নিউইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি এক সকালে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের মেঝেতে তোয়ালে বিছিয়ে পানি মুছছিলেন। মাসে ২ হাজার ৩০০ ডলারের ভাড়া দেওয়া সেই ছোট্ট এক বেডরুমের ফ্ল্যাটে সিঙ্ক লিক করছিল। এ ধরনের ঝামেলা তাঁর জীবনের নতুন নয়।
দ্য নিউ ইয়র্কার রেডিও আওয়ার-এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মামদানি বলেন, ‘আমার স্ত্রী আর আমি প্রায়ই বলি, এখন এক বেডরুমের ফ্ল্যাটটা আমাদের জন্য বেশ ছোট।’ তিনি প্লাম্বিং সমস্যার কথাও জানান।
তবে যদি মামদানি নিউইয়র্কের সরকারি মেয়র বাসভবন গ্রেসি ম্যানশন-এ ওঠার সিদ্ধান্ত নেন, এমন ঝামেলা তাঁর আর সামলাতে হবে না। আর নতুন বাড়িটি যে অনেক বেশি প্রশস্ত ও আরামদায়ক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অ্যাস্টোরিয়ার নিয়ন্ত্রিত ভাড়ার সাধারণ অ্যাপার্টমেন্ট আর ২২৬ বছর পুরোনো, ১১ হাজার বর্গফুটের গ্রেসি ম্যানশনের পার্থক্য বিশাল। ঝকঝকে ঝাড়বাতি, আয়না, বিশাল লন, আপেল ও ডুমুর গাছ, এমনকি খরগোশে আক্রান্ত সবজির বাগান—সব মিলিয়ে এটি যেন এক ঐতিহাসিক প্রাসাদ।
ডান্তে ডি ব্লাসিও, যিনি তাঁর বাবা বিল ডি ব্লাসিওর মেয়র থাকাকালে এই বাসভবনে থাকতেন, বলেন, ‘আমি নিজেকে তখন আমেরিকার সবচেয়ে ভাগ্যবান বাচ্চা মনে করতাম।’ তিনি যোগ করেন, ‘নিউইয়র্কে বড় হলে আপনি জায়গার মূল্য কত তা বুঝবেন। সেখানে হঠাৎ করেই আমার সামনে একটি লন আর বলরুম এসে যায়।’ তবে তিনি এটিও স্বীকার করেন যে, ‘সেখানে থাকা কিছুটা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দেয়—আপনি নিউইয়র্কবাসীর দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে দূরে চলে যান।’
মামদানি কয়েক মাস ধরেই বলছেন যে তিনি তাঁর বর্তমান ফ্ল্যাট ছাড়বেন, বুধবার তিনি বলেন, ‘আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি কোথায় থাকব। তবে আমি জানি কোথায় কাজ করব—সেটা হলো সিটি হল।’ সাংবাদিকদের সঙ্গে পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি মজা করে বলেন, আগের রাতে তাঁর বাড়ির সুপার আবারও তাঁকে মেসেজ করেছিল।
তবে বাস্তবে বেশিরভাগ মেয়রই শেষ পর্যন্ত গ্রেসি ম্যানশনে থাকেন। কারণ এটি নিরাপদ, প্রশস্ত এবং সরকারি সভা-সম্মেলনের জন্য উপযুক্ত স্থান।
গ্রেসি ম্যানশনের ভেতরের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
ভাড়ার মধ্যেই তাপ আর গরম পানি
মামদানির অ্যাস্টোরিয়ার ফ্ল্যাটটি সর্বশেষ ২০১৮ সালে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। বিজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল, ভাড়ার মধ্যে তাপ ও গরম পানি অন্তর্ভুক্ত—যা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হলেও বড় একটি সুবিধা।
অ্যাপার্টমেন্টটির রান্নাঘরে একটি জানালা ছিল, শয়নকক্ষে দুটি আলমারি, এবং সুপার একই ভবনে থাকতেন। ইউনিটটিতে নিজস্ব ওয়াশার বা ড্রায়ার না থাকলেও ভবনে একটি কমন লন্ড্রি রুম ছিল।
১৯২৯ সালে নির্মিত এই সাধারণ ইটের ভবনটি ছোট ও নিচু তলার হলেও লিফট ছিল—যা অ্যাস্টোরিয়ায় বেশ বিরল। ব্রোকারদের ধারণা, মামদানির ফ্ল্যাটের আয়তন সর্বোচ্চ ৮০০ বর্গফুট।
একজন পূর্ণকালীন রাঁধুনি ও অনসাইট বলরুম
অন্যদিকে, গ্রেসি ম্যানশনকে এক সাংবাদিক একসময় বর্ণনা করেছিলেন ‘হালকা লেবু রঙের কেকের মতো একটি বাড়ি’ হিসেবে। এটি কার্ল শুর্জ পার্কের ওপরে, ইস্ট রিভারের ধারে অবস্থিত। সেখান থেকে নদীর মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।
অফিস শেষে মেয়ররা গাড়িতে করে ম্যানশনের নিরাপত্তা ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করেন। প্রবেশদ্বারে তোরাহ থেকে উদ্ধৃত আয়াতসহ একটি মেজুজা স্থাপিত, যা ১৯৭০-এর দশকে মেয়র আব্রাহাম বিম প্রথম বসান।
নিচতলাটি ঐতিহাসিক ও সাজানো-গোছানো, যেখানে কোনো পরিবর্তন করার অনুমতি নেই। রয়েছে একটি বড় অগ্নিকুণ্ডসহ অভ্যর্থনা কক্ষ, যেখানে ১৯৬০-এর দশকে মেয়র জন লিন্ডসের সন্তানরা বড়দিনের মোজা ঝুলাতো, একটি বসার ঘর এবং প্যারিসের বাগানচিত্রে মোড়া ডাইনিং রুম। এখানেই মেয়রের খাবার পরিবেশন করা হয়, যা প্রস্তুত করেন পূর্ণকালীন রাঁধুনি।
১৯৬৬ সালে উদ্বোধিত বলরুমটিকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বর্ণনা করেছিল ‘একটি হাইডেন কোয়ার্টেটের মতোই ভারসাম্যপূর্ণ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ’ হিসেবে।
উপরে রয়েছে পাঁচটি শয়নকক্ষ। পরবর্তী মেয়ররা এই আনুষ্ঠানিক ভবনটিকে কিছুটা ঘরোয়া করে তুলতে চেষ্টা করেছেন। বিল ডি ব্লাসিওর পরিবার ওয়েস্ট এলম-এর এক সজ্জাশিল্পীর সাহায্যে আধুনিক সাজে সাজিয়েছিল; তাঁর স্ত্রী একটি কক্ষকে ছোট্ট ডাইনিং রুমে রূপ দেন, যেখানে মাঝে মাঝে মধ্যরাতের নাস্তা করা যেত।
লিন্ডসি, জুলিয়ানি, ব্লুমবার্গের মেয়েরা এমনকি জানালার কাঁচে নিজেদের নাম খোদাই করেছিলেন। ডি ব্লাসিওর স্ত্রী চিরলেন ম্যাকক্রেও সেই ঐতিহ্যে অংশ নেন।
গেসি ম্যানশনের বসার ঘর। ছবি: সংগৃহীত।
আয়োজনের জায়গা
এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে কোনও বড় আয়োজন করা সহজ নয়। প্রতিবেশীরা চারদিকে থাকায় শব্দ ও ভিড়ের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু গ্রেসি ম্যানশন তৈরি হয়েছিল এমনই অনুষ্ঠানের জন্য।
মেয়র এরিক অ্যাডামস এ বছর কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে আরব, ইকুয়েডরীয় ও গায়ানিজ নিউইয়র্কারদের সম্মানে অনুষ্ঠান করেছেন। তিনি ফ্লিট উইক, নারী ইতিহাস মাস ও নওরোজ উপলক্ষেও আয়োজন করেছেন জমকালো অনুষ্ঠান।
অ্যাডামসের ছেলে জর্ডান কোলম্যান, যিনি একজন র্যাপার, একবার সেখানে ছুটির পার্টির আয়োজন করেন এবং নিজের অ্যালবামের গান পরিবেশন করেন।
দান্তে দে ব্লাসিও মামদানিকে পরামর্শ দিয়েছেন বাড়িটি সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করতে, যেন এটি জাদুঘর নয়, বাসভবনের মতো মনে হয়।
তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাকে পার্টি দিতে হবে। আমি দারুণ জন্মদিনের পার্টি দিয়েছিলাম।’
অ্যাস্টোরিয়া বনাম আপার ইস্ট সাইড
অ্যাস্টোরিয়া তরুণ ও পরিবারগুলোর জন্য সাশ্রয়ী ও প্রাণবন্ত এলাকা। এখানে শান্ত আবাসিক সড়ক, নদীতীরবর্তী পার্ক এবং মানসম্মত সরকারি স্কুল রয়েছে। গ্রিস, মিসর ও মরক্কো থেকে আগত অভিবাসীরা এখানে বসবাস করেন এবং লাতিনো সম্প্রদায়ের উপস্থিতিও বড়। এটি আরামদায়ক, তবে বিলাসবহুল নয়।
অন্যদিকে, আপার ইস্ট সাইড নিউইয়র্কের অন্যতম ধনী ও অভিজাত এলাকা। এখানে বিশ্বের নামকরা জাদুঘর এবং বিখ্যাত স্থাপনাগুলো অবস্থিত। কার্লাইল হোটেলের বেমেলমানস বারে অতিথিরা ২৮ ডলারের মার্টিনি অর্ডার করতে পারেন, আর রাতে থাকতে চাইলে খরচ হয় অন্তত ১ হাজার ডলার।
এলাকাটি শান্ত, এমনকি গ্রীষ্মের সপ্তাহান্তে প্রায় ফাঁকা থাকে, কারণ অনেক বাসিন্দা ছুটি কাটাতে হ্যাম্পটন বা ন্যানটাকেটে চলে যান। এখানে চিজবার্গার বা স্প্যাগেটি সহজেই পাওয়া যায়, কিন্তু অ্যাস্টোরিয়ার মতো বৈচিত্র্যময় খাবার পাওয়া কঠিন।
মমদানি সম্প্রতি তার প্রিয় রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে পাই বোট নুডলসের কাঁচা ঝাল বিফ, বাহারি এস্টিয়েটোরিও ও এলিয়াস কর্নারের সীফুড এবং আবুকিরের ব্রাঞ্জিনো মাছের প্রশংসা করেছেন, যার দাম মাত্র ২৩ দশমিক ৯৯ ডলার।
অন্যদিকে, আপার ইস্ট সাইডের মার্ক হোটেলে একই ধরনের এক টুকরো ব্ল্যাক সি বাসের দাম ৭২ ডলার।
মামদারি ও তার স্ত্রী রামা দুয়াজি। ছবি: সংগৃহীত।
নিরাপত্তা
মমদানির বর্তমান অ্যাপার্টমেন্টে কোনো দারোয়ান বা বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। গ্রেসি ম্যানশনের সবচেয়ে বড় সুবিধা তার উঁচু দেয়াল, ক্যামেরা ও পুলিশের নিরাপত্তা দল। এ কারণেই দে ব্লাসিও পরিবার শেষ পর্যন্ত সেখানে উঠে যায়। প্রাক্তন মেয়র মমদানিকেও একই পরামর্শ দিয়েছেন, ‘তার অবশ্যই গ্রেসিতে থাকা উচিত।’
গ্রেসিতে প্রথম বসবাস করেন মেয়র ফিওরেলো লাগুয়ার্দিয়া। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তার কারণে ইস্ট হারলেমের বাসা থেকে সেখানে যেতে রাজি হন। নগর পরিকল্পনাবিদ রবার্ট মোজেস তাঁকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন।
লাগুয়ার্দিয়া বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন ‘গ্রেসি ফার্ম’, যদিও নামটি জনপ্রিয় হয়নি। তাঁর স্ত্রী নিজেই গৃহস্থালির কাজ করতেন এবং বাগানে কাপড় শুকাতেন।
অ্যাডামস অবশ্য নিরাপত্তা নয়, অন্য এক বিপদের কথা বলেছেন—‘ওখানে ভূত আছে!’ প্রসিকিউটরদের তথ্য অনুযায়ী, তিনি সাধারণত সপ্তাহে কদিনই কেবল সেখানে থাকেন।
মাইকেল ব্লুমবার্গ গ্রেসিতে ওঠেননি; তিনি নিজের কাছের টাউনহাউসেই থাকতেন, যা আরও বিলাসবহুল।
এড কচ নির্বাচিত হওয়ার পরও গ্রিনউইচ ভিলেজের ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। কিন্তু মানুষ নিয়মিত ফোন করে তাকে বিরক্ত করায়, তিনি শেষে গ্রেসিতে চলে যান।
পরে তিনি বলেছিলেন, ‘বিলাসিতায় অভ্যস্ত হতে সময় লাগে না। আমি খুব তাড়াতাড়িই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’