গত শুক্রবার (৭ নভেম্বর) গাজায় গণহত্যার অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ ইসরায়েলি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তুরস্ক। এর আগে নিউইয়র্ক শহরের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি প্রথমে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এবং পরে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ঘোষণা দেন, নেতানিয়াহু যদি নিউইয়র্কে আসেন তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পরোয়ানার ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। এই ঘটনাগুলো আইনিভাবে কোনোটা শক্তিশালী আবার কোনোটা হয়তো দুর্বল, কিন্তু সব মিলিয়ে স্পষ্ট করে দিচ্ছে—গাজায় ইসরায়েলি নেতৃত্বের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি আদায়ের বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিশ্বজুড়ে বিতর্কিত এক নাম। একদিকে নেতানিয়াহু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সমালোচনা করছেন, একই দিনে তাঁর দেশের সেনাবাহিনী গাজায় খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের গুলি করে মারছে। ক্ষমতার দাম্ভিকতা আর দখলদারি নীতির কারণে যিনি পরিণত হয়েছেন আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম সমালোচিত রাষ্ট্রনায়কে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নতুন কিছু নয়, আগেও জারি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আদৌ কি কাজের কিছু? যদিও হয়ে থাকে তবে এর প্রয়োগ হচ্ছে না কেন? প্রয়োগ কী করেই বা হতে পারে? আর নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সম্ভাব্য ফলাফলই বা কী?
পরোয়ানার পেছনের পরোয়ানা: আইসিসির সেই প্রথম পদক্ষেপ
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলোর কার্যকারিতা মূলত নির্ভর করে কোন কর্তৃপক্ষ এটি জারি করেছে তার ওপর। তুরস্কের মতো কোনো দেশের জারি করা পরোয়ানা সেই দেশের সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ, নেতানিয়াহু তুরস্কে প্রবেশ করলেই কেবল তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব, অন্য কোনো দেশে এই পরোয়ানার আইনি ভিত্তি নেই। এটি মূলত একটি রাষ্ট্রের নিজস্ব রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার।
তুরস্কের এই পদক্ষেপের এক বছর আগে ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রথম নেতানিয়াহু ও তাঁর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধের কৌশল হিসেবে নিরীহ বেসামরিক মানুষকে অনাহারে রাখাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার।
আইসিসির সেই পরোয়ানাটিই ছিল নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ার প্রথম আনুষ্ঠানিক ও সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের আইনি ভিত্তি কতটা শক্তিশালী, তা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে, আইসিসি প্রসিকিউটর একদল আইন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেন। প্রখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবী আমাল ক্লুনিসহ সেই প্যানেল সর্বসম্মতভাবে রায় দেয়, নেতানিয়াহু ও অন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার মতো ‘যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে’। এই ঘোষণা অভিযোগগুলোকে এক নতুন নৈতিক ও আইনি মাত্রা দেয়।
পরোয়ানা আছে, গ্রেপ্তার নেই কেন?
প্রশ্ন ওঠে, বিশ্বের সর্বোচ্চ অপরাধ আদালতের পরোয়ানা ও বিশ্বসেরা আইনজীবীদের সমর্থনের পরও নেতানিয়াহু কেন এখনো গ্রেপ্তার হলেন না? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক আইন ও রাজনীতির কিছু জটিল সমীকরণে। প্রথমত, আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী কিংবা সশস্ত্র বাহিনী নেই। পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য তাকে পুরোপুরি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতার ওপর নির্ভর করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য নয়, তাই তারা এই আদালতের কর্তৃত্বকে স্বীকার করে না। এর ফলে, এই দেশগুলোর ওপর আইসিসির কোনো আইনি এখতিয়ার নেই।
তৃতীয়ত, অনেক সদস্য রাষ্ট্র রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে ইসরায়েলের মতো শক্তিশালী দেশের নেতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা বোধ করে। উদাহরণস্বরূপ, সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে আইসিসির পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও তিনি অনেক সদস্য দেশ ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
তবে পরোয়ানাভুক্ত কোনো আসামি তাদের দেশে পা রাখামাত্রই তাকে গ্রেপ্তার করে আইসিসির হাতে তুলে দিতে রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী ১২৪টি দেশ আইনত বাধ্য।
সম্ভাব্য ফলাফল ও কূটনৈতিক সংকট
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর হোক বা না হোক, এর ফল সুদূরপ্রসারী। সবচেয়ে বড় ও তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো নেতানিয়াহুর আন্তর্জাতিক চলাচল মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসের অধ্যাপক বোয়াজ আতজিলির মতে, যুক্তরাষ্ট্র নেতানিয়াহুর জন্য নিরাপদ হলেও রোম সংবিধির স্বাক্ষরকারী ১২৪টি দেশের যেকোনো একটিতে গেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এর মানে হলো, নেতানিয়াহুর জন্য গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের একটি বিশাল অংশ কার্যত ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ বা ‘নো-গো জোন’-এ পরিণত হয়েছে। এক অদৃশ্য কারাগার, যার দেয়াল দেখা যায় না, কিন্তু অস্তিত্ব পদে পদে অনুভব করা যায়।
এই পরোয়ানা ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোর জন্য উভয়সংকট তৈরি করেছে। একদিকে তাদের আইসিসির প্রতি আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার চাপও রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞ গারহার্ড কেম্প-এর মতে, আন্তর্জাতিক সমালোচনা সত্ত্বেও গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড সমর্থন দিয়ে যাওয়া দেশগুলো আইসিসির এমন সিদ্ধান্তে চাপের মুখে পড়বে।
তাছাড়া, এই পরোয়ানা একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই প্রথম পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট কোনো গণতান্ত্রিক দেশের নেতার বিরুদ্ধে আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল। সাউথ অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রভাষক ড. জুলিয়েট ম্যাকিনটায়ার-এর মতে, এই পরোয়ানা ‘বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমিয়ে আনতে’ পারে, কারণ অনেক দেশই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন নেতার পাশে দাঁড়াতে চাইবে না।
বিশেষজ্ঞের চোখে ভবিষ্যৎ ও রাজনৈতিক প্রভাব
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আইনি প্রয়োগের চেয়ে এর রাজনৈতিক ও প্রতীকী গুরুত্ব অনেক বেশি। এর ফলে পশ্চিমা বিশ্বের জনসাধারণের কাছে নেতানিয়াহু রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের মতো নেতার কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন। যা স্পষ্টতই ইসরায়েলের ভাবমূর্তির জন্য বড় ধরনের আঘাত। পরোয়ানাগুলো গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আন্তর্জাতিক জনমতকে আরও বেশি প্রভাবিত করবে ও বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বা অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিকে জোরদার করবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ শান্তি আলোচনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাঁর মতে, এ ধরনের অভিযোগ কট্টরপন্থীদের কোণঠাসা করে ফেলে।
অন্যদিকে, দেশের ভেতরেও এই পরোয়ানা এক রাজনৈতিক ঝড় তুলেছে। নেতানিয়াহুর সমর্থকেরা এটিকে দেখছেন ইহুদি-বিদ্বেষী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে। তাদের কাছে এই ধরনের পরোয়ানা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই এক চক্রান্ত। এই অনুভূতি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে নিজ দেশে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। আবার, তাঁর বিরোধীরা এটিকে দেখছেন নেতানিয়াহুর আগ্রাসী নীতির করুণ পরিণতি হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনি সহায়তা সংস্থা ‘সেন্টার ফর কনস্টিটিউশনাল রাইটস’ যেমন বলেছে, এই পরোয়ানা ‘অনেক আগেই জারি করা উচিত ছিল এবং গাজায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যা বন্ধে দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসানের জন্য এটি অপরিহার্য।’
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। যদিও তাকে গ্রেপ্তার করে দ্য হেগের আদালতে হাজির করা একটি কঠিন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া, কিন্তু এই পরোয়ানাগুলো এরই মধ্যে ইসরায়েলের ওপর শক্তিশালী নৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ তৈরি করেছে। বিশ্বজুড়ে দায়মুক্তির সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ভাঙছে ও আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা এখন শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনার সাহস দেখাতে শুরু করেছে।
একুশ শতকে ক্ষমতার দম্ভ আর দায়মুক্তির সংস্কৃতি চিরস্থায়ী নয়। বিচারের চাকা হয়তো ধীরে ঘোরে, কিন্তু যখন ঘোরে, তখন কোনো শক্তিই তাকে থামিয়ে রাখতে পারে না। নেতানিয়াহু হয়তো আজ গ্রেপ্তার হননি, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচারের খাতায় তাঁর নামটি উঠে গেছে—যা আগামী বহু বছর ধরে জবাবদিহিতা ও আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে আলোচনার গতিপথ নির্ধারণ করবে।