অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত জুলাই মাসে ‘জাতীয় বেতন কমিশন ২০২৫’ গঠন করে। এর লক্ষ্য ছিল ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও ভালো বেতনের দাবির প্রেক্ষিতে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর বেতন কাঠামো পুনর্গঠন করা। এটি স্বাধীনতার পর অষ্টম বেতন কমিশন; সর্বশেষ কমিশন গঠিত হয়েছিল ২০১৫ সালে।
তবে গতকাল রবিবার (৯ নভেম্বর) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা দেন যে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার। আসন্ন নির্বাচনের আগে বড় আর্থিক সিদ্ধান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বেতন কমিশন কী ও এর কাজ কীভাবে চলে
জাতীয় বেতন কমিশন একটি উচ্চপর্যায়ের পরামর্শক সংস্থা। এটি সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি পুনর্বিবেচনা করে সুপারিশ দেয়।
নতুন কমিশনটি গত ২৭ জুলাই সরকারি গেজেটের মাধ্যমে গঠিত হয়। চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সাবেক সিনিয়র সচিব খলিলুর রহমান। অর্থনীতি, শ্রম, প্রশাসনসহ বিভিন্ন খাতের মোট ১০ জন সদস্য এতে অন্তর্ভুক্ত। কমিশনের মেয়াদ ছয় মাস, অর্থাৎ ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।
কমিশনের কাজের ধাপসমূহ:
১. গবেষণা ও পরামর্শ সংগ্রহ:
কমিশন মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয়, অর্থনৈতিক সূচক ও আন্তর্জাতিক তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণ করছে। সরকারি কর্মচারী ইউনিয়ন, বিভিন্ন সংস্থা ও সাধারণ নাগরিকের মতামত নিতে জরিপ, বৈঠক ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গ্রেড পুনর্গঠন ও ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে।
২. সুপারিশ প্রণয়ন:
এই পরামর্শের ভিত্তিতে নতুন জাতীয় বেতন কাঠামো (এনপিএস) প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে মূল বেতন, ‘ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর’ (বিদ্যমান বেতনের গুণক), এবং বাসাভাড়া বা চিকিৎসা সুবিধার মতো অ-আর্থিক সুবিধার প্রস্তাব থাকবে।
৩. প্রতিবেদন দাখিল ও যাচাই:
চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগে। যাচাই শেষে সরকারি অধ্যাদেশ বা আইন জারি করে অনুমোদন দেবে। সাধারণত বাজেট সংশোধনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন শুরু হয়, যা ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে হতে পারে।
৪. বাস্তবায়ন সময়সূচি:
প্রস্তাব অনুমোদিত হলে ২০২৬ সালের শুরু থেকেই নতুন বেতন কার্যকর হতে পারে। এতে পূর্ববর্তী মাসগুলোর বকেয়া বেতনও পরিশোধের ব্যবস্থা থাকবে। কমিশন গত ১৪ আগস্ট প্রথম বৈঠক করে এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও সময়সীমা রক্ষা করতে সচেষ্ট।
ইতিহাস অনুযায়ী, প্রতিটি বেতন কমিশনের পর গড় বেতন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। তবে বাস্তবায়ন নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর।
বর্তমান ও প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোর তুলনা
বর্তমানে (সপ্তম বেতন কমিশন অনুযায়ী) বেতন কাঠামোতে ২০টি গ্রেড আছে। সর্বোচ্চ ১ম গ্রেডে মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা, সর্বনিম্ন ২০তম গ্রেডে ৮ হাজার ২৫০ টাকা। মূল বেতনের সঙ্গে ৪৫–৬৫ শতাংশ বাসাভাড়া ও মাসে ২ হাজার টাকা চিকিৎসা ভাতা যুক্ত হয়, ফলে মোট আয় প্রায় মূল বেতনের ১ দশমিক ৫ থেকে ২ গুণ।
অষ্টম বেতন কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, গ্রেড সংখ্যা ১২–১৫-এ নামিয়ে আনা হবে, যাতে কাঠামো সহজ ও ন্যায্য হয়। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বেতনের অনুপাত থাকবে ৮:১ থেকে ১০:১ (বর্তমানে প্রায় ৯.৫:১)। একাধিক কাছাকাছি গ্রেড একীভূত করা হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের জন্য বিশেষ বেতন স্কেল প্রবর্তন করা হবে। কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে পারফরম্যান্স ইনসেনটিভ বা বোনাস চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, এই কাঠামো বাস্তবায়নে বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়তে পারে। এই ব্যয় রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মেটানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
বেতন কীভাবে নির্ধারিত হয়
জাতীয় বেতন কাঠামো (এনপিএস) অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের বেতন নির্ধারিত হয় গ্রেডভিত্তিক, যা পদমর্যাদা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে।
মূল বেতন (বেসিক পে):
প্রতিটি গ্রেডে নির্দিষ্ট মূল বেতন থাকে। বেতন কমিশন আগের মূল বেতনের ওপর একটি নির্দিষ্ট ‘ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর’ প্রয়োগ করে তা সংশোধন করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে এই গুণক ছিল ২ দশমিক ৫৭ গুণ।
ভাতা ও সুবিধা:
মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন ভাতা যোগ হয়। যেমন মহার্ঘ্য ভাতা, বাসাভাড়া, চিকিৎসা ও অন্যান্য নির্দিষ্ট সুবিধা। মোট বেতন নির্ধারণ হয় = মূল বেতন + ভাতা + প্রণোদনা মিলে।
বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট:
সাধারণত মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়, যতক্ষণ না একজন কর্মী গ্রেডের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছান।
পদোন্নতি:
কর্মীরা উচ্চতর গ্রেডে গেলে নতুন বেতনের কাঠামো অনুযায়ী তাদের ইনক্রিমেন্ট পুনর্নির্ধারিত হয়।
বেতন সংশোধনের সময় কমিশন দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি (লক্ষ্য ৬–৭ শতাংশ), মুদ্রাস্ফীতি হার (২০২৫ সালে প্রায় ৯ শতাংশ) এবং উৎপাদনশীলতার সূচক বিবেচনায় নেয়। যদি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২ দশমিক ০ থেকে ২ দশমিক ৫ নির্ধারিত হয়, তাহলে অনেকের কার্যকর বেতন প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।
নতুন কাঠামোয় সর্বনিম্ন বেতন কত হতে পারে
বর্তমানে (২০তম গ্রেডে) মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা, যা ভাতা মিলিয়ে মাসে প্রায় ১৬ হাজার টাকা হয়। ৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে এটি দারিদ্র্যসীমার সামান্য উপরে অবস্থান করছে।
বিভিন্ন সংগঠন প্রস্তাব দিয়েছে, সর্বনিম্ন গ্রেডের মূল বেতন ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা উচিত, যা একটি চার সদস্যের পরিবারের ‘লিভিং ওয়েজ’ (২৫ হাজার–৩৫ হাজার টাকা) মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
শ্রমিক ইউনিয়ন ও সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলো বলছে, ২০১৫ সালের পর বাস্তব আয় ক্রমেই কমেছে, তাই এই বৃদ্ধি জরুরি। যদিও কমিশন এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবুও প্রস্তাবিত বেতন অনুপাত (৮:১ থেকে ১০:১) অনুযায়ী সর্বনিম্ন বেতন ২০ হাজার-৩০ হাজার টাকার মধ্যে হতে পারে। এটি সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বেতন বাড়ানোর প্রয়োজন কেন
বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও সামাজিক চাপের কারণে বেতন বৃদ্ধি আবার আলোচনায় এসেছে। ২০২৫ অর্থবছরে পণ্যের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। ফলে ২০১৫ সালের পর থেকে বাস্তব বেতন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কম বেতন দুর্নীতি বাড়ায় এবং দক্ষ কর্মীদের বিদেশে চলে যেতে উৎসাহিত করে।
বেতন বৃদ্ধি উৎপাদনশীলতা ও ন্যায্যতা বাড়ায়। বাড়তি বেতন কর্মীদের প্রেরণা জোগাবে, গ্রেডভেদে বৈষম্য কমাবে এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আনবে।
মহামারী-পরবর্তী পুনরুদ্ধারও এর অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে ফিরে আসায় সরকার বেতন বৃদ্ধিকে একটি অর্থনৈতিক প্রণোদনা হিসেবে বিবেচনা করছে।
জনদাবিও রয়েছে। আন্দোলন ও কর্মচারী ইউনিয়নের ধর্মঘটে বিষয়টি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার কমিশন গঠন করে।
বর্তমানে বাজেট অনুযায়ী ৫ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনা ভাতা চালু রয়েছে, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এটি টেকসই নয়। তাই পূর্ণাঙ্গ বেতন কাঠামো সংশোধন এখন অপরিহার্য।
পরবর্তী সরকারের ভূমিকা: অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য
রবিবার (১০ নভেম্বর) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্পষ্ট করেন, কমিশন তার প্রতিবেদন সম্পন্ন করবে, তবে ‘নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সরকার’।
এর ফলে দায়ভার যাবে ২০২৬ সালের শুরুতে সম্ভাব্য নবনির্বাচিত প্রশাসনের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার এই ব্যয়বহুল সিদ্ধান্তের দায় (প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত বার্ষিক ব্যয়) নিতে চাইছে না।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, সরকার বিভিন্ন খাতে বেতন কাঠামো তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করছে, তবে বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা হয়েছে নতুন বাজেট পরিকল্পনা ও আইএমএফ ঋণ শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য।
নতুন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে সরকারি কর্মচারীদের মনোবল ও দক্ষতা বাড়বে, তবে এটি ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের ৭ দশমিক ৯৭ লাখ কোটি টাকার বাজেটে বড় চাপ ফেলবে।
সরকার ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিতে পারে—যেমন, প্রথম বছরে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি, পরবর্তী বছরগুলোতে বাকি অংশ।