শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন পুনর্বিবেচনা করতে আবেদন করতে যাচ্ছে আমজনতার দল। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আমজনতার দলের সদস্য সচিব কিছুটা সুস্থ অবস্থায় এলেই, এই সপ্তাহে নির্বাচন কমিশনে পুনর্বিবেচনার আবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতি কর্ণেল (অব) মিয়া মশিউজ্জামান। আজ সোমবার (১০ নভেম্বর) দলীয়ভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আমজনতার দলের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন না পাওয়ায় ইসির মূল ফটকের সামনে দলের সদস্যসচিব তারেক রহমানের শুরু করা আমরণ অনশন ৪ নভেম্বর বিকেল ৪টা থেকে গতকাল (রোববার) রাত পর্যন্ত চলে। অনশন শুরুর ১৩৫ ঘণ্টা শেষে গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে গুরুতর অসুস্থ তারেক রহমানকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নেওয়া হয়।
সেখানেই তিনি রাত সাড়ে নয়টার দিকে ডাবের পানি খেয়ে অনশন ভঙেন। তাঁর দলের নেতারা বলছেন, এখন পর্যন্ত সকল পরীক্ষা শেষ না হওয়ায় তারেকের শারীরিক অবস্থা কী, তা পুরোপুরি বলা এখনই সম্ভব না। সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হতে আগামীকাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
এর আগে আমজনতার দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দর অনুরোধে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ তারেক রহমানকে বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠান।
এ বিষয়ে কর্ণেল (অব) মিয়া মশিউজ্জামান স্ট্রিমকে বলেন, আমরা অনেক বুঝিয়েও তাঁকে অনশন ভাঙতে রাজি করাতে পারছিলাম না। শেষে আমরা বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে অনুরোধ করি অনশন ভাঙানোর জন্য। তিনি এসে তারেক রহমানকে বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠান।
এরমধ্যেই নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের সামনে পরোক্ষভাবে আমজনতার দলকে নিবন্ধন ‘পুনঃবিবেচনার জন্য আবেদন’ করার পরামর্শ দেন সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল রাতেই আমজনতার দল পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করবে জানালেও মশিউজ্জামান দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান। যা তারা আজকে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ২০ এপ্রিল আমজনতার দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। এবার ২০২৫ সালে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২২ জুনের মধ্যে ১৪৫টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। কোনদলই সঠিক কাগজপত্র জমা না দেয়ায়, সব আবেদন যাচাই-বাছাই করে ঘাটতি পূরণের জন্য ১৫ দিন সময় দিয়ে দলগুলোকে চিঠি দেয় ইসি সচিবালয়, যা ৩রা আগস্ট ২০২৫ সমাপ্ত হয়।
এর পরে মাঠ পর্যায়ের তদন্ত কর্মকর্তাগণ কর্তৃক প্রেরিত তদন্ত প্রতিবেদন ও অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের তথ্য সঠিক পেলেও, সরবরাহকৃত ২২ টি জেলার মধ্যে দুইটি জেলায় সঠিক ও কার্যকর অফিস থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। ছাড়াও ১০০টি উপজেলা বা অফিসের মধ্যে ৬৭টি অফিস ও ২০০ জন ভোটার সদস্য থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তাই, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ৯০ (ক) ও ৯০খ(১) (ক) (ই) এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ৬(ঞ) (ই) মোতাবেক দলের আবেদন না-মঞ্জুরপূর্বক নিষ্পত্তি করে নির্বাচন কমিশন।
প্রবর্তীতে গত ৪ নভেম্বর তিনটি রাজনৈতিক দল– বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কবাসী), বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। সেদিন বিকেলে এই ব্যাপারে কমিশন নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে, যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেউ আপত্তি জানাতে পারে।
এই গণবিজ্ঞপ্তির পরেই মুলত অনশনে বসেন তারেক রহমান।
‘স্বচ্ছতা থাকলে জটিলতা তৈরি হতো না’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে নির্বাচন কমিশন ও আদালত ছাড়া অন্য কোনো স্বাধীন বা সমান্তরাল আইনি প্রক্রিয়া নেই। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অথবা রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন অনুযায়ী দলকে ইসির কাছেই আবেদন করতে হয়। সংক্ষুব্ধ হলে বা আইনি ব্যাখ্যা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তবেই বিচারিক পর্যালোচনার জন্য হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগের দুয়ার খোলে।
ইসি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে মন্তব্যে রাজি হননি। তবে নির্বাচন পরিচালনা অনুবিভাগের কর্মকর্তারা জানান— আইনসিদ্ধ পথ হচ্ছে আরপিও অনুযায়ী কমিশন থেকেই নিবন্ধন পাওয়া এবং সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে বিচার চাইবার সুযোগ রয়েছে।
এ পর্যন্ত ১৪টি দল আদালতের আদেশে নিবন্ধন পেয়েছে বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে। দলগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বাংলাদেশ কংগ্রেস, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি, আমার বাংলাদেশ পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি।
সবচেয়ে বেশি নিবন্ধন আদেশ এসেছে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর।
তারেক রহমানের অনশন চলমান অবস্থায় গতকাল রোববার মন্তব্য করতে রাজী হননি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। তবে নির্বাচন পরিচালনা অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত আইনসিদ্ধ পদ্ধতি হলো আরপিও এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন থেকে এবং সংক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালত থেকে রায়ের মাধ্যমে নিবন্ধন নিতে পারে।
তারা বলছেন, আরপিওতে বেঁধে দেয়া মানদন্ডে উৎরাতে না পারলেও অনেক দলের এভাবে হাইকোর্ট থেকে নিবন্ধন আদেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে আসছে। তাই, এমনকি আদালতের আদেশে নিবন্ধনের প্রবণতা কমানোর প্রচেষ্টা হিসেবে আবেদন বাতিলের কারণ উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে কমিশন, যা আগে অনুসরণ করা হতো না।
এর সাথে যদি এমন কর্মসুচীর ফলে নিবন্ধন দিতে হয় তবে তা নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করবে বলে বলছেন তারা।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলি বলেন, ‘কমিশন যদি সত্যিই বিড়ম্বনায় পড়েন, তবে তা প্রকাশ করেই আইনসিদ্ধ পথে এগুতে হবে। স্বচ্ছতা না থাকলে বিভ্রান্তি বাড়বে।’
ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়ায় না গিয়ে অনশন করা দলটির দুর্বলতা প্রকাশ করে। যদি কাগজপত্র ঠিক থাকে তাহলে আদালতে যাওয়ার পথ খোলা আছে। অনশন তো এক ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং। জনপ্রিয়তা ‘‘প্রমাণ’’ করে রাজনৈতিক রেজিস্ট্রেশন আদায় হয় না।’
তিনি মনে করেন, যে আইন আছে, যদি তা কঠোরভাবে ফলো করা হতো, তবে সাম্প্রতিক সময়ে নিবন্ধন পাওয়া বেশীর ভাগ রাজনৈতিকদলই বাদ যেত। নিবন্ধনে স্বচ্ছতা থাকলে এমন জটিলতা তৈরি হতো না বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি।