দেশের ক্রিকেট অঙ্গন এখন এক অন্ধকার সময় পার করছে। বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম অভিযোগ করেছেন, ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ চলাকালে নারী দলের তৎকালীন নির্বাচক ও ম্যানেজার মনজুরুল ইসলাম তাঁকে যৌন হয়রানি করেন।
৩২ বছর বয়সী জাহানারা গত শুক্রবার (৭ নভেম্বর) একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই অভিযোগ তোলেন। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ওই ঘটনার আগেই মনজুরুলের আপত্তিকর আচরণের বিষয়ে তিনি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তার কোনো সুরাহা হয়নি।’
ক্রিকেটের অন্ধকার এই সময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আলো দেখানো কথা। তবে সংস্থাটি কিছু বিষয় নিয়ে উল্টো ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অভিযোগ সামনে আসার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) জানিয়েছিল, ঘটনাটি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হবে, যারা ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। তবে রোববার তিন সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়, তার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কোনো সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে দেশের সাবেক দুই অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ও তামিম ইকবালও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, তদন্ত কমিটি যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং বিসিবির প্রভাবমুক্ত থাকে। তামিম প্রস্তাব দেন, এ ঘটনার তদন্তে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বা সরকারের অধীনে কমিটি গঠিত হোক। সেই কমিটিতে বিসিবির কারও সম্পৃক্ততা না থাকুক।
তাঁদের লেখায় কমিটি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছিল, তা যে অমূলক নয়; অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর প্রমাণও পাওয়া যায়। গত রোববার বিসিবির বর্তমান একজন পরিচালকের বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ ওঠে। অতীতে বিসিবির নিষ্ক্রিয়তা এবং প্রভাবশালীদের সুরক্ষা দেওয়ার অভিযোগ এই কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
আলোচিত সেই সাক্ষাৎকারে ক্রিকেটার জাহানারা আলম জানান, দক্ষিণ আফ্রিকায় মনজুরুল তাঁকে অশোভন প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর থেকেই মনজুরুল তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ শুরু করেন। তিনি আরও জানান, প্রয়াত তৌহিদ মাহমুদের পক্ষ থেকেও তাঁকে বিসিবির এক কর্মকর্তা এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তৌহিদ তখন বিসিবির নারী বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন এবং সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের ব্যক্তিগত সচিবও ছিলেন।
এই অভিযোগ ক্রিকেটাঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তবে আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে জাহানারার ২০২১ সালের আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র, যা তিনি বিসিবির সিইও নিজামউদ্দিন চৌধুরীর কাছে জমা দিয়েছিলেন।
এর আগেও মনজুরুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নারী ক্রিকেটার ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ তুলেছিলেন, কিন্তু জাহানারাই প্রথম লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি জাতীয় দলে মনজুরুলের কর্তৃত্ব, আচরণ ও অপব্যবহারের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তখন কেউই মনজুরুলের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখাননি, কারণ তিনি ছিলেন এক প্রভাবশালী পরিচালকের আশীর্বাদপুষ্ট। সম্ভবত সেই কারণেই অভিযোগের পরও বিসিবি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিসিবি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, ২০২১ সালের চিঠিতে যৌন হয়রানির উল্লেখ ছিল না, এবং তাঁরা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, মনজুরুল তাঁর পদে বহাল ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে এমন ঘটনার অভিযোগ করলেন একজন নারী ক্রিকেটার।
জাহানারার আলমের সতীর্থ, সাবেক এক নারী ক্রিকেটার বলেন, ‘আমরা সবাই জানতাম জাহানারা ও মনজুরুলের মধ্যে সমস্যা ছিল, কিন্তু বিষয়টি তখন গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়নি। তখন যদি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো, আজকের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নারী ক্রিকেটাররা সব সময় বোর্ডে উপেক্ষিত। না হলে ২০২১ সালে তিনি (জাহানারা) যখন সিন্ডিকেটের অভিযোগসহ সব কিছু লিখেছিলেন, তখন গুরুত্ব দেওয়া হতো।’
সম্প্রতি অন্য এক সাক্ষাৎকারে জাহানারা অভিযোগ করেন, জাতীয় অধিনায়ক নিগার সুলতানা সহ-খেলোয়াড়দের শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন। বিসিবি এই অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেয়—যেমনটি তারা ২০২১ সালের অভিযোগের ক্ষেত্রেও করেছিল।
ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোর্ডের ব্যর্থতাতেই জাহানারা নীরবতা ভেঙেছেন এবং প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন। তিনিই হয়তো প্রথম, যিনি আলো ফেললেন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে ছড়িয়ে থাকা গভীর সমস্যার ওপর। বিসিবি যদি এবারও দায়সারা তদন্ত ও ‘লোক দেখানো’ পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে নারী ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হবে।
রোববার রাতে সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেছেন, যৌন হয়রানির বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা হবে। তবে সেটি বাস্তবে কার্যকর করতে হলে বিসিবিকে অতীতের ধারা থেকে বের হতে হবে। নইলে তামিমের ভাষায়, ‘তরুণীরা এই খেলায় আসতে ভয় পাবে।’
(একজন ফ্রিল্যান্স ক্রীড়া সাংবাদিক এই প্রতিবেদনে সহায়তা করেছেন)