ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস যখন বিদায় নেন, তখন ছিল জুলাই বিপ্লবের এক উত্তাল সময়। তার প্রায় ১৭ মাস পর নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেনকে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে সম্মতি মিললেই দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় ফিরবেন তিনি। এর আগে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। এখন তিনি এমন এক সময়ে আবার ঢাকায় আসতে যাচ্ছেন, যখন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে ক্রমেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র আর দেড় দশকেরও বেশি সময় পরে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেনকে মনোনীত করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশটির নিয়ম অনুযায়ী, এই মনোনয়ন অনুমোদনের জন্য সিনেটে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে সিনেট অনুমোদন দিলে নতুন রাষ্ট্রদূতের নিয়োগ চূড়ান্ত হবে। গেল ২৩ অক্টোবর তার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ৪ নভেম্বরের এক লেখায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) শিক্ষক গাদ্দে ওমপ্রসাদ বলেন, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি জো বাইডেন প্রশাসনের ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বৃহত্তর ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের অংশ।
‘পরবর্তী বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও গভীর করতে যুক্তরাষ্ট্র–বাংলাদেশ পার্টনারশিপ ডায়ালগ এবং সিকিউরিটি ডায়ালগ হয়েছে। এসব সংলাপে সামুদ্রিক নিরাপত্তা, বাণিজ্য, শাসনব্যবস্থা, ইন্দো–প্যাসিফিক সহযোগিতা এবং বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত প্রবেশাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
ওই লেখায় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে সামুদ্রিক নজরদারি, দুর্যোগ মোকাবিলা এবং সামরিক মহড়ায় যুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে রয়েছে আগস্টে অনুষ্ঠিত ‘টাইগার শার্ক’ মহড়া। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের ফ্যাক্টশিটে বাংলাদেশকে তার ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেনও সিনেটের শুনানিতে বলেন, চীনের প্রভাব কমাতে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। এছাড়া বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
কে এই ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন?
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, মার্কিন সিনিয়র ফরেন সার্ভিসের (এসএফএস) ক্যারিয়ার মেম্বার বা স্থায়ী সদস্য তিনি। ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন ‘ক্লাস অব কাউন্সেলর’ শ্রেণির কূটনীতিক, যা মার্কিন ফরেন সার্ভিসের শীর্ষ চারটি স্তরের একটি। এ ধরনের কূটনীতিকরা খুবই অভিজ্ঞ হন। গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়ন করতে পারেন তারা। তাদের হাতে প্রশাসনিক নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনাগত কর্তৃত্ব থাকে। একক ও নির্দিষ্ট দায়িত্বের মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ না থেকে বরং দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন উচ্চপদস্থ দায়িত্ব পালন করতে পারেন ওয়ান–স্টার পদমর্যাদার এই কূটনীতিকরা।
বাংলাদেশকেন্দ্রিক মার্কিন নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ২০ বছরেরও বেশি সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেনের। বর্তমানে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
মার্কিন পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দ্য সিনিয়র ফরেন সার্ভিসের স্থায়ী সদস্য ভার্জেনিয়ার ব্রেন্ট ক্রিসটেনসনকে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাম্বাসেডর এক্সট্রার্ডিনারি অ্যান্ড প্লেনিপোটেনশিয়ারি হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। এখানে এক্সট্রার্ডিনারি বলতে রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য বিশেষ অনুমোদন প্রদানকে বোঝায়। আর প্লেনিপোটেনশিয়ারি অর্থ হলো ‘পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন’—অর্থাৎ রাষ্ট্রদূতের নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রয়েছে।
ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকবিষয়ক কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে তাকে দ্বিতীয়বারের মতো পাঠানোর অর্থ হচ্ছে, তিনি প্রেসিডেন্টের খুবই ঘনিষ্ঠ।
সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক শুনানিতে ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন বলেন, একটি উজ্জ্বল ও গণতান্ত্রিক যাত্রায় বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন নিশ্চিত হলে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও আগামীতে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক তৈরি করতে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের নেতৃত্ব দেবেন।
২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডারের বৈদেশিক নীতি উপদেষ্টা ছিলেন এই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক। সেখানে বৈশ্বিক কৌশলগত প্রতিরোধ মিশনের আন্তর্জাতিক প্রভাব নিয়ে পরামর্শ দিতেন তিনি।
মার্কিন ফরেন সার্ভিসে তার দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ার। দেশ ও দেশের বাইরে বড় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক–সামরিক বিষয়ক ব্যুরোর আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অস্ত্র স্থানান্তর কার্যালয়ের উপপরিচালক, উত্তর কোরিয়া নীতির জন্য বিশেষ প্রতিনিধির বিশেষ সহকারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরবিষয়ক উপকমিটির পিয়ারসন ফেলো।
তিনি ম্যানিলা, সান সালভাদর, রিয়াদ ও হো চি মিন সিটির যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসগুলোতেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের এই ডিস্টিংগুইশড গ্র্যাজুয়েট ২০২২ সালে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (মাস্টার অব সায়েন্স) সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং রাইস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন।
স্প্যানিশ, জার্মান ও ভিয়েতনামি ভাষায় কথা বলতে পারেন এবং ফরাসি, জাপানি ও পর্তুগিজ ভাষা অধ্যয়ন করেছেন এই মার্কিন কূটনীতিক। ২০০২ সালে ফরেন সার্ভিসে যোগদানের আগে তিনি হিউস্টন ও নিউইয়র্কে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পিটার হাসের দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রদূত নেই। তখন থেকে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার দায়িত্ব পালন করছেন।
কেন বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত করা হচ্ছে তাঁকে
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি বাস্তবায়নে ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেনকে যোগ্য মনে করা হচ্ছে বলেই তাঁকে এখানে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, যেহেতু মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও তাঁকে ভালোমতো চেনেন, সেই হিসেবে নিশ্চয়ই ট্রাম্পও তাঁকে ভালোভাবে চেনেন। বাংলাদেশ একটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা আশা রাখছে, বাংলাদেশে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা ও রিপাবলিকান পার্টির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবেন ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন। সেই আস্থা আছে বলেই অনেকটা সময় নিয়ে তাঁকে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, এবার তারা অনেক সময় নিয়ে একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিচ্ছেন। একজনকে যদিও দিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ট্রাম্প তাঁকে রাষ্ট্রদূত করেননি। তার মানে, রিপাবলিকান পার্টি বা রুবিও এমন একজনকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন, যাতে দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ নিয়ে তাদের যে চিন্তাভাবনা আছে, তিনি তা বাস্তবায়ন করতে পারেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘সিনেটে শুনানির সময় তিনি যা বলেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে এই কূটনীতিক কী করতে যাচ্ছেন। আপনারা জানেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে তিনি ভালো করে দেখতে চাইবেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন তারা দেখতে চাচ্ছেন। কাজেই রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যেই জানা যাবে যে তিনি আসলে কী করতে চাচ্ছেন।’
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ নয়। আগামী নির্বাচনে কারা সরকার গঠন করবে, তার ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, যুক্তরাষ্ট্রকে খেপিয়ে আমরা কিছু করতে পারব কি না—সেই প্রশ্নটি অনেক বড়। তবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি যে পথে চলছে, তাতে মনে হয় না আমেরিকা আমাদের ওপর চাপাচাপি করবে।
চীনা পদক্ষেপ মোকাবিলায় পরিকল্পনা
সিনেটের শুনানিতে বাংলাদেশের ওপর চীনের প্রভাব কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। ‘কমিউনিস্ট চীনের’ সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন নেব্রাস্কার সিনেটর পেট রিকেটস।
প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও কমিউনিস্ট চীনের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা ক্রমে বাড়ছে। সম্প্রতি কমিউনিস্ট চীন একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি সাবমেরিন ঘাঁটি সংস্কার করেছে, যাতে যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন দুটোই রাখা যায়।
‘আর এই মাসেই খবর এসেছে যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ ২০টি চীনা নির্মিত জে-১০ যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে। তারা নতুন সারফেস–টু–এয়ার মিসাইল এবং দূরপাল্লার রাডারও সংগ্রহ করবে। এর মাধ্যমে তারা চীনা প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে আর্থিক ও কৌশলগতভাবে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপন করছে,’ যোগ করেন ওই সিনেটর।
চীনের ওপর এই নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে কীভাবে কাজ করবেন, সেই প্রশ্ন করেন পেট রিকেটস। জবাবে ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব নিয়ে আপনার উদ্বেগের সঙ্গে আমি একমত। আমার মনোনয়ন নিশ্চিত হলে বাংলাদেশের সরকার ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলব—চীনের কর্মতৎপরতা, তাদের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা, তাদের সামুদ্রিক এলাকায় কার্যক্রম ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় চীনের ভূমিকার ঝুঁকি স্পষ্টভাবে তুলে ধরব। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্বের সুযোগ ও সুফলগুলোও তুলে ধরব, বিশেষ করে আমাদের দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে আরও নিবিড় সহযোগিতার বিষয়টি।
‘থিংক টোয়াইস অ্যাক্ট’-এর কথা উল্লেখ করে তাঁকে পেট রিকেটস প্রশ্ন করেন যে যুক্তরাষ্ট্র কী কী বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারে বাংলাদেশকে। চীনা সামরিক সংস্থাগুলোর অস্ত্র রপ্তানি প্রতিরোধ ও তাদের শিল্প নেটওয়ার্ক শনাক্তকরণের আইনকে ‘থিংক টোয়াইস অ্যাক্ট’ বলা হয়। চীন থেকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অস্ত্র রপ্তানি প্রতিরোধেই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
ক্রিসটেনসেন বলেন, আমাদের মার্কিন সামরিক সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে মিত্রদেশগুলোর জন্য তৈরি এমন কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুলে ধরতে পারি, যা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হতে পারে, যারা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি প্রিমিয়াম অস্ত্রসামগ্রী কিনতে পারে না। পাশাপাশি আমরা যৌথ সামরিক মহড়ার মাধ্যমে এসব প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তাদের আন্তঃকার্যক্ষমতা বাড়াতে পারি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ স্ট্রিমকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কোন দেশের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক করবে, সেটা বাংলাদেশের এখতিয়ার। বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা সেটা ঠিক করবেন। বিদেশনীতিতে জাতীয় স্বার্থই একমাত্র বিবেচ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে—এটা অস্বাভাবিক নয়। অন্য পরাশক্তিরাও সেরকম করবে, করছেও। প্রধান ও বিবেচনার বিষয় হলো বাংলাদেশ কীভাবে দেখে বিষয়টা, কী করবে এ বিষয়ে? বাংলাদেশের এসব বিষয়ে যেকোনো অগ্রহণযোগ্য চাপ অগ্রাহ্য করা ভালো হবে।’
বাংলাদেশ আরও মনোযোগ দাবি রাখে
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার কথা থাকলেও সেটা পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন। তিনি গত ২৩ অক্টোবর সিনেটের শুনানিতে বলেন, বাংলাদেশকে প্রায়ই ‘এশিয়ার বাঘ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেটা দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেই তুলে ধরে।
বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করায় নিজেকে ‘সম্মানিত’ বোধ করার কথা জানিয়েছেন তিনি। তার প্রতি আস্থা রাখায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এই কূটনীতিক।
এ সময়ে বৃহৎ প্রতিবেশীদের কারণে বিশ্বের অষ্টম জনসংখ্যাবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও যে মনোযোগটা দাবি রাখে বাংলাদেশ, সেটা পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন। কৌশলগত অবস্থানের কারণে একটি উন্মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভারত–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আমলে যতখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেটায় একটা ভাটা পড়েছে বর্তমানে। ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা যুদ্ধসহ বড় বড় আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, সেখানে বাংলাদেশ আর কতটা গুরুত্ব পাবে!’
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্বটা যাতে বাড়ে, সেই দিকেই নজর দিতে চেয়েছেন এই মার্কিন কূটনীতিক। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কটা যদি আমেরিকার দিক থেকে দেখা হয়, তাহলে সেটা বড় ধরনের সম্পর্ক না। কিন্তু আমাদের দিক থেকে সম্পর্কটা বড়, কারণ এখান থেকে অনেক বেশি রপ্তানি হয়। সেই তুলনায় আমেরিকা থেকে আমরা ততটা আমদানি করি না। কিন্তু তারা চাচ্ছেন, আমরা যেন তাদের কাছ থেকে আমদানি বাড়িয়ে দিই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘কথার মধ্যে অনেক কিছু থাকে। কিন্তু গুরুত্ব দিতে হবে বাণিজ্যটা কত বড়, সেই দিকে। কারণ রাজনীতির কারণে অনেক কিছু বলা হয়। সবকিছু ছাপিয়ে দেখতে হবে, কোন দেশের বাজার কত বড়।’
গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ
২৩ অক্টোবরের ওই শুনানিতে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে উল্লেখ করে ব্রেন্ট ক্রিসটেনসেন বলেন, গেল ১৫ বছর ধরে যারা ক্ষমতায় ছিল, জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।
এই সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের অগ্রগতিও তুলে ধরেন এই কূটনীতিক। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও মানবিক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মার্কিন বাণিজ্য এগিয়ে নিতে কাজ করব। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য বাধা দূর করব, পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করব।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের জন্য এই কাজ নিজ চোখে দেখেছি এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল যোগানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা প্রচেষ্টা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। আমাদের ওপর চাপ কমাতে আরও দেশের অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
‘এ ছাড়া সহায়তা কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য জাতিসংঘ ও অন্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে একই ধরনের কাজ না হয় এবং আরও কার্যকরভাবে সহায়তা পৌঁছানো যায়,’ যোগ করেন এই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক।
রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ অনুমোদন হলে এই সংকটের একটি টেকসই ও কার্যকর সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোহিঙ্গা সংকটকে বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন উল্লেখ করে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘মিয়ানমারের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের তেমন প্রভাব নেই। তারা মিয়ানমারকে বাধাও দিতে পারবে না, সম্মতও করাতে পারবে না।’
‘রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে সবচেয়ে কার্যকর হবে বাংলাদেশের নিজস্ব পদক্ষেপ। পাশাপাশি, ভারত ও চীনকে নিয়ে যদি বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বসতে পারে, তাহলে এই সংকটের সমাধান সহজ হতো। এখানে জাতিসংঘ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন কিছু করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিলে ফল বিপরীত হতে পারে। বরং চীনের পদক্ষেপ বেশি কার্যকর হবে। চীন–ভারতকে বাদ দিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সম্ভব নয়,’ যোগ করেন তিনি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য মোট ৮৫২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজনের বিপরীতে গত বছর বিদেশি দাতারা ৫৪৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিলেন, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান ছিল ৩০১ মিলিয়ন ডলার—অর্থাৎ মোট সহায়তার ৫৫ শতাংশ।
ক্রিসটেনসেনের মনোনয়ন এমন এক সময়ে এসেছে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতিতে সব ধরনের আমদানির ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি, চলতি বছর জারি করা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দেশভিত্তিক পাল্টা শুল্কও কার্যকর করা হয়েছে।
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক কমানোর চেষ্টায় ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা। শুরুতে এই শুল্কহার ছিল ৩৭ শতাংশ। গত আগস্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটে, যখন তা কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হয়।
এই আলোচনাগুলো পারস্পরিক সমঝোতার অংশ হিসেবে এগোচ্ছে—যেখানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কৃষিপণ্য থেকে শুরু করে শিল্প কাঁচামাল পর্যন্ত আরও বেশি পণ্য কেনার বিষয়ে সম্মত হয়েছে, যাতে দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়।
একই সঙ্গে, শুল্কহার আরও কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ বজায় রাখার উদ্যোগ নিয়েছে।