leadT1ad

ইলন মাস্ক যেভাবে বিশ্বের প্রথম ট্রিলিয়নেয়ার হওয়ার পথে

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১৩: ১২
২০৩৫ সালের মধ্যে ইলন মাস্কের সম্পদ ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা তাঁকে ইতিহাসের সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি করে তুলবে। ছবি: সংগৃহীত।

টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের জন্য প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ অনুমোদন করেছেন। এই সিদ্ধান্ত তাঁকে ইতিহাসের প্রথম ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদশালী ব্যক্তিতে পরিণত করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

এখন ইলন মাস্কের সামনে নতুন লক্ষ্য—কোম্পানির বাজারমূল্যকে বর্তমানের তুলনায় আট গুণ বাড়ানো। যদি মাস্ক আগামী ১০ বছরে টেসলার বাজারমূল্য ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে তুলতে পারেন, তবে তিনি ইতিহাসে প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হবেন।

গত বৃহস্পতিবার টেক্সাসের অস্টিনে কোম্পানির সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ভোটে ৭৫ শতাংশের বেশি শেয়ারহোল্ডার এই পরিকল্পনার পক্ষে ভোট দেন। ফল ঘোষণার পর মঞ্চে উঠে মাস্ক নেচে নেচে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এটি শুধু টেসলার নতুন অধ্যায় নয়, এটি এক নতুন বই।’

এই অনুমোদন প্রমাণ করে যে বিনিয়োগকারীরা মাস্কের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখছেন। তারা বিশ্বাস করেন, মাস্ক টেসলাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্সের যুগে নিয়ে যেতে পারবেন। পরিকল্পনাটি বাতিল হলে, টেসলা হয়তো তার সেই নেতাকে হারাতো, যিনি কোম্পানির নামকে বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতীক বানিয়েছিলেন।

তবে মাস্কের ট্রিলিয়নিয়ার হওয়া নির্ভর করছে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের ওপর। এজন্য তাঁকে টেসলার বাজারমূল্য ৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে তুলতে হবে—যা বর্তমান মূল্যের প্রায় আট গুণ। পাশাপাশি তাঁকে লাখ লাখ স্বয়ংক্রিয় গাড়ি ও হিউম্যানয়েড রোবট বাজারে আনতে হবে এবং আগামি ১০ বছরে কোম্পানির বার্ষিক মুনাফা শত শত বিলিয়ন ডলারে বজায় রাখতে হবে।

ব্লুমবার্গের বিলিয়নিয়ার সূচক অনুযায়ী, ২০২৫ সালের নভেম্বরে মাস্কের বর্তমান সম্পদ ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। প্যাকেজে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করতে পারলে ২০৩৫ সালের মধ্যে তাঁর সম্পদ ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা তাঁকে ইতিহাসের সর্বাধিক ধনী ব্যক্তি করে তুলবে।

ট্রিলিয়ন ডলারের পথে

পরিকল্পনায় টেসলার বাজারমূল্য বাড়ানোর জন্য ধাপে ধাপে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যগুলো বারোটি ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপের লক্ষ্য ২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো। পরবর্তী প্রতিটি ধাপে আরও ৫০০ বিলিয়ন ডলার করে বৃদ্ধি ধরা হয়েছে, যা ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮ দশমিক ৫ ট্রিলিয়নে পৌঁছানোর কথা। প্রতিটি আর্থিক লক্ষ্য পূরণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে নতুন পণ্যের উন্নয়ন।

আগামী এক দশকে মাস্ক অতিরিক্ত ১২ শতাংশ শেয়ার পেতে হলে তাঁকে ২ কোটি বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি করতে হবে, ১ কোটি সক্রিয় স্বয়ংচালিত সাবস্ক্রিপশন চালু করতে হবে, ১০ লাখ হিউম্যানয়েড রোবট তৈরি করতে হবে এবং ১০ লাখ রোবোট্যাক্সি বাণিজ্যিকভাবে চালু করতে হবে।

এ ছাড়া টানা চার ত্রৈমাসিক ধরে ৪০০ বিলিয়ন ডলার আয় বজায় রাখতে হবে। ২০২৫ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে টেসলার আয় ছিল ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ কম।

বার্ষিক সভায় মাস্ক বলেন, কোম্পানির ‘অপটিমাস’ রোবটই হবে ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন। তিনি দাবি করেন, এটি মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন স্বাস্থ্যসেবা থেকে কারাগার পর্যন্ত, ব্যবহৃত হতে পারে।

সর্বশেষে, মাস্ককে অন্তত আরও সাড়ে সাত বছর কোম্পানিতে থাকতে হবে এবং একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। টেসলার বাজারমূল্য যত বাড়বে, ততই বাড়বে মাস্কের সম্পদের পরিমাণ।

টেসলা নিজেই জানিয়েছে, এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করা ‘অত্যন্ত কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং’ হবে। যদি সব লক্ষ্য পূরণ হয়, তবে টেসলার বাজারমূল্য মেটা, মাইক্রোসফট ও গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেটের সম্মিলিত মূল্যের কাছাকাছি পৌঁছাবে।

তবে অনেকে মনে করেন, সব লক্ষ্য পূরণ না হলেও মাস্ক বিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে পারবেন।

টেসলার চ্যালেঞ্জ ও নতুন করপোরেট সদরদপ্তর

ভোটের ফলাফল ইলন মাস্কের জন্য একটি বড় বিজয়। এটি প্রমাণ করে, বিক্রয় ও মুনাফা কমে গেলেও বিনিয়োগকারীরা এখনো তাঁর ওপর আস্থা রাখছেন। তবে এই সংকটের পেছনে মাস্কের বিতর্কিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রাজনীতিতে জড়ানো এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের কারণে অনেক ক্রেতা টেসলার গাড়ি কেনা বন্ধ করেছেন।

ভোটের মাত্র তিন দিন আগে ইউরোপে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্টোবর মাসে টেসলার বিক্রি আবারও কমেছে—জার্মানিতে বিক্রি অর্ধেকে নেমে গেছে। তবুও অনেক বিনিয়োগকারী মাস্ককে এখনো এক ‘অলৌকিক উদ্যোক্তা’ হিসেবে দেখেন, যিনি একসময় দেউলিয়া হওয়ার মুখ থেকে টেসলাকে ফিরিয়ে এনে বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান কোম্পানিতে পরিণত করেছিলেন।

টেসলা বহু বছর ধরে তাদের প্রধান নির্বাহীর জন্য লক্ষ্যভিত্তিক প্রণোদনা পরিকল্পনা চালু করে আসছে। ২০১৮ সালে গৃহীত প্যাকেজটি এক ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডার আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন। মামলায় তিনি জয়ী হন, ফলে প্যাকেজটি বাতিল করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় মাস্ক ডেলাওয়্যার অঙ্গরাজ্যের আদালতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান এবং টেসলার করপোরেট সদরদপ্তর টেক্সাসে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেন।

ডেলাওয়্যারের আদালতের রায় নিয়ে মাস্কের অসন্তোষ ‘#DExit’ নামে একটি নতুন প্রবণতা সৃষ্টি করে। এতে ড্রপবক্স, মেটার মতো বড় কোম্পানিও ডেলাওয়্যার থেকে সদরদপ্তর সরানোর হুমকি দেয়। কলাম্বিয়া ল’ স্কুলের অধ্যাপক এরিক ট্যালি বলেন, ‘ইলন মাস্কের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে তা করপোরেট আইনের ক্ষেত্রেও পৌঁছে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডেলাওয়্যার দীর্ঘদিন করপোরেট বিশ্বের কেন্দ্র হিসেবে ছিল, কিন্তু ২০২৪ সালে মাস্ক সেটি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন।’

‘সুপারস্টার সিইও’-কে ধরে রাখার প্রচেষ্টা

টেসলা বোর্ডের চেয়ার রবিন ডেনহলম প্রকাশ্যে সতর্ক করেন, ২০২৫ সালের ক্ষতিপূরণ পরিকল্পনায় ‘না’ ভোট দিলে কোম্পানি মাস্ককে হারাতে পারে। ডেনহলম ও বোর্ড সদস্য ক্যাথলিন উইলসন-থম্পসনের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের আইনি জটিলতার কারণে মাস্ক গত আট বছর কোনো উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাননি।

বৃহস্পতিবার শেয়ারহোল্ডাররা সেই পুরোনো প্যাকেজের পরিবর্তে মাস্ককে নতুনভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরিকল্পনাও অনুমোদন করেন। নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়িত হলে মাস্ক কোম্পানির ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার মালিক হবেন। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত টেসলার শেয়ারমূল্য প্রায় ৪৫০ ডলার ছিল, যা বছরের সর্বোচ্চ মূল্যের কাছাকাছি।

বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী মাস্কের সিইও বেতন প্যাকেজ আয়ারল্যান্ড, সুইডেন ও আর্জেন্টিনার মোট দেশজ উৎপাদনের চেয়েও বেশি। সমালোচকদের মতে, এত বিশাল প্যাকেজ একজন ব্যক্তিকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিচ্ছে এবং কোম্পানির বিদ্যমান সমস্যাগুলো উপেক্ষা করছে। নিউইয়র্ক রাজ্যের কম্পট্রোলার টমাস ডিনাপোলি বলেন, ‘এই ভোট দেখিয়েছে টেসলার পরিচালনা কতটা জবাবদিহিতা থেকে সরে গেছে। বোর্ড এমন একজন সিইওকে পুরস্কৃত করেছে যিনি কারও কাছে দায়বদ্ধ নন।’

অতিরিক্ত ভোট ও প্রস্তাবনা

শেয়ারহোল্ডাররা বৃহস্পতিবার আরও কয়েকটি প্রস্তাব অনুমোদন করেন। এর মধ্যে তিনজন বোর্ড সদস্য নির্বাচিত করা, ২০২৪ সালের নির্বাহী বেতন অনুমোদন এবং কিছু ‘সুপারমেজরিটি ভোটিং রিকোয়ারমেন্ট’ বাতিলের সিদ্ধান্ত ছিল।

তবে বেশিরভাগ অন্যান্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। কেবল একটিমাত্র পরামর্শমূলক প্রস্তাব—এক্সএআই-তে বিনিয়োগের সম্ভাবনা—বোর্ডের পরবর্তী পর্যালোচনার জন্য গৃহীত হয়েছে। এছাড়া কঙ্গোর কোবাল্ট খনিতে শিশু শ্রমের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য প্রস্তাবিত নিরীক্ষা (অডিট) পরিকল্পনাও বাতিল করা হয়েছে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Ad 300x250

সম্পর্কিত