leadT1ad

এক হচ্ছে জমিয়তের দুই অংশ

স্ট্রিম গ্রাফিক

এক হতে যাচ্ছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। বিভক্ত দুই অংশ বিরোধ মিটিয়ে দ্রুতই মিলে যেতে পারে বলে স্ট্রিমকে জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। বিরোধ মেটাতে দুই অংশকে নিয়ে গত মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) রাতে একটি বিশেষ বৈঠক করেছেন বাংলাদেশে সফরে থাকা পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (এফ) সভাপতি ও দেশটির সাবেক মন্ত্রী মাওলানা ফজলুর রহমান। জানা গেছে, বৈঠকে এক হওয়ার ব্যাপারে পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে উভয় অংশ।

নির্বাচন কমিশনে (ইসি) রাজনৈতিক দল জমিয়তের নিবন্ধন নং ২৩। দলটি এখন দুইভাগে বিভক্ত। জমিয়তের নিবন্ধিত অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন দলের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ও মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। দলটির অন্য অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন সভাপতি হিসেবে আবদুর রহিম ইসলামাবাদী ও মহাসচিব গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরাম।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দলটিতে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। ওই সময় দলের সভাপতি ছিলেন আব্দুল মোমিন ইমামবাড়ি আর মহাসচিব ছিলেন নূর হুসাইন কাসেমী। তাঁরা তিনবারের সংসদ সদস্য ও দুইবারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।

পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বহিষ্কারের একদিন পরেই ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারিতে মুফতি ওয়াক্কাস একই নামে ১২১ সদস্য বিশিষ্ট জমিয়তের আরেকটি কমিটি গঠন করেন। বিভক্ত জমিয়তের একাংশের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। ২০২১ সালে মুফতি ওয়াক্কাস মারা যান।

অন্যদিকে আব্দুল মোমিন ইমামবাড়ির মৃত্যুর পর নিবন্ধিত অংশের সভাপতির দায়িত্বে আসেন শায়খ জিয়া উদ্দিন, আর নূর হুসাইন কাসেমীর মৃত্যুর পর মহাসচিব পদে আসেন মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। ২০২৫ সালের ২৬ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে দলটির কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি জিয়া উদ্দিন বার্ধক্যজনিত কারণ দেখিয়ে দলের সভাপতির পদ থেকে সরে গেলে দায়িত্বে আসেন উবায়দুল্লাহ ফারুক। আর মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী পুনরায় মহাসচিব নির্বাচিত হন।

বিএনপির জোটসঙ্গী জমিয়ত

দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক ব্যানারে লড়ার ব্যাপারে আশাবাদী জমিয়ত। দলটির দুটি অংশই বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে চায়য়। ইতিমধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে অনেক দূর আলাপ এগিয়ে নিয়েছে দলটি। দুই অংশ এক হয়ে গেলে নির্বাচনে দলটি বড় প্রভাবক হতে পারবে বলেও মনে করেন নেতারা।

অবিভক্ত জমিয়ত ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে। ওই নির্বাচনে দলটি দুটি আসনে জয়ী হয়। সর্বশেষ দলটি ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে চারটি আসনে ছাড় পেয়েছিল। পরবর্তীতে ২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে জমিয়তের নেতারা বেশ চাপে পড়েন। আওয়ামী লীগ সরকার দলটির অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় দলের একাংশ।

চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনের পরে কওমিধারার দলগুলোকে নিয়ে স্বতন্ত্র জোটের আলোচনায় শামিল হয় জমিয়ত। কিন্তু একই ধারার অন্যদলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠতা বাড়লে জমিয়ত আবারও বিএনপির বলয়ে যোগ দেয়। দলটির দুটি অংশই সমানভাবে জোটবদ্ধ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জমিয়ত ও বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জমিয়তের উভয় অংশকে সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে দিতে রাজি বিএনপি। যদিও জমিয়তের একাংশ জানিয়েছে, তাঁরা নিজেদের ‘এ ক্যাটাগরির’ ১২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন চায়।

জমিয়তের একাধিক নেতা স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির আলোচনা এবং ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে সভাসমাবেশে দুটি অংশের নেতারাই একসঙ্গে অংশ নিচ্ছেন। যদিও এখনো দুই অংশই পৃথকভাবে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দুটি অংশ এক হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। মাওলানা ফজলুর রহমানের উদ্যোগের পরে এই সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে গেছে।

এক হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল

জমিয়তের নিবন্ধিত অংশের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক গত রোববার স্ট্রিমকে বলেন, ‘মুফতি ওয়াক্কাস সাহেবের ইন্তেকালের পরে জমিয়তের ওই অংশের বরিশাল ও সিলেট বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরামসহ একটা অংশ এখনো বাকি আছে। এক হওয়ার কথাবার্তা চলতেছে। দেখি, কী করা যায়।’

মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, ‘আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোনো অসুবিধা হয় নাই। কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে কয়েকজন নেতার সঙ্গে। তবে উনারা যদি আমাদের সঙ্গে আসতে চান, আমরা ওয়েলকাম জানাবো। সবাই চলে আসছে আমাদের সঙ্গে, কয়েকজন রয়েছেন শুধু।’

দলটির অন্য অংশের নেতৃত্বে সভাপতি হিসেবে রয়েছেন আবদুর রহিম ইসলামাবাদী আর মহাসচিব হিসেবে রয়েছেন গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরাম। উভয় অংশের নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ সব সময়ই ছিল বলে জানিয়েছেন গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরামও। স্ট্রিমকে তিনি বলেন, ‘কিছু অযাচিত বিষয়ের কারণে সংগঠনে বিভক্তিটা আসে। তবে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখনও খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ।’ স্ট্রিমকে তিনি জানান, তাঁরাও এক হওয়ার কথা ভাবছেন।

পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগ

গতকাল মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের হারমনি হলে সুধী সমাবেশের আয়োজন করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (এফ) সভাপতি ও দেশটির সাবেক মন্ত্রী মাওলানা ফজলুর রহমান।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুকের সভাপতিত্বে ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে আরও ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের মহাসচিব মাওলানা আবদুল গফুর হায়দারী ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নেপালের সহসভাপতি মাওলানা শফিকুর রহমান কাসেমী। এ সমাবেশে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারাও আমন্ত্রিত ছিলেন।

সমাবেশের পরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রেই জমিয়তের উভয় অংশকে নিয়ে একটি বিশেষ বৈঠক করেন পাকিস্তানের জমিয়তের প্রধান। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, ওই বৈঠকে বিভক্ত জমিয়তের দুই অংশকে এক হওয়ার সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন মাওলানা ফজলুর রহমান। তাঁর নির্দেশনা মানার ব্যাপারে বৈঠকে উভয় পক্ষ একমতও হয়।

মাওলানা ফজলুর রহমান গত ১১ নভেম্বর রাতে এক সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে আসেন। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান জমিয়তের উভয় অংশের শীর্ষ নেতারা।

বাংলাদেশে থাকাবস্থায় মাওলানা ফজলুর রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উভয় অংশের জমিয়ত নেতারা ছিলেন। একটি সূত্র জানিয়েছে, চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের গত মঙ্গলবারের বিশেষ বৈঠকের আগে বিভিন্ন সময় হোটেলে অবস্থানকালে ফজলুর রহমান একাধিকবার উভয় অংশের নেতাদের এক হওয়া নিয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। দুই অংশের নেতাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠকও করেছেন তিনি।

বৈঠকের ব্যাপারে জানতে চাইলে গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘পাকিস্তানের সদর (জমিয়ত সভাপতি) আমাদের মুরব্বি। উনি এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছেন। দুই পক্ষই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন, দুই পক্ষই এক হতে চায়। তবে প্রক্রিয়া কী হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’

তফসিলের আগেই জোড়া লাগার সম্ভাবনা

উভয় অংশের নেতারা বলেছেন, অনেকদিন ধরেই তাঁদের এক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। মাওলানা ফজলুর রহমানের উদ্যোগ নেওয়ার পরে এক হওয়ার পাকাপাকি সিদ্ধান্ত হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার। তবে এক হওয়ার প্রক্রিয়া এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। নেতারা বলছেন, দুই অংশেরই পৃথক সাংগঠনিক কাঠামো থাকায় কমিটি পুনর্গঠন, উভয় অংশের নেতাদের উপযুক্ত পদ দেওয়া ও দায়িত্ব বণ্টন একটি সময় সাপেক্ষ বিষয়। তাঁরা মনে করেন, এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগতে পারে।

সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় ঐক্যের সুবিধা পেতে তফসিলের আগেই এক হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং সংগঠন পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেও উভয় অংশের নেতারা স্ট্রিমকে নিশ্চিত করেছেন।

একাংশের মহাসচিব গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরাম স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমাদের সারা দেশে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে, তাঁদেরও (অপর অংশেরও) পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে, আমাদের অঙ্গসংগঠন আছে, তাঁদেরও অঙ্গসংগঠন আছে, যদিও তাঁদের অঙ্গসংগঠন ও কমিটির ম্যাক্সিমাম (বেশিরভাগ) সদস্য আমার হাতে বানানো, তারপরেও যেহেতু পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে—এগুলো তো ব্যালেন্স করতে হবে। সমন্বয় করাটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমার মতে, এগুলা যে রাতারাতি হয়ে যাবে এমন বিষয় না।’

তবে তফসিল ঘোষণার আগেই এক হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ব্যাপারে আশাবাদী গোলাম মুহিউদ্দীন ইকরাম।

Ad 300x250

সম্পর্কিত