চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানাধীন শুলকবহর এলাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী তফাজ্জল আলী ওয়াকফ এস্টেট ঘিরে দুটি পরিবারের বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ওয়াকফ সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে একপক্ষ দাবি করছে, তাঁরা যথাযথ অনুমোদন ও ওয়াকফ প্রশাসনের সুপারিশ অনুযায়ী এস্টেটের দায়িত্বে গ্রহণ করতে চান। অন্যপক্ষের অভিযোগ—প্রভাব ও প্রতারণার আশ্রয়ে সম্পত্তি দখলের ষড়যন্ত্র চলছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওয়াকফ এস্টেটের মোট সম্পত্তি ২৬ একর। যার মধ্যে ৭ একর খাস দখলি এবং বাকিটা প্রজাবিলি। এস্টেটের অধীনে রয়েছে জান মুহাম্মদ চাকলাদার জামে মসজিদ ও মনু মিয়া জামে মসজিদ নামে দুটি মসজিদ। এছাড়াও রয়েছে অর্ধ শতাধিক দোকান, বেশ কিছু ভাড়া ঘর, গ্যারেজ, পুকুর ও খালি জমি; যার আনুমানিক মূল্য শত কোটি টাকা।
ওয়াকফ দলিলে উল্লেখ আছে, এটি ‘আওলাদে ওয়াকফ’, অর্থাৎ তফাজ্জল আলী চৌধুরীর বংশধরেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ এস্টেটের মোতাওয়াল্লী (পরিচালক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রথম মোতাওয়াল্লী ছিলেন তফাজ্জল আলী চৌধুরী নিজে।
হযরত তফাজ্জল আলী চৌধুরীর বাড়ি। স্ট্রিম ছবিমোতাওয়াল্লী কী?
ইসলামী আইনে মোতাওয়াল্লী হলেন ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক বা ব্যবস্থাপক। তাঁর ওপর সম্পত্তির মালিকানা ন্যস্ত নয়, বরং তিনি ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ ও আয়-ব্যয়ের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন।
ওয়াকফ এস্টেট ঘিরে পারিবারিক বিরোধ
ওয়াকফ এস্টেট নিয়ে পারিবারিক বিরোধ শুরু হয় ২০১৩ সালে। ২০১৩ সাল থেকে এস্টেটের মোতাওয়াল্লী ছিলেন স্থানীয় আব্বাস উদ্দীন চৌধুরী। তাঁকে অপসারণ চেয়ে ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন স্থানীয় মো. ইউনূস চৌধুরী। সেই রিটের এখনো সুরাহা হয়নি। এরই মধ্যে এস্টেটের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ‘দেউলিয়ার হাত থেকে রক্ষা’র কথাও উঠে এসেছে। তবে দলিল ও ব্যবস্থাপনার ইতিহাস থেকে জানা যায়, তফাজ্জল আলী ওয়াকফ এস্টেট কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দেউলিয়া হয়নি; বরং কিছু সময় আর্থিক সংকট ও অনিয়মের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছিল, যা পরবর্তীতে মো. আব্বাস উদ্দীনের নেতৃত্বে পুনরুদ্ধার হয় বলে স্ট্রিমকে জানিয়েছেন তাঁর মেয়ে এডভোকেট সেলিনা চৌধুরী।
তফাজ্জল আলী ওয়াকফ এস্টেটের একটি মসজিদ। স্ট্রিম ছবিনজরুল ইসলামের দাবি
অভিযোগ আছে বর্তমানে ওয়াকফ এস্টেটটি দখলের চেষ্টা করছেন রিটকারী মো. ইউনূস চৌধুরীর ছেলে নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি কোনো অবৈধ পথে যাব না। নাহিদ ইসলাম ও হাসনাত আবদুল্লাহর আমার জন্য সুপারিশে করেছেন। সব কিছুই ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমোদন অনুযায়ী সম্পন্ন করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, এস্টেটের আর্থিক অনিয়ম বন্ধ করতে এবং সম্পত্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘বছরের পর বছর এই এস্টেট অব্যবস্থাপনায় ভুগছিল। আমার নামে এখন মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। যা একদমই ভিত্তিহীন।’
তফাজ্জল আলী ওয়াকফ এস্টেটের জমি। স্ট্রিম ছবিজাল স্বাক্ষর ও প্রতারণার অভিযোগ
বিষয়টি নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)–র পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। দলের যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্ট্রিমকে বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি আমাদের পার্টির প্যাড ও স্বাক্ষর জাল করে একটি মিথ্যা সুপারিশপত্র তৈরি করেছেন। এতে নাহিদ ইসলাম ও হাসনাত আব্দুল্লাহর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা এটি প্রতারণা হিসেবে দেখছি এবং এর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
এ বিষয়ে নাহিদ ইসলাম ও হাসনাত আব্দুল্লাহর মন্তব্য জানতে ফোন করা হলেও সাড়া মেলেনি।
তফাজ্জল আলী ওয়াকফ এস্টেটের আরেকটি মসজিদ। স্ট্রিম ছবি‘ষড়যন্ত্র করে দখলের চেষ্টা চলছে’
পূর্বের মতোয়াল্লী মো. আব্বাছ উদ্দিন চৌধুরীর পরিবার বলছে, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে তফাজ্জল আলী ওয়াকফ এস্টেটের বৈধ দায়িত্বে ছিলেন। আব্বাছ উদ্দিন চৌধুরীর মেয়ে অ্যাডভোকেট সেলিনা আক্তার ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিগত ১৪ বছর ধরে আমার বাবা ওয়াকফ এস্টেটকে দেউলিয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু এখন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও তাঁর সহযোগীরা জাল নথি তৈরি করে দখল নেওয়ার চেষ্টা করছেন।’
সেলিনা আক্তারের ভাষায়, ‘আমাদের পরিবার এই সম্পত্তির দেখভাল করেছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও দায়বদ্ধতা থেকে। এখন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে এই এস্টেটটি দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এর পেছনে কিছু রাজনৈতিক যোগসূত্রও রয়েছে বলে আমাদের ধারণা।’
আব্বাছ উদ্দিন চৌধুরীর কার্যালয়। স্ট্রিম ছবিস্থানীয়দের উদ্বেগ ও প্রশাসনের নীরবতা
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তফাজ্জল আলী ওয়াকফ এস্টেটের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকেই তোফাজ্জল আলী চৌধুরীর বংশধরদের পারিবারিক বিরোধের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে ওয়াকফ এস্টেট। স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন, এই এস্টেটের ধর্মীয় কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।
আরও জানা যায়, ওয়াকফ এস্টেটের জায়গা নিয়ে এমন টানাটানি তাঁরা আগে দেখেনি। দুই পক্ষের লড়াইয়ে ধর্মীয় সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রশাসন এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে বড় সংঘাত হতে পারে।
পাঁচলাইশ থানার ওসি মো. সোলাইমান ফোনে স্ট্রিমকে জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তবে জানার চেষ্টা করছেন।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন এম ইসলাম