leadT1ad

সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্কসহ যেসব বিষয়ে আলোচনা ট্রাম্প ও এমবিএসের

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

১৮ নভেম্বর ওভাল অফিসে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বক্তব্য রাখছেন। ছবি: রয়টার্স।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে (এমবিএস) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। এই সফর রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজ এমবিএস-এর জন্য আক্ষরিক অর্থেই লাল গালিচা বিছিয়ে দেয়। ট্রাম্প তাকে স্বাগত জানান আনুষ্ঠানিক এক প্রদর্শনী দিয়ে। প্রদর্শনীতে ছিল মার্চিং ব্যান্ড, পতাকা বহনকারী অশ্বারোহী দল এবং সামরিক বিমানের উড্ডয়ন।

এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন ট্রাম্পের সেই দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরে, যেখানে তিনি মধ্যপ্রাচ্যকে নতুনভাবে কল্পনা করেন। বিনিয়োগ-নির্ভর একটি অঞ্চল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য।

এমবিএস ও ট্রাম্প ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের প্রশ্ন নেন। তারা ব্যবসার সুযোগ, শান্তি উদ্যোগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা নিয়ে কথা বলেন।

এই বৈঠক থেকে কয়েকটি বড় ঘোষণা আসে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র–সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার বিষয়ে।

সৌদি–ইসরায়েল সম্পর্ক নিয়ে ‘ভালো আলোচনা’

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি চান সৌদি আরব আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দিক। এই চুক্তি ইসরায়েল ও কিছু আরব রাষ্ট্রের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল।

মঙ্গলবার এমবিএস ও ট্রাম্প এই ইস্যুতে অগ্রগতির ইঙ্গিত দেন, যদিও কোনো বিস্তারিত তথ্য বা সময়সীমা দেননি। তবে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স পুনরায় জানান, সম্ভাব্য যেকোনো সমঝোতার অংশ হিসেবে রিয়াদ একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এগিয়ে নিতে চায়।

তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা সৌদি আরবের জন্য কল্যাণকর। সৌদি আরব আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের অংশ হতে চায়।

তবে তিনি স্পষ্ট করেন যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য পরিষ্কার পথ নিশ্চিত করাও জরুরি। তিনি বলেন, এই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে এবং যত দ্রুত সম্ভব সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে কাজ করতে হবে।

সৌদি কর্মকর্তারা আগেও বলেছেন যে রিয়াদ আরব শান্তি উদ্যোগের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতির বিনিময়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়েও অনড় সৌদি আরব।

ট্রাম্প বলেন, তিনি এই বিষয়ে এমবিএস-এর সঙ্গে ‘ভালো আলোচনা’ হয়েছে। তিনি বলেন, তারা এক-রাষ্ট্র, দুই-রাষ্ট্র সব ধরনের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন এবং শিগগিরই আলোচনার অগ্রগতি হবে।

সৌদি আরবকে ন্যাটোবহির্ভুত প্রধান মিত্রের মর্যাদা ও প্রতিরক্ষা চুক্তি

হোয়াইট হাউসে দেওয়া এক ব্ল্যাক-টাই নৈশভোজে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে ‘ন্যাটোবহির্ভুত প্রধান মিত্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

এই মর্যাদা যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত সামরিক সরঞ্জাম ও সহযোগিতা সহজতরভাবে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। এতে অন্যান্য ক্রেতাদের যে জটিল লাইসেন্স প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সৌদি আরবকে তা করতে হবে না।

এই মর্যাদাপ্রাপ্ত দেশগুলোর তালিকায় সৌদি আরব ১৯টি দেশের সঙ্গে যুক্ত হলো। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকেও একই পর্যায়ে বিবেচনা করে।

এদিকে, হোয়াইট হাউস জানায় যে ট্রাম্প ও এমবিএস একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই চুক্তি দুই দেশের ৮০ বছরের প্রতিরক্ষা অংশীদারত্বকে আরও শক্তিশালী করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।

চুক্তির বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, এতে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় কমাতে আর্থিক সহায়তা দেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের প্রধান কৌশলগত অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

এই চুক্তির আগে ইসরায়েলের সেপ্টেম্বর মাসের কাতার হামলার পর সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গেও পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই ঘটনার পর উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে কতটা নির্ভরযোগ্য মনে করা যায়, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দেয়।

সোমবার ট্রাম্প নিশ্চিত করেন যে তিনি সৌদি আরবের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি অনুমোদন করবেন।

এমবিএস-এর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, এই বিমানগুলো ইসরায়েলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য কমমানের করে দেওয়া হবে না। এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ‘কোয়ালিটেটিভ মিলিটারি এজ’ থেকে সরে আসার একটি ইঙ্গিত। এই নীতিতে ইসরায়েলকেই শুধু উন্নতমানের সামরিক সরঞ্জাম দেওয়া হতো।

ট্রাম্প বলেন, কিছু পক্ষ চায় সৌদিদের মানহীন বিমান দেওয়া হোক, কিন্তু এতে সৌদি আরব সন্তুষ্ট হবে না।

তিনি আরও বলেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েল উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। তাই তারা উভয়ই সর্বোচ্চ মানের সরঞ্জাম পাওয়ার যোগ্য।

ইরান সমঝোতা চাইছে, দাবি ট্রাম্পের

ট্রাম্প আবারও জুন মাসে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় তার সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযান সবার পক্ষেই পরিচালনা করেছে। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সর্বোত্তম পাইলট, সেরা সরঞ্জাম এবং সর্বোচ্চ মানের যুদ্ধবিমান রয়েছে।

পরবর্তীতে তিনি ইরান বিষয়ে নরম সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, তেহরান এখন ওয়াশিংটনের সঙ্গে কূটনৈতিক সমাধান চাইছে। আর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

ট্রাম্প বলেন, তিনি আলোচনার জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত এবং ইতোমধ্যে কথা চলছে। তিনি বলেন, আলোচনা শুরু হয়েছে। ইরানের সঙ্গে একটি সমঝোতা হলে তা ভালো হবে। যুদ্ধের আগে এটি সম্ভব হতো, কিন্তু তা হয়নি। তবে এখন কিছু না কিছু অগ্রগতি হবে বলে তিনি মনে করেন।

সৌদি সরকারি সংবাদ সংস্থা এসপিএ জানায়, ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে এমবিএস ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ানের একটি হাতে লেখা চিঠি পান। চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি।

মঙ্গলবার প্রিন্স মোহাম্মদ জানান, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমঝোতাকে সমর্থন করবে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চুক্তি নিশ্চিতে সৌদি আরব সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালাবে। তিনি মনে করেন, একটি ভালো চুক্তি ইরানের ভবিষ্যতের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্যও প্রয়োজনীয়।

১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ?

দুই নেতার যৌথ বক্তব্যের শুরুতে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি আরবের সম্ভাব্য বিনিয়োগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই বিনিয়োগ কয়েকশ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।

তিনি মজা করে বলেন, সৌদি আরব ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সম্মত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এমবিএস তার বন্ধু হওয়ায় এই বিনিয়োগ ১ ট্রিলিয়ন ডলারেও যেতে পারে।

ট্রাম্প দাবি করেন, সৌদি বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং আমেরিকান কোম্পানি ও ওয়াল স্ট্রিটের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করবে।

এমবিএস জানান, সৌদি আরবের যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ সম্ভবত ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। তিনি বলেন, প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিরল খনিজ ও চুম্বক প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হচ্ছে, তা বিপুল বিনিয়োগ সুযোগ তৈরি করবে।

তিনি ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের ‘সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেশ’। তিনি যোগ করেন, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান প্রযুক্তির ভিত্তি নির্মাণে অংশ নিতে চায়।

প্রশংসা ও হাস্যোজ্জ্বল মুহূর্ত

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স হোয়াইট হাউসে পৌঁছানোর পর থেকেই ট্রাম্প ও এমবিএস একে-অপরকে প্রশংসা করতে থাকেন। দুজনের মুখেই ছিল হাসি।

এক পর্যায়ে ট্রাম্প প্রিন্স মোহাম্মদের হাত ধরে বলেন, তিনি আগের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো মুষ্টিবদ্ধ অভিবাদন নয়, প্রকৃত করমর্দনেই অভ্যর্থনা জানাতে চান।

ট্রাম্প বলেন, তিনি করমর্দন এড়ান না। তিনি এমবিএসকে ‘অসাধারণ’ এবং ‘মেধাবী’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

ট্রাম্প বলেন, আজ ওভাল অফিসে উপস্থিত ব্যক্তি অত্যন্ত সম্মানিত। তিনি অনেক দিন ধরেই তার ব্যক্তিগত বন্ধু।

ট্রাম্প আরও বলেন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমবিএস যে কাজ করেছেন তা ‘অসাধারণ’।

পরে তিনি এবিসি নিউজের এক প্রতিবেদকের প্রশ্নের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ওই সাংবাদিক প্রিন্স মোহাম্মদকে অসম্মান করেছেন।

পরে একই সাংবাদিক যখন ট্রাম্পকে জেফরি এপস্টেইন সংক্রান্ত সরকারি নথি প্রকাশ না করার কারণ জিজ্ঞাসা করেন, ট্রাম্প বলেন যে এবিসি নিউজের সম্প্রচার লাইসেন্স বাতিল করা উচিত।

ট্রাম্প সাংবাদিককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি একজন ভয়ংকর মানুষ এবং ভয়ংকর প্রতিবেদক।’

এদিকে, প্রায় একই সময়ে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ এপস্টেইন-সংক্রান্ত নথি প্রকাশ বাধ্যতামূলক করার একটি বিল পাস করে।

সূত্র: আল-জাজিরা

Ad 300x250

সম্পর্কিত