leadT1ad

পারমাণবিক জ্বালানি ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান নিয়ে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর, ২০২৫) হোয়াইট হাউসে সৌদি যুবজার এমবিএস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক হয়। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) হোয়াইট হাউস সফরে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এসব চুক্তির লক্ষ্য দুই দেশের অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি সম্পর্ককে আরও গভীর করা। এর মধ্যে আছে বেসামরিক পারমাণবিক জ্বালানি সহযোগিতা এবং উন্নতমানের এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান বিক্রি। এর পাশাপাশি ট্যাংকসহ আরও কিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির সিদ্ধান্তও হয়েছে।

এই সমঝোতাগুলো দুই দেশের সম্পর্কে নতুন উষ্ণতা আনে। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সম্পর্কে বেশ অবনতি হয়েছিল। নতুন চুক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। যদিও এগুলো পারমাণবিক শক্তি ছড়ানো সীমিত রাখার নীতিমালা মেনে সম্পন্ন হয়েছে, তবুও আঞ্চলিক নিরাপত্তা, প্রযুক্তি সুরক্ষা এবং ইসরায়েল, ইরান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

পটভূমি

মার্কিন-সৌদি সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে তেল, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সৌদি আরব দীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা। তবে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর এ সম্পর্ক কঠোর পরীক্ষার মুখে পড়ে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা হত্যাকাণ্ডের আদেশ এমবিএস দিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করলেও তিনি তা অস্বীকার করেন।

ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় ফিরে আসার পর সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে জোর দেয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সৌদিকে ইরানবিরোধী আঞ্চলিক কৌশলের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। একই সঙ্গে রিয়াদ ‘ভিশন ২০৩০’-এর মাধ্যমে তাদের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করে গড়ে তুলতে চাইছে, যার জন্য মার্কিন বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ।

২০২৫ সালে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর আলোচনাগুলো দ্রুত এগোতে থাকে। সাত বছরের মধ্যে এই প্রথম এমবিএস-এর হোয়াইট হাউস সফরে সামরিক প্রদর্শনীসহ বিশেষ আয়োজন করা হয়। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চাইছিল, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানের সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে। একই সঙ্গে তারা উন্নত অস্ত্র পেয়ে নিজেদের সামরিক আধুনিকায়ন ত্বরান্বিত করতে চায়। বিনিময়ে রিয়াদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যদিও নির্দিষ্ট বিবরণ এখনো স্পষ্ট নয়।

আলোচনায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক ইস্যুগুলোও উঠে আসে। সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে আগ্রহী, তবে তারা বিনিময়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে হিসেবে রেখেছে—যা ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করছে। এদিকে, ২০২৫ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর সৌদির নিরাপত্তা উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে।

চুক্তিতে কী আছে

জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তির মূলে আছে বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি উন্নয়ন নিয়ে একটি যৌথ ঘোষণা। এর মাধ্যমে উভয় দেশ বহু বিলিয়ন ডলারের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার আইনি কাঠামো তৈরি করেছে। চুক্তিটি সৌদি আরবকে কেবল শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে মার্কিন পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দেয়। এতে তেলনির্ভরতা কমিয়ে জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

পারমাণবিক শক্তি ছড়ানো সীমিত রাখার নীতি অনুযায়ী সৌদি আরবের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ব্যবহৃত জ্বালানি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা থাকবে। কারণ এসব প্রক্রিয়াই পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের সম্ভাব্য পথ। সৌদি আরব এ বিষয়ে পূর্ণ ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় আলোচনা জটিল হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষ একটি মাঝামাঝি সমাধানে পৌঁছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নির্দিষ্ট অর্থমূল্য বা সময়সূচি প্রকাশ করা হয়নি।

এই চুক্তি সৌদি আরবের নিজস্ব পারমাণবিক সক্ষমতা গড়ার লক্ষ্যকে এগিয়ে দেবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার জন্য অতিরিক্ত কাঠামোও স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা বৃহত্তর পারমাণবিক উদ্যোগকে সমর্থন করবে।

প্রতিরক্ষা বিক্রয় ও কৌশলগত চুক্তি

যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো সৌদি আরবের কাছে এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। রিয়াদ মোট ৪৮টি বিমান চেয়েছে। লকহিড মার্টিন নির্মিত প্রতিটি বিমানের দাম প্রায় ৮০ থেকে ১১০ মিলিয়ন ডলার। ফলে পুরো চুক্তির মূল্য বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা দপ্তরের (পেন্টাগন) প্রযুক্তি চুরির ঝুঁকি সংক্রান্ত উদ্বেগ—বিশেষত চীনের মাধ্যমে সংবেদনশীল স্টেলথ প্রযুক্তি ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা—আংশিকভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।

চুক্তির অংশ হিসেবে সৌদি আরব প্রায় ৩০০টি মার্কিন ট্যাংক কিনতে সম্মত হয়েছে। এগুলো সম্ভবত এম১ অ্যাব্রামস মডেলের। এতে সৌদির স্থল যুদ্ধক্ষমতা বাড়বে। পুরো প্রতিরক্ষা চুক্তির আর্থিক মূল্য প্রকাশ করা হয়নি, তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোকে সৌদি আরবে কার্যক্রম পরিচালনা সহজ করতে বিশেষ ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

উভয় দেশ একটি নতুন কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তিতেও সই করেছে, যার লক্ষ্য আঞ্চলিক প্রতিরোধ সক্ষমতা জোরদার করা। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় কমাতে যৌথ তহবিলে আর্থিক অবদান রাখবে। তবে রিয়াদের কাঙ্ক্ষিত ন্যাটো-ধাঁচের পূর্ণ নিরাপত্তা চুক্তি এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পাশাপাশি সৌদি আরবকে ‘মেজর নন-ন্যাটো অ্যালাই’ বা ‘ন্যাটে-বহির্ভুত বড় মিত্র’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এতে সৌদি আরব সামরিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা পেলেও কোনো বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি পায়নি।

প্রভাব ও তাৎপর্য

এই চুক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। এফ-৩৫ বিক্রি ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সামরিক আধিপত্যের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, কারণ এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলে কেবল ইসরায়েলই এই উন্নত যুদ্ধবিমান পেয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কেও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে সৌদি আরবের জন্য উন্নত অস্ত্র ও পারমাণবিক প্রযুক্তি লাভ ইরানবিরোধী প্রতিরোধ শক্তি বাড়াবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইরানি স্থাপনায় সাম্প্রতিক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে।

তবে ঝুঁকিও রয়েছে। পেন্টাগন আগেই চীনা গুপ্তচরবৃত্তির সম্ভাবনার কথা সতর্ক করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ন করতে পারে। সৌদি আরব যদি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অধিকার নিয়ে চাপ দিতে থাকে, তবে পারমাণবিক ইস্যুতেও নতুন উত্তেজনা দেখা দিতে পারে—যা ইরান প্রশ্নকে আরও জটিল করবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে চুক্তিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে কর্মসংস্থান বাড়াবে এবং সৌদির অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করতেও সহায়ক হবে।

কেউ কেউ সৌদি-চীন বা সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্কের ইঙ্গিত তুলে ধরে নতুন কৌশলগত সমীকরণের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এমবিএস-এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারকে সমালোচনা করছে, কারণ দেশের ভেতরে দমন-পীড়ন এখনো অব্যাহত।

বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব চুক্তি সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যদিও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এখনো প্রধান বাধা। একই সঙ্গে এটি ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিফলন, যেখানে অতীত বিতর্কের চেয়ে বাণিজ্যিক ও কৌশলগত লাভকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত