গলবার জি-৭৭ ও চীন—যারা সম্মিলিতভাবে বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে—ন্যায়সংগত রূপান্তর প্রক্রিয়ার পক্ষে একক অবস্থান ঘোষণা করে।
এ সমর্থন পুরো আন্দোলনের জন্য বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান