সাত বছর আগে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে একপ্রকার ওয়াশিংটন থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল। ভিন্নমতের লেখক ও সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে তার প্রতি তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। তবে মঙ্গলবার তিনি আবারও ওয়াশিংটনে ফিরলেন এমন এক অভ্যর্থনা নিয়ে, যা দেখায়—তিনি এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন মধ্যপ্রাচ্য নীতির কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
এটি আধুনিক কূটনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর ভূরাজনৈতিক পুনরুত্থানগুলোর একটি। আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ধনী রাষ্ট্রের এই কার্যত শাসক নিজস্ব শর্তেই ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম হয়েছেন। ছয় বছর আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে ‘পরিত্যাজ্য’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এখন তিনি সেই অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত জায়গায় ফিরে এসেছেন।
ক্রাউন প্রিন্স ট্রাম্পের কাছ থেকে এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান কেনার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন, যদিও ইসরায়েল এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। একই সময়ে তিনি সৌদি আরবের সম্ভাব্য আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগদান—এবং ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি—নিয়েও আলোচনা কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
ওভাল অফিসে তিনি বলেন, ‘আমরা আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দিতে চাই। তবে আমরা চাই ফিলিস্তিন ইস্যুতে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের একটি স্পষ্ট পথ নিশ্চিত হোক।’ তিনি জানতেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই শর্ত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলিদের সঙ্গে শান্তি চাই। আমরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গেও শান্তি চাই। আমরা চাই তারা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করুক।’
এরপর ঐতিহ্যবাহী মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতির আলোচনাকে পেছনে ফেলে তিনি সেই কথা বললেন যেটি তার আতিথেয় প্রেসিডেন্ট শুনতে আগ্রহী ছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রে এক ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্রয় ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি। এই অংক তার দেশের সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের মোট মূল্যের চেয়েও বেশি। তবে তিনি সময়সীমা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন, কারণ ট্রাম্প চেয়েছিলেন বড় একটি সংখ্যার ঘোষণা—তা বাস্তবসম্মত হোক বা না-হোক।
এর বিনিময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক কম্পিউটার চিপ প্রাপ্তির সম্ভাব্য নিশ্চয়তা পেয়েছেন। এই চিপগুলো সৌদি আরবের বিশাল ডেটা সেন্টার স্থাপনে অপরিহার্য, যা দেশটিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পার অংশ। এসব উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেসর সৌদির তেল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি—উভয় উৎস থেকেই শক্তি পাবে। সফরের আগে থেকেই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—ওয়াশিংটন দ্বিধায় থাকলে বেইজিং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরবরাহ করতে প্রস্তুত।
হার্ভার্ডের বেলফার সেন্টারের পরিচালক ও সাবেক মার্কিন কর্মকর্তার মতে, ‘এটি এক ধরনের “চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন সফর”। এমবিএস সৌদি আরবকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন।’ তিনি বলেন, ক্রাউন প্রিন্স আক্রমণাত্মক প্রযুক্তি কৌশল এবং তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিচ্ছেন। একই সঙ্গে তিনি দক্ষতার সঙ্গে চীনকে বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের কার্ড দেখাচ্ছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রকে চাপের মধ্যে রাখছে।
তবে তিনি তার সব দাবিতে সফল হননি। পারমাণবিক সহযোগিতা বিষয়ে দীর্ঘদিনের আলোচনা আবারও পিছিয়ে গেছে। উভয় পক্ষ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বিষয়ে কিছু অনির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করেছে। সৌদি আরব এ অধিকার পেলে নিজস্ব রিয়েক্টরে জ্বালানি তৈরি করতে পারবে—একই সঙ্গে চাইলে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতাও অর্জন করতে পারে। ঠিক এই কারণেই বিষয়টি সবসময় জটিল।
এছাড়া পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে কি না—তা স্পষ্ট নয়। ওভাল অফিসে এ বিষয়ে প্রকাশ্য আলোচনা হয়নি। হোয়াইট হাউস কেবল একটি অস্পষ্ট ‘তথ্য বিবরণী’ প্রকাশ করেছে, যেখানে কয়েকটি সহযোগিতার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা ফিলিপাইনের সঙ্গে চুক্তির মতো পারস্পরিক নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত যুদ্ধবিমান সৌদি সামরিক ঘাঁটিতে স্থাপন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক চিপ সৌদির ডেটা সেন্টারে অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি—এই দুই অর্জনই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কেবল প্রযুক্তি নয়; এগুলো এক প্রতীক। সৌদি আরব এখন নিজেকে বিস্তৃত ‘পশ্চিমা’ পরিমণ্ডলের অংশ হিসেবে দেখতে চায়। প্রায় পঁচিশ বছর আগে ৯/১১ হামলা—যার অধিকাংশ হামলাকারী ছিলেন সৌদি নাগরিক—সৌদির ভাবমূর্তি নড়বড়ে করে দেয়। আজকের এই চিত্র সেই অতীত থেকে এক নাটকীয় ভিন্ন বাস্তবতা প্রতিফলিত করে।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে কেবল ইসরায়েলই এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের অধিকারী। ইসরায়েল এই একচেটিয়া সক্ষমতাকে তার ‘গুণগত সামরিক প্রাধান্য’ বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রও দীর্ঘদিন ধরে এই প্রাধান্যের গ্যারান্টি দিয়ে এসেছে। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সৌদি আরবকে এফ-৩৫ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলে এই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কীভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। হোয়াইট হাউসের তথ্যে এমনকি সৌদিরা কতগুলো এফ-৩৫ অর্ডার করতে পারবে, সেই মৌলিক তথ্যও উল্লেখ করা হয়নি।
মঙ্গলবার ওভাল অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস।
ক্রাউন প্রিন্সের কৌশলগত সাফল্য
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকরা বহু বছর ধরে অধ্যয়ন করবেন ক্রাউন প্রিন্স কীভাবে এই সাফল্য অর্জন করলেন। সামাজিক সংস্কার এবং দেশে কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ—উভয়ের সমন্বয় থাকলেও এই সাফল্য নিশ্চিত ছিল না। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো—তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ম্যানেজ করার মানসিকতা খুব নিখুঁতভাবে বুঝে উঠেছিলেন।
এর প্রথম ইঙ্গিত দেখা যায় ২০১৮ সালে জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পরের সময়ে। খাসোগি একসময় সৌদি সরকারের অংশ ছিলেন এবং পরে ভিন্নমতাবলম্বী ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট হন। তখন মাত্র এক বছর ক্ষমতায় থাকা ট্রাম্প বলেন, হত্যার জন্য কে দায়ী সেটি পরিষ্কার নয়। তবে তিনি বলেন, যদি প্রমাণিত হয় ক্রাউন প্রিন্স দায়ী, তাহলে তাকে দায়ী করা হবে।
কিন্তু এরপর সিআইএ একটি রিপোর্ট দেয়, যেখানে জোর দিয়ে বলা হয় যে ক্রাউন প্রিন্স হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন এবং সম্ভবত অনুমোদনও দিয়েছিলেন। রিপোর্টটি ফাঁস হয়ে যায় এবং ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষুব্ধ হয়। এই রিপোর্ট ফাঁসের পর ক্রাউন প্রিন্সের যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
এরপর আসে মহামারি ও লকডাউন। সৌদি নেতৃত্ব সেই সময় ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক যোগাযোগ এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করতে থাকে। এরপর প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি সফর করেন। তার উপদেষ্টাদের কেউ কেউ মনে করেছিলেন এই সফর জরুরি, কেউ মনে করেছিলেন এটি বড় ভুল। তবে বাইডেনের সঙ্গে ফিস্ট-বাম্পের ঘটনাই দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক পুনরায় সক্রিয় হওয়ার একটি প্রতীক হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসন যখন দায়িত্ব নেয়, তখন প্রকৃত অর্থে ক্রাউন প্রিন্সের সময় এসে গেছে। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হন যখন এবিসির এক সাংবাদিক খাসোগি হত্যায় সিআইএ রিপোর্টের বিষয়ে প্রশ্ন করেন। ট্রাম্প তখন ক্রাউন প্রিন্সকে রক্ষা করেন এবং বলেন খাসোগি ছিলেন ‘অত্যন্ত বিতর্কিত’—যেন এটি হত্যার একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা।
ট্রাম্প তখন আরও বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা ঘটে’—যা সম্ভবত এই সফরের পরও দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকবে।
ক্রাউন প্রিন্স অবশ্য প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি উত্তর দেন, ‘কারও জীবন আইন বহির্ভূতভাবে বা অকারণে হারানো অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’ তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে যেন এমন কিছু আর না ঘটে—সেজন্য তারা তাদের ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে।
চুক্তির বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
সফরে ঘোষিত চুক্তিগুলো দুই নেতা যেভাবে বর্ণনা করেছেন—সেগুলো আসলেই কত বড়—তা নিশ্চিত হতে মাস কিংবা বছর লেগে যেতে পারে। এফ-৩৫ বিক্রি অনুমোদনে কংগ্রেসের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমানে প্রায় ২০টি দেশ বিমানটি ব্যবহার করছে বা অর্ডার দিয়েছে। প্রতিটি বিমানের দাম ৮০ থেকে ১১০ মিলিয়ন ডলার। ফলে সৌদি আরবে এফ-৩৫ পৌঁছাতে সময় লাগবে।
পারমাণবিক রিয়েক্টরের ক্ষেত্রেও একই অনিশ্চয়তা রয়েছে। মার্কিন আইন যথাযথভাবে মানলে সৌদিদের উল্লেখযোগ্য পারমাণবিক সক্ষমতা দেওয়ার যে কোনো চুক্তিতেই কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন। বিশেষ করে সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ কে রাখবে—এই প্রশ্নেই মূল বিরোধ।
অন্যদিকে চিপ ও ডেটা সেন্টারের প্রকল্পগুলো দ্রুত এগোতে পারে এবং এগুলো হবে বাস্তবায়নের প্রথম পরীক্ষামূলক সূচক।
মার্কিন অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে—চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে শুধু ব্যবসা যথেষ্ট নয়। জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার এবং যৌথ মূল্যবোধ—সবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু মঙ্গলবারের আলোচনায় এসব বিষয় খুব সামান্যই উঠে এসেছে।
তবে ট্রাম্প যুগের বাস্তবতা হলো—সম্পর্কগুলো মাপা হয় চুক্তির স্বাক্ষর বা কূটনৈতিক নথিতে নয়, বরং উপহার ও প্রতীকী প্রদর্শনীতে। তাই বৈঠক শেষে দেখা যায় ক্রাউন প্রিন্সের সহকারীরা হোয়াইট হাউস ছাড়ছেন সোনালি ছাপযুক্ত ট্রাম্প-স্বাক্ষরিত উপহারের ব্যাগ নিয়ে।
(নিউ ইয়র্ক টাইমসের হোয়াইট হাউস এবং জাতীয় নিরাপত্তা করসপনডেন্ট ডেভিড ই. স্যাংগারের নিবন্ধ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মাহবুবুল আলম তারেক)