.png)
বিশেষ সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান মুখ এবং নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। আন্দোলনের উত্তাল সময় পেরিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের পর বর্তমান বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি ঢাকা স্ট্রিমের সাঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন। একইসঙ্গে তিনি তার নিজের জীবনের গল্প, রাজনৈতিক দর্শন ও ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিষয়গুলোও শেয়ার করেছেন। আজ প্রকাশিত হচ্ছে শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা স্ট্রিমের সস্পাদক ইফতেখার মাহমুদ।

স্ট্রিম ডেস্ক

নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দশ বা পনেরো বছরে যে অবস্থানে পৌঁছায়, তারা সেই জায়গায় ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন। তিনি বলেন, এখন বাকি পথটুকু আমাদের নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও নিষ্ঠা দিয়েই অতিক্রম করতে হবে। সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হলো:
ইফতেখার মাহমুদ: নাহিদ ইসলাম আজ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির একজন পরিচিত মুখ। আপনার এই রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা বিন্দু কোনটি? শৈশব এবং পারিবারিক আবহ, নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন—কোন সময়টিকে আপনি রাজনীতির পথে আসার টার্নিং পয়েন্ট বা মূল অনুঘটক হিসেবে বিবেচনা করেন?
নাহিদ ইসলাম: আমার বেড়ে ওঠার পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, আমার পারিবারিক পরিমণ্ডল ছিল রাজনৈতিক। আমার বাবা এবং চাচারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে। ফলে, একটি আওয়ামী-বিরোধী মানসিকতার মধ্য দিয়েই আমি বড় হয়েছি। একারণে আমাদের বাসায় রাজনীতি এবং সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত চর্চা হতো। আমার ২০০৮ সালের নির্বাচন, ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং ২০১৩ সালের আন্দোলনের কথা স্পষ্টভাবে মনে আছে। আমার পুরো কৈশোরকাল কেটেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই ফ্যাসিবাদী শাসনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এবং এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুনেই আমি বড় হয়েছি।
দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার জীবনের একটি মাইলফলক ছিল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর আমি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না হলেও, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে এক ধরনের ভাবনা এবং এটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে কাজ করত। ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে কাজ করার একটি তীব্র তাড়না আমি অনুভব করতাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এখানকার বাস্তবতা দেখে আমি ভীষণ হতাশ হয়েছিলাম। আমি দেখেছি ছাত্রলীগের নিপীড়ন-নির্যাতন, হলের গণরুম ও গেস্টরুমের অমানবিক সংস্কৃতি, এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ অভাব। এমনকি একাডেমিক দিক থেকেও এখানকার চর্চা বা শিক্ষকদের মান খুব উন্নত ছিল না। এই পুঞ্জীভূত হতাশার মধ্যেই ২০১৮ সালের দুটি বড় আন্দোলন—কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—আমাদের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলে।

ইফতেখার মাহমুদ: ওই সময় তো আপনারা নুরুল হক নুরের সঙ্গে ছিলেন। পেছনের একটি দলের সঙ্গে ছিলেন…
নাহিদ ইসলাম: আন্দোলনে তো আসলে কারো নেতৃত্বে আমরা যাইনি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যুক্ত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে ডাকসু নির্বাচনে আমি তাদের (ছাত্র অধিকার পরিষদ) প্যানেল থেকে অংশ নিই। আমার ছাত্রজীবনের এই তিনটি ঘটনা—২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ডাকসু নির্বাচন—আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে আমি মনে করি।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনার রাজনৈতিক চিন্তাকে শাণিত করতে বা আপনাকে এই পথে আরও দৃঢ়ভাবে চলতে কোনো বিশেষ ব্যক্তি, রাজনৈতিক ধারা বা কোনো নির্দিষ্ট বই কি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে? যদি উদাহরণসহ বলতেন।
নাহিদ ইসলাম: না, ঠিক তেমনটা বলা যাবে না। রাজনৈতিক বইপত্রসহ অন্যান্য বিষয়ে আমার বরাবরই আগ্রহ ছিল, এবং আমরা নিয়মিত পাঠচক্র করতাম। এই পাঠচক্রগুলোতে আমরা কোনো নির্দিষ্ট আদর্শিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, মুক্তভাবে বাংলাদেশ ও এর রাজনীতিকে বোঝার চেষ্টা করতাম। এর ফলে, আমাদের সাথে নানা মতাদর্শের সেই সংযোগ বা সংমিশ্রণটা আসলে ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আমাদের ডানপন্থী ও বামপন্থী—উভয় বলয়ের সাথেই যোগাযোগ ছিল। আমরা উভয় ধারার সাহিত্যের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছি এবং নির্মোহভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি যে, এই মতাদর্শগুলো কেন ব্যর্থ হচ্ছে।
ইফতেখার মাহমুদ: যেমন? দু-একটি উদাহরণ দিবেন…
নাহিদ ইসলাম: আমরা মার্ক্সবাদী সাহিত্য থেকে শুরু করে পলিটিক্যাল ইসলামের বিভিন্ন তাত্ত্বিক লেখা এবং আমাদের জাতীয়তাবাদী ধারার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব—যেমন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম এবং শেখ মুজিবুর রহমান—সকলের রাজনৈতিক দর্শন ও অভিজ্ঞতা বোঝার চেষ্টা করেছি।
এর পাশাপাশি, আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলো—যেমন দেশভাগ, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান—গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক অভিযাত্রা এবং তার গতিপথকে বোঝা। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, ইতিহাসকে সঠিকভাবে বুঝতে পারলেই বর্তমান সময়ে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এবং আমাদের সমাজ ও রাজনীতির মূল সংকটগুলো কোথায়, তা অনুধাবন করা সম্ভব। তাই আমি বলব না যে, কোনো একটি বিশেষ বই বা ব্যক্তিত্ব আমাকে এককভাবে অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত করেছে। বরং আমি বলব, আমরা একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যেই বেড়ে উঠেছি এবং বহু মত ও পথের সারসংক্ষেপ থেকেই আমাদের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে।
ইফতেখার মাহমুদ: এবার একটু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আসি। অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক সাফল্য, গণমানুষের লড়াই বা কোনো আন্তর্জাতিক আন্দোলন কি আপনাকে বা আপনাদের অনুপ্রাণিত করেছে?
নাহিদ ইসলাম: আরব স্প্রিং-এর মতো বড় আন্দোলনগুলো কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে এবং অনেক দেশে, যেমন মিশরসহ অন্যান্য জায়গায়, সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। আবার কিছু দেশে ইতিবাচক পরিবর্তনও এসেছে। এগুলোর ব্যাপারে আমাদের মূল্যায়ন ছিল কি না এবং সেখান থেকে কোনো সাফল্যকে মাথায় নিয়ে আমরা রাজনৈতিক লড়াই শুরু করেছিলাম কি না—এখানে আমি বলব, না, আমরা বরং দক্ষিণ এশিয়ায় যে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটছিল, সেদিকেই মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। আমরা দেখছিলাম, ভারতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সেখানকার তরুণরা লড়াই করছে এবং সেখানে মুসলিমদের ওপর যে নিপীড়ন চলছিল, তার একটি প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছিল। একারণেই আমরা ভারতের এনআরসি ও সিএএ-এর মতো আন্দোলনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছিলাম এবং শাহীনবাগের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম।
এর পাশাপাশি আমরা দেখছিলাম যে, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে জেগে উঠছে এবং বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন দল তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়গুলোই আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করত। যেমন, ভারতে আমরা দেখেছি দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আম আদমি পার্টির উত্থান ঘটেছে। একইভাবে, শ্রীলঙ্কার আন্দোলনেও তরুণরা পুরোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছিল।

ইফতেখার মাহমুদ: তরুণ প্রজন্ম বা সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ ধরনের আন্দোলনগুলো আপনাদের রাজনৈতিক কল্পনা বা সংগ্রামে কতটা প্রভাব ফেলেছে? এগুলো কি কোনোভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল আপনাদেরকে?
নাহিদ ইসলাম: হ্যাঁ, ঐ ইমাজিনেশনটা খুবই কাজ করেছে। আমার মনে আছে, ৪ঠা আগস্টের দিকেও সবাই ফেসবুকে লিখছিল যে, আন্দোলনকারীরা গণভবনে যাবে, সেখানকার সুইমিংপুলে নামবে। এই ধারণাটি যে শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপের মতো দেশগুলোতে লক্ষ্য করছিলাম যে, সেখানে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হচ্ছে, যাদের বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল।
এমনকি ৫ই আগস্টের পর, গত দেড় বছরেও আমরা দেখেছি, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এমন গণঅভ্যুত্থান ঘটছে। এই আন্দোলনগুলোর মধ্যে আমরা কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি—যেমন চাকরির দাবি বা কর্মসংস্থানের মতো অর্থনৈতিক দাবি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশেও এই বিষয়গুলোই গণজাগরণের মূল চালিকাশক্তি ছিল। ২০১৮ সালেও তরুণরা কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নেমেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাসটি দৃঢ় হয়েছিল যে, এ দেশেও একটি নতুন প্রজন্মকে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের সংগঠিত করা প্রয়োজন। এই বিশ্বাসটি আমাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকেও শক্তি পেয়েছিল। যেমন, ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে যে ছাত্র আন্দোলনগুলো হয়েছিল, তার প্রভাবেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ প্রশস্ত হয়। একইভাবে, আশির দশকেও স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং ইসলামপন্থী ধারার সাহিত্য ও রাজনীতির বিকাশ ঘটেছিল। তাই আমরা অনুভব করতাম যে, বাংলাদেশে বিগত ১৬ বছরের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নতুন প্রজন্মের উত্থান অবশ্যম্ভাবী।
আর অভ্যুত্থানের ঠিক আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা আমাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আপনারা দেখবেন, জুলাই মাসের আগের প্রায় ছয় মাস ধরে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের সমর্থনে ধারাবাহিকভাবে বড় বড় কর্মসূচি পালন করেছিলাম।
ইফতেখার মাহমুদ: ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মুভমেন্টটাও তো মনে হয় আপনাদের মুভমেন্টে…
নাহিদ ইসলাম: হ্যাঁ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক ছাত্র আন্দোলনগুলোও সেই সময়ে আমাদেরকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। বিশ্বজুড়ে তরুণরা যখন অর্থনৈতিক বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য বা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছিল—তা দক্ষিণ এশিয়ায় হোক বা ফিলিস্তিনে—আমরা সেই প্রতিটি সংগ্রামের সঙ্গেই একাত্মতা অনুভব করতাম। আমরা নিজেদেরকে সেই বৈশ্বিক মুক্তি আন্দোলনেরই একটি অংশ হিসেবে দেখতাম।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি উল্লেখ করেছেন যে আপনাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়া মূলত বিভিন্ন ঘটনা ও আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকে। আপনারা আপনাদের দলকে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে পরিচয় দেন, যা অনেকের কাছে একটি বিমূর্ত ধারণা। আপনার নিজের এবং আপনার দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি ঠিক কী? আপনারা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে ঠিক কোন কাঠামোতে দেখতে চান?
নাহিদ ইসলাম: সত্যি বলতে, গত দেড় বছরে সাংগঠনিক বিস্তারের খুব একটা সুযোগ আমরা পাইনি। ৫ই আগস্টের আগের তৎপরতা এবং সেই সময়ে তৈরি হওয়া কিছু লিটারেচারের ওপর ভিত্তি করেই আমরা এখনও এগিয়ে যাচ্ছি। আপনি ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’-এর কথা বললেন—আমরা আসলে নিজেদেরকে তেমন কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, একটি দায় ও দরদের সমাজ গঠন এবং একটি সভ্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ, যেখানে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত হবে।
একারণেই, আমরা যেমন কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চাই না, তেমনি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত সেক্যুলারিস্ট রাষ্ট্রের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করি। আমাদের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে বহু ভাষা ও সংস্কৃতির অবাধ চর্চা নিশ্চিত হবে। এবং একইসাথে, আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব রাষ্ট্র, সমাজ এবং রাজনীতিতে প্রতিফলিত হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: তার মানে কি আপনাদের রাজনৈতিক ধারার বিকাশকে আপনারা একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখছেন, যা সময়ের সাথে সাথে আরও স্পষ্ট ও বিকশিত হবে?
নাহিদ ইসলাম: এই বিষয়গুলো আসলে চর্চার ভিতর দিয়েই আমাদেরকে নিয়ে আসতে হবে। আমরা গণতন্ত্রের কথা বললেও, অতীতে আমরা আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র দেখেছি, বিএনপির গণতন্ত্রও দেখেছি। তাই আমাদের কাছে মূল চ্যালেঞ্জ হলো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, এবং গত এক বছর ধরে ‘সংস্কার’-এর নামে আমরা মূলত সেই লড়াইটাই করে যাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত, ধর্মের বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। এটি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এখানে ইসলাম ও এর সামাজিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোই প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এ ধরনের বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা রয়েছে। সর্বোপরি, সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান আমাদের চিন্তাভাবনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে এবং আমরা দলের অভ্যন্তরে সেই নতুন উপলব্ধিগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করছি।
ইফতেখার মাহমুদ: রাজনীতিবিদদের মানুষ নানা রূপে দেখে থাকে। আপনাকে জনসমক্ষে বা গণমাধ্যমে তুলনামূলকভাবে কিছুটা গম্ভীর বা সিরিয়াস ভঙ্গিমায় দেখা যায়। আপনাকে মানুষ হাসতেও কম দেখে, কারণ কি?
নাহিদ ইসলাম: না, আসলে আমার ব্যক্তিত্ব মোটামুটি এরকমই। যারা আমাকে দীর্ঘদিন ধরে চিনেন, তারা জানেন আমি একটু কম কথাই বলি। আবার হয়তো নিজেদের সার্কেলে আমি খুবই নিজেকে মেলে ধরতে পারি। বাট, আমি একটু কম কথার মানুষ।
ইফতেখার মাহমুদ: একবার একটি নৌকা ভ্রমণের সময় বন্ধুদের সঙ্গে আপনার গান গাওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে আপনার এক ভিন্ন রূপ প্রকাশ পেয়েছে। নিশ্চয়ই নিজস্ব আড্ডায় এগুলো চলে। নাকি?
নাহিদ ইসলাম: না, গানের মধ্যে আমি তেমন একটা ছিলামনা। তবে আড্ডা ও বন্ধুত্ব আমার জীবনের একটি বড় অংশ। সত্যি বলতে, আমাদের রাজনীতিটাই গড়ে উঠেছে আড্ডাকে কেন্দ্র করে; আমাদের কাজের ধরনটাই ছিল আড্ডার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আমাদের চিনত, তারা ভাবত আমরা কেবলই আড্ডাবাজি করি—আমরা যে রাজনীতি করছি, সেটা তারা মনেই করত না। একারণে, আমাদের পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাই কেটেছে নানা ধরনের আড্ডার মধ্য দিয়ে।
আমাদের রাজনীতি এগিয়েছে মূলত গল্প আর আড্ডার পথ ধরেই। আমরা যে খুব সিরিয়াস বা কাঠামোগত ‘পাঠচক্র’ বা ‘স্কুলিং’-এর মধ্য দিয়ে গিয়েছি, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং ফরমাল পাঠচক্রের চেয়ে ইনফরমাল আড্ডাতেই আমরা বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলাম।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি উল্লেখ করেছেন যে, আপনাদের রাজনীতি আড্ডার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের সেই আড্ডার কেন্দ্রগুলো কোথায় ছিল এবং সেই সময়কার পরিবেশ কেমন ছিল?
নাহিদ ইসলাম: আমাদের আড্ডার মূল কেন্দ্র ছিল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনের চত্বর। এছাড়া আমরা বটতলা এবং টিএসসিতেও আড্ডা দিতাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একটি সর্বগ্রাসী রূপ দেখেছি। টিএসসি, উদ্যানসহ আড্ডা দেওয়ার মতো যতগুলো পাবলিক স্পেস ছিল, তার সবগুলোই তারা একরকম দখলে রেখেছিল। তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিই একমাত্র বিকল্প জায়গা, কারণ সেটি তুলনামূলকভাবে মুক্ত ছিল; ছাত্রলীগের আনাগোনা সেখানে কম ছিল। ফলে আমরা ভেতরে কিছুক্ষণ পড়াশোনা এবং বাইরে বেরিয়ে এসে আড্ডা—দুটিই চালিয়ে যেতে পারতাম।
বলা যায়, ক্যাম্পাসে তাদের এই সর্বগ্রাসী অবস্থানই আমাদেরকে লাইব্রেরির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম, ওই জায়গাটাই ফাঁকা পড়ে আছে, তাই আমরা সেখানেই বেশি সময় কাটাতে শুরু করি এবং ধীরে ধীরে সেখানকার নিয়মিত ও কর্মীদের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি গড়ে ওঠে। এই কৌশলটি পরবর্তীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আমাদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। কারণ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসত, তখন সেটি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো।
ইফতেখার মাহমুদ: বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোর মতো বন্ধুদের সঙ্গে এখনও কি আগের মতো আড্ডা হয়, নাকি রাজনীতির ব্যস্ততা এখন আপনার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে?
নাহিদ ইসলাম: এখন তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা মানেই মূলত রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গ। দেখা যায়, যারা বন্ধু, তারাই এখন রাজনীতির সহকর্মী; তাই বন্ধুত্ব, আড্ডা এবং দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের সাথেই কাটে।

ইফতেখার মাহমুদ: সারাদিন রাজনীতির মতো একটি জটিল ও চাপপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? এই ক্লান্তি দূর করতে কী করেন?
নাহিদ ইসলাম: সেটা তো কিছুটা লাগে। তখন মাঝে মাঝে চেষ্টা করি একটু পরিবারের সাথে সময় কাটাতে। পরিবারকে সময় দিতে।
ইফতেখার মাহমুদ: যখন আপনি ছাত্র রাজনীতি, আড্ডা এবং নিজেকে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন, তখন আপনার পরিবার বিষয়টি কীভাবে দেখত? তারা কি বুঝতে পারছিলেন যে তাদের সন্তান ধীরে ধীরে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তৈরি হচ্ছে, নাকি তাদের প্রত্যাশা ভিন্ন ছিল?
নাহিদ ইসলাম: পরিবার থেকে যে খুব সমর্থন ছিল এরকম না বা খুব বিরোধিতা ছিল এরকমও না। তারা আমার সম্পৃক্ততার বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পারলেও, এটি যে এই পর্যায়ে, এত মাত্রায় হবে তা বুঝতে পারেনি হয়তো। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো আমার বাবা-মায়েরও স্বপ্ন ছিল, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটি সরকারি চাকরি করব বা বিদেশে চলে যাব—আমার কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল এটাই। কিন্তু যখন আমি ২০১৮ সালের আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ডাকসু নির্বাচনে যুক্ত হলাম, তখন তারা বুঝতে পারলেন যে আমি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে জড়িত। তবে আমার সম্পৃক্ততা যে এতটা ব্যাপক হবে এবং শেষ পর্যন্ত এই পর্যায়ে এসে পৌঁছাবে, তা তারাও হয়তো ভাবতে পারেননি। ফলে এক ধরনের প্রশ্রয় থাকলেও, জোরালো সমর্থন ছিল না।
এই সমর্থনের ক্ষেত্রে বাবা ও মায়ের অবস্থান ছিল ভিন্ন। বাবা নিজে রাজনীতি করার কারণে বিষয়গুলো বুঝতেন। এমনকি এমনও সময় গেছে যখন বাবা জেলে, আর আমি বাইরে ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা চালাচ্ছি। আর যেহেতু আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছিলাম, তাই তার এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। অন্যদিকে, মা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল যে, এসবের কারণে আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এবং তিনি সবসময় সেই বিষয়গুলোতেই বেশি জোর দিতেন।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনার আন্দোলন বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময়কার এমন কোনো বিশেষ ঘটনার কথা কি মনে পড়ে, যা থেকে পরিবারের শাসন এবং একই সঙ্গে নীরব সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে?
নাহিদ ইসলাম: আন্দোলনের সময়কার একটি ঘটনার কথা বলি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আমি একবার মারাত্মকভাবে আহত হই; আমার হাত ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। তো বাসা থেকে কোনোভাবেই আর পরের দিন আসতে দিবে না। কিন্তু পরে আবার আমার জোরাজুরিতে তারা একটা পর্যায়ে রাজি হচ্ছে বা আসতে দিচ্ছে। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, আমি জোর করেই বেরিয়ে আসতাম, কিন্তু তারা আমার জেদ দেখে বাধা দিত না, আবার মুখে স্পষ্টভাবে যাওয়ার অনুমতিও দিত না—এক ধরনের দোটানার মধ্যে থাকতো। তবে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের সময় পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। এই আন্দোলনে আমার পরিবারকে যেমন ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, তেমনি তারা সর্বাত্মক সমর্থনও দিয়েছে। আমার মা প্রায় প্রতিদিনই ডিবি অফিসের সামনে গিয়ে বসে থাকতেন, এক থানা থেকে অন্য থানায় ছুটে বেড়িয়েছেন। বাবার ওপরও প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, যে কারণে সেই সময়টায় তাকেও বাসার বাইরে পালিয়ে থাকতে হয়েছে।
আসলে, গত পাঁচ-সাত বছর ধরে আমাদের জীবনটা এভাবেই কেটেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাবাকে প্রায়ই বাসার বাইরে থাকতে হতো, মা সারাক্ষণ গ্রেপ্তারের আতঙ্কে দিন কাটাতেন, আর আমাদের সময় কাটত কোর্ট, জেলখানা আর ক্যাম্পাসে হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে—এই চক্রের মধ্যেই।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি যদি আপনার সচেতন রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা নির্দিষ্ট করতে চান, তাহলে এই যাত্রা কত বছরের বলে মনে করেন?
নাহিদ ইসলাম: আমি তো বলব ১৮ সাল থেকেই…। ওই আন্দোলনের সময় থেকেই আমি সচেতনভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হই। অর্থাৎ রাজনৈতিক যাত্রা প্রায় ছয় বছরের।
ইফতেখার মাহমুদ: আমরা জানি আপনার সহযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই শিল্প-সাহিত্য বা চলচ্চিত্র চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আপনার ক্ষেত্রে বই পড়া বা রাজনীতির বাইরে গান, সিনেমা বা অন্য কোনো সাংস্কৃতিক মাধ্যমের প্রতি কি বিশেষ অনুরাগ ছিল?
নাহিদ ইসলাম: না, আমি শিল্প-সংস্কৃতির জগতে অতটা সক্রিয় ছিলাম না। যেমন, মাহফুজ ভাই আর্ট-কালচারের নানা ধরনের কর্মকাণ্ড এবং সিনেমার প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু আমি গান বা সিনেমার জগতে তেমন ছিলাম না। অবশ্য, কলেজ জীবনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে কিছু সিনেমা দেখেছি—যেগুলো তখন প্রচলিত বা জনপ্রিয় ছিল, তেমন কিছু বাংলা ও ইংরেজি সিনেমা। তবে আমি খুব বেশি দেখিনি; সিনেমা বা গানের জগৎ থেকে আমি বরাবরই কিছুটা দূরে।

আমার মূল আগ্রহ ছিল সাহিত্যের প্রতি। কলেজ জীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ ছিল এবং প্রথমদিকে আমার ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ারও ইচ্ছা ছিল। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত আমি নিয়মিত বই পড়তাম। আমার পাঠের তালিকায় ছিল বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক ধারার কবিতা ও গদ্য। আমি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ এবং আল মাহমুদের মতো কবিদের ক্লাসিক কবিতাগুলো পড়েছি। সাহিত্যের প্রতি আমার এই আগ্রহের কারণে আমার অনেক বন্ধুবান্ধবও ছিল যারা সাহিত্যচর্চার সঙ্গে, এমনকি ‘লিটল ম্যাগ’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিল। যদিও আমাদের সময়ে লিটল ম্যাগের চর্চা অনেকটাই কমে এসেছিল, তবুও এই পরিমণ্ডলের সাথে আমার এক ধরনের সংযোগ ছিল।
আমার পরিবারের একজন সদস্য, আমার স্ত্রী, তিনিও লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। তবে গানের বিষয়টি সম্ভবত কোনো ভুল বোঝাবুঝি। আমি কখনোই গানের সাথে যুক্ত ছিলাম না, আর আমার কণ্ঠও অত ভালো নয়।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি আপনার রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করছেন। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
নাহিদ ইসলাম: রাজনীতিতে আমি শুরু থেকেই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চেয়ে একটি সামষ্টিক ধারণায় বেশি বিশ্বাসী। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবার চেয়ে, আমাদের প্রজন্ম বা একটি সামষ্টিক সত্তা হিসেবেই চিন্তা করি। তাছাড়া, আমাদের এই যাত্রার সঙ্গে এখন বহু মানুষের আত্মত্যাগ জড়িত, যা বিষয়টিকে আরও গুরুদায়িত্ব করে তুলেছে।
আমরা যেমন একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছি, তেমনি আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ১০ বছরের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি এবং আমার বিশ্বাস, এই ১০ বছরের মধ্যেই আমরা বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হব, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাব এবং সরকার গঠন করব।
যদি এই ১০ বছরের মধ্যে আমরা আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে না পারি, অর্থাৎ জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমি আর রাজনীতি করব না। এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কারণ আমি সারাজীবন রাজনীতি করার মানসিকতা রাখি না। তাই এই ১০ বছরের সময়সীমাটিই আমার মূল টার্গেট। এই সময়ের মধ্যেই আমি আমাদের রাজনৈতিক দলটিকে প্রতিষ্ঠা করতে, সরকার গঠন করতে এবং আমাদের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই। যদি তা সম্ভব না হয়, আমি এই পথ থেকে সরে দাঁড়াব, কারণ আমি মনে করি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ১০ বছরই যথেষ্ট।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি ১০ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছেন, যা রাজনীতিতে বিরল। যেখানে বহু রাজনীতিবিদ আজীবন ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকেন, সেখানে আপনার এই ১০ বছরের পরিকল্পনার পেছনের কারণ বা দর্শনটা কী?
নাহিদ ইসলাম: আমরা তো দেখি, অনেক রাজনৈতিক দল বছরের পর বছর ধরে রাজনীতি করেও সফলতা পায় না; আবার অনেকে সফলতা পেয়েও তা ধরে রাখতে পারে না। একারণেই আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজের জন্য দশ বছরের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছি, যা দুটি নির্বাচনী টার্মের সমান। এই দশ বছরই আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য।
আর আমি মনে করি, আমরা ইতোমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দশ বা পনেরো বছরে যে অবস্থানে পৌঁছায়, আমরা সেই জায়গায় ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছি। একারণেই আমি দশ বছরের কথা বলছি, কারণ সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান আমাদের যাত্রাকে দশ থেকে পনেরো বছর এগিয়ে দিয়েছে। এখন বাকি কাজটুকু আমাদেরকেই করতে হবে। জনগণ আমাদের ওপর সেই সুযোগ ও দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এখন বাকি পথটুকু আমাদের নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও নিষ্ঠা দিয়েই অতিক্রম করতে হবে।
ইফতেখার মাহমুদ: এটা কি ৫ই আগস্টের আন্দোলনের আগে থেকেই আপনারা এভাবে ভাবতেন নাকি ৫ই আগস্টের পরে রাজনৈতিক দল গঠন করার পরে আপনি এরকম ভাবলেন যে আমরা ১০ বছরের একটা টার্গেট...
নাহিদ ইসলাম: ৫ই আগস্টের আগে আমি ঠিক এভাবে ভাবিনি। তখন আমাদের কৌশল ও পরিকল্পনা কিছুটা ভিন্ন ছিল, কারণ এই ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন কখন বা কীভাবে ঘটবে, সে বিষয়ে আমরা কেউই নিশ্চিত ছিলাম না। তবে আমরা যে রাজনীতিতে থাকব এবং দেশের জাতীয় রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আসবে—এই বিষয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম। ৫ই আগস্টের পরেই মূলত আমার এই ভাবনাটি আরও দৃঢ় হয়। আর এটি আমার ব্যক্তিগত একটি ভাবনা যে, দল হয়তো ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে, কিন্তু আমার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হলো আগামী দশ বছরের মধ্যে এই দলটিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে যাওয়া।
ইফতেখার মাহমুদ: ঠিক আছে, আপনার প্রতি আমাদের শুভকামনা রইল। ঢাকা স্ট্রিমের জন্য যদি কিছু বলেন।
নাহিদ ইসলাম: আপনাদেরকে এবং ঢাকা স্ট্রিমের সকল দর্শককে ধন্যবাদ। ৫ই আগস্টের পর একটি নতুন গণমাধ্যম হিসেবে ঢাকা স্ট্রিমের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, এবং আমি মনে করি এটিও গণঅভ্যুত্থানেরই একটি ফসল। এ কারণে, আমাদের দল এনসিপি-র প্রতি যেমন জনগণের অনেক প্রত্যাশা ও চাপ রয়েছে, আমি মনে করি ঢাকা স্ট্রিমের প্রতিও একই ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কারণ গত ১৬ বছরে আমরা পুরোনো গণমাধ্যমগুলোর একমুখী চরিত্র দেখেছি। তাই আমাদেরও প্রত্যাশা থাকবে, ঢাকা স্ট্রিম গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে বাংলাদেশকে নতুন কিছু উপহার দেবে।

নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দশ বা পনেরো বছরে যে অবস্থানে পৌঁছায়, তারা সেই জায়গায় ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন। তিনি বলেন, এখন বাকি পথটুকু আমাদের নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও নিষ্ঠা দিয়েই অতিক্রম করতে হবে। সাক্ষাৎকারটি নিচে দেওয়া হলো:
ইফতেখার মাহমুদ: নাহিদ ইসলাম আজ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির একজন পরিচিত মুখ। আপনার এই রাজনৈতিক যাত্রার সূচনা বিন্দু কোনটি? শৈশব এবং পারিবারিক আবহ, নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন—কোন সময়টিকে আপনি রাজনীতির পথে আসার টার্নিং পয়েন্ট বা মূল অনুঘটক হিসেবে বিবেচনা করেন?
নাহিদ ইসলাম: আমার বেড়ে ওঠার পেছনে বেশ কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, আমার পারিবারিক পরিমণ্ডল ছিল রাজনৈতিক। আমার বাবা এবং চাচারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে। ফলে, একটি আওয়ামী-বিরোধী মানসিকতার মধ্য দিয়েই আমি বড় হয়েছি। একারণে আমাদের বাসায় রাজনীতি এবং সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত চর্চা হতো। আমার ২০০৮ সালের নির্বাচন, ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং ২০১৩ সালের আন্দোলনের কথা স্পষ্টভাবে মনে আছে। আমার পুরো কৈশোরকাল কেটেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই ফ্যাসিবাদী শাসনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এবং এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুনেই আমি বড় হয়েছি।
দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার জীবনের একটি মাইলফলক ছিল। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর আমি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত না হলেও, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে এক ধরনের ভাবনা এবং এটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে কাজ করত। ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে কাজ করার একটি তীব্র তাড়না আমি অনুভব করতাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এখানকার বাস্তবতা দেখে আমি ভীষণ হতাশ হয়েছিলাম। আমি দেখেছি ছাত্রলীগের নিপীড়ন-নির্যাতন, হলের গণরুম ও গেস্টরুমের অমানবিক সংস্কৃতি, এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ অভাব। এমনকি একাডেমিক দিক থেকেও এখানকার চর্চা বা শিক্ষকদের মান খুব উন্নত ছিল না। এই পুঞ্জীভূত হতাশার মধ্যেই ২০১৮ সালের দুটি বড় আন্দোলন—কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—আমাদের জীবনে বিশাল প্রভাব ফেলে।

ইফতেখার মাহমুদ: ওই সময় তো আপনারা নুরুল হক নুরের সঙ্গে ছিলেন। পেছনের একটি দলের সঙ্গে ছিলেন…
নাহিদ ইসলাম: আন্দোলনে তো আসলে কারো নেতৃত্বে আমরা যাইনি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যুক্ত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে ডাকসু নির্বাচনে আমি তাদের (ছাত্র অধিকার পরিষদ) প্যানেল থেকে অংশ নিই। আমার ছাত্রজীবনের এই তিনটি ঘটনা—২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ডাকসু নির্বাচন—আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল বলে আমি মনে করি।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনার রাজনৈতিক চিন্তাকে শাণিত করতে বা আপনাকে এই পথে আরও দৃঢ়ভাবে চলতে কোনো বিশেষ ব্যক্তি, রাজনৈতিক ধারা বা কোনো নির্দিষ্ট বই কি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে? যদি উদাহরণসহ বলতেন।
নাহিদ ইসলাম: না, ঠিক তেমনটা বলা যাবে না। রাজনৈতিক বইপত্রসহ অন্যান্য বিষয়ে আমার বরাবরই আগ্রহ ছিল, এবং আমরা নিয়মিত পাঠচক্র করতাম। এই পাঠচক্রগুলোতে আমরা কোনো নির্দিষ্ট আদর্শিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, মুক্তভাবে বাংলাদেশ ও এর রাজনীতিকে বোঝার চেষ্টা করতাম। এর ফলে, আমাদের সাথে নানা মতাদর্শের সেই সংযোগ বা সংমিশ্রণটা আসলে ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই আমাদের ডানপন্থী ও বামপন্থী—উভয় বলয়ের সাথেই যোগাযোগ ছিল। আমরা উভয় ধারার সাহিত্যের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছি এবং নির্মোহভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি যে, এই মতাদর্শগুলো কেন ব্যর্থ হচ্ছে।
ইফতেখার মাহমুদ: যেমন? দু-একটি উদাহরণ দিবেন…
নাহিদ ইসলাম: আমরা মার্ক্সবাদী সাহিত্য থেকে শুরু করে পলিটিক্যাল ইসলামের বিভিন্ন তাত্ত্বিক লেখা এবং আমাদের জাতীয়তাবাদী ধারার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব—যেমন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম এবং শেখ মুজিবুর রহমান—সকলের রাজনৈতিক দর্শন ও অভিজ্ঞতা বোঝার চেষ্টা করেছি।
এর পাশাপাশি, আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলো—যেমন দেশভাগ, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান—গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানের ঐতিহাসিক অভিযাত্রা এবং তার গতিপথকে বোঝা। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, ইতিহাসকে সঠিকভাবে বুঝতে পারলেই বর্তমান সময়ে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এবং আমাদের সমাজ ও রাজনীতির মূল সংকটগুলো কোথায়, তা অনুধাবন করা সম্ভব। তাই আমি বলব না যে, কোনো একটি বিশেষ বই বা ব্যক্তিত্ব আমাকে এককভাবে অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত করেছে। বরং আমি বলব, আমরা একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যেই বেড়ে উঠেছি এবং বহু মত ও পথের সারসংক্ষেপ থেকেই আমাদের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে।
ইফতেখার মাহমুদ: এবার একটু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আসি। অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক সাফল্য, গণমানুষের লড়াই বা কোনো আন্তর্জাতিক আন্দোলন কি আপনাকে বা আপনাদের অনুপ্রাণিত করেছে?
নাহিদ ইসলাম: আরব স্প্রিং-এর মতো বড় আন্দোলনগুলো কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে এবং অনেক দেশে, যেমন মিশরসহ অন্যান্য জায়গায়, সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। আবার কিছু দেশে ইতিবাচক পরিবর্তনও এসেছে। এগুলোর ব্যাপারে আমাদের মূল্যায়ন ছিল কি না এবং সেখান থেকে কোনো সাফল্যকে মাথায় নিয়ে আমরা রাজনৈতিক লড়াই শুরু করেছিলাম কি না—এখানে আমি বলব, না, আমরা বরং দক্ষিণ এশিয়ায় যে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটছিল, সেদিকেই মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। আমরা দেখছিলাম, ভারতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সেখানকার তরুণরা লড়াই করছে এবং সেখানে মুসলিমদের ওপর যে নিপীড়ন চলছিল, তার একটি প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছিল। একারণেই আমরা ভারতের এনআরসি ও সিএএ-এর মতো আন্দোলনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছিলাম এবং শাহীনবাগের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম।
এর পাশাপাশি আমরা দেখছিলাম যে, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে জেগে উঠছে এবং বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন দল তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়গুলোই আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করত। যেমন, ভারতে আমরা দেখেছি দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আম আদমি পার্টির উত্থান ঘটেছে। একইভাবে, শ্রীলঙ্কার আন্দোলনেও তরুণরা পুরোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছিল।

ইফতেখার মাহমুদ: তরুণ প্রজন্ম বা সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ ধরনের আন্দোলনগুলো আপনাদের রাজনৈতিক কল্পনা বা সংগ্রামে কতটা প্রভাব ফেলেছে? এগুলো কি কোনোভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল আপনাদেরকে?
নাহিদ ইসলাম: হ্যাঁ, ঐ ইমাজিনেশনটা খুবই কাজ করেছে। আমার মনে আছে, ৪ঠা আগস্টের দিকেও সবাই ফেসবুকে লিখছিল যে, আন্দোলনকারীরা গণভবনে যাবে, সেখানকার সুইমিংপুলে নামবে। এই ধারণাটি যে শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপের মতো দেশগুলোতে লক্ষ্য করছিলাম যে, সেখানে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি হচ্ছে, যাদের বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল।
এমনকি ৫ই আগস্টের পর, গত দেড় বছরেও আমরা দেখেছি, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এমন গণঅভ্যুত্থান ঘটছে। এই আন্দোলনগুলোর মধ্যে আমরা কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি—যেমন চাকরির দাবি বা কর্মসংস্থানের মতো অর্থনৈতিক দাবি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা। বাংলাদেশেও এই বিষয়গুলোই গণজাগরণের মূল চালিকাশক্তি ছিল। ২০১৮ সালেও তরুণরা কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নেমেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মধ্যে এই বিশ্বাসটি দৃঢ় হয়েছিল যে, এ দেশেও একটি নতুন প্রজন্মকে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের সংগঠিত করা প্রয়োজন। এই বিশ্বাসটি আমাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকেও শক্তি পেয়েছিল। যেমন, ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে যে ছাত্র আন্দোলনগুলো হয়েছিল, তার প্রভাবেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ প্রশস্ত হয়। একইভাবে, আশির দশকেও স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন এবং ইসলামপন্থী ধারার সাহিত্য ও রাজনীতির বিকাশ ঘটেছিল। তাই আমরা অনুভব করতাম যে, বাংলাদেশে বিগত ১৬ বছরের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নতুন প্রজন্মের উত্থান অবশ্যম্ভাবী।
আর অভ্যুত্থানের ঠিক আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা আমাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। আপনারা দেখবেন, জুলাই মাসের আগের প্রায় ছয় মাস ধরে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের সমর্থনে ধারাবাহিকভাবে বড় বড় কর্মসূচি পালন করেছিলাম।
ইফতেখার মাহমুদ: ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মুভমেন্টটাও তো মনে হয় আপনাদের মুভমেন্টে…
নাহিদ ইসলাম: হ্যাঁ, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক ছাত্র আন্দোলনগুলোও সেই সময়ে আমাদেরকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। বিশ্বজুড়ে তরুণরা যখন অর্থনৈতিক বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য বা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছিল—তা দক্ষিণ এশিয়ায় হোক বা ফিলিস্তিনে—আমরা সেই প্রতিটি সংগ্রামের সঙ্গেই একাত্মতা অনুভব করতাম। আমরা নিজেদেরকে সেই বৈশ্বিক মুক্তি আন্দোলনেরই একটি অংশ হিসেবে দেখতাম।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি উল্লেখ করেছেন যে আপনাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়া মূলত বিভিন্ন ঘটনা ও আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকে। আপনারা আপনাদের দলকে ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে পরিচয় দেন, যা অনেকের কাছে একটি বিমূর্ত ধারণা। আপনার নিজের এবং আপনার দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি ঠিক কী? আপনারা বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে ঠিক কোন কাঠামোতে দেখতে চান?
নাহিদ ইসলাম: সত্যি বলতে, গত দেড় বছরে সাংগঠনিক বিস্তারের খুব একটা সুযোগ আমরা পাইনি। ৫ই আগস্টের আগের তৎপরতা এবং সেই সময়ে তৈরি হওয়া কিছু লিটারেচারের ওপর ভিত্তি করেই আমরা এখনও এগিয়ে যাচ্ছি। আপনি ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’-এর কথা বললেন—আমরা আসলে নিজেদেরকে তেমন কোনো নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তির মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, একটি দায় ও দরদের সমাজ গঠন এবং একটি সভ্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ, যেখানে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা সুনিশ্চিত হবে।
একারণেই, আমরা যেমন কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চাই না, তেমনি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত সেক্যুলারিস্ট রাষ্ট্রের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করি। আমাদের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে বহু ভাষা ও সংস্কৃতির অবাধ চর্চা নিশ্চিত হবে। এবং একইসাথে, আমাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব রাষ্ট্র, সমাজ এবং রাজনীতিতে প্রতিফলিত হবে।

ইফতেখার মাহমুদ: তার মানে কি আপনাদের রাজনৈতিক ধারার বিকাশকে আপনারা একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখছেন, যা সময়ের সাথে সাথে আরও স্পষ্ট ও বিকশিত হবে?
নাহিদ ইসলাম: এই বিষয়গুলো আসলে চর্চার ভিতর দিয়েই আমাদেরকে নিয়ে আসতে হবে। আমরা গণতন্ত্রের কথা বললেও, অতীতে আমরা আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র দেখেছি, বিএনপির গণতন্ত্রও দেখেছি। তাই আমাদের কাছে মূল চ্যালেঞ্জ হলো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, এবং গত এক বছর ধরে ‘সংস্কার’-এর নামে আমরা মূলত সেই লড়াইটাই করে যাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত, ধর্মের বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। এটি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এখানে ইসলাম ও এর সামাজিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোই প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এ ধরনের বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা রয়েছে। সর্বোপরি, সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান আমাদের চিন্তাভাবনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে এবং আমরা দলের অভ্যন্তরে সেই নতুন উপলব্ধিগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করছি।
ইফতেখার মাহমুদ: রাজনীতিবিদদের মানুষ নানা রূপে দেখে থাকে। আপনাকে জনসমক্ষে বা গণমাধ্যমে তুলনামূলকভাবে কিছুটা গম্ভীর বা সিরিয়াস ভঙ্গিমায় দেখা যায়। আপনাকে মানুষ হাসতেও কম দেখে, কারণ কি?
নাহিদ ইসলাম: না, আসলে আমার ব্যক্তিত্ব মোটামুটি এরকমই। যারা আমাকে দীর্ঘদিন ধরে চিনেন, তারা জানেন আমি একটু কম কথাই বলি। আবার হয়তো নিজেদের সার্কেলে আমি খুবই নিজেকে মেলে ধরতে পারি। বাট, আমি একটু কম কথার মানুষ।
ইফতেখার মাহমুদ: একবার একটি নৌকা ভ্রমণের সময় বন্ধুদের সঙ্গে আপনার গান গাওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে আপনার এক ভিন্ন রূপ প্রকাশ পেয়েছে। নিশ্চয়ই নিজস্ব আড্ডায় এগুলো চলে। নাকি?
নাহিদ ইসলাম: না, গানের মধ্যে আমি তেমন একটা ছিলামনা। তবে আড্ডা ও বন্ধুত্ব আমার জীবনের একটি বড় অংশ। সত্যি বলতে, আমাদের রাজনীতিটাই গড়ে উঠেছে আড্ডাকে কেন্দ্র করে; আমাদের কাজের ধরনটাই ছিল আড্ডার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আমাদের চিনত, তারা ভাবত আমরা কেবলই আড্ডাবাজি করি—আমরা যে রাজনীতি করছি, সেটা তারা মনেই করত না। একারণে, আমাদের পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাই কেটেছে নানা ধরনের আড্ডার মধ্য দিয়ে।
আমাদের রাজনীতি এগিয়েছে মূলত গল্প আর আড্ডার পথ ধরেই। আমরা যে খুব সিরিয়াস বা কাঠামোগত ‘পাঠচক্র’ বা ‘স্কুলিং’-এর মধ্য দিয়ে গিয়েছি, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং ফরমাল পাঠচক্রের চেয়ে ইনফরমাল আড্ডাতেই আমরা বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলাম।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি উল্লেখ করেছেন যে, আপনাদের রাজনীতি আড্ডার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদের সেই আড্ডার কেন্দ্রগুলো কোথায় ছিল এবং সেই সময়কার পরিবেশ কেমন ছিল?
নাহিদ ইসলাম: আমাদের আড্ডার মূল কেন্দ্র ছিল কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনের চত্বর। এছাড়া আমরা বটতলা এবং টিএসসিতেও আড্ডা দিতাম। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের একটি সর্বগ্রাসী রূপ দেখেছি। টিএসসি, উদ্যানসহ আড্ডা দেওয়ার মতো যতগুলো পাবলিক স্পেস ছিল, তার সবগুলোই তারা একরকম দখলে রেখেছিল। তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিই একমাত্র বিকল্প জায়গা, কারণ সেটি তুলনামূলকভাবে মুক্ত ছিল; ছাত্রলীগের আনাগোনা সেখানে কম ছিল। ফলে আমরা ভেতরে কিছুক্ষণ পড়াশোনা এবং বাইরে বেরিয়ে এসে আড্ডা—দুটিই চালিয়ে যেতে পারতাম।
বলা যায়, ক্যাম্পাসে তাদের এই সর্বগ্রাসী অবস্থানই আমাদেরকে লাইব্রেরির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম, ওই জায়গাটাই ফাঁকা পড়ে আছে, তাই আমরা সেখানেই বেশি সময় কাটাতে শুরু করি এবং ধীরে ধীরে সেখানকার নিয়মিত ও কর্মীদের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি গড়ে ওঠে। এই কৌশলটি পরবর্তীতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আমাদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। কারণ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসত, তখন সেটি একটি শক্তিশালী কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো।
ইফতেখার মাহমুদ: বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোর মতো বন্ধুদের সঙ্গে এখনও কি আগের মতো আড্ডা হয়, নাকি রাজনীতির ব্যস্ততা এখন আপনার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে?
নাহিদ ইসলাম: এখন তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা মানেই মূলত রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গ। দেখা যায়, যারা বন্ধু, তারাই এখন রাজনীতির সহকর্মী; তাই বন্ধুত্ব, আড্ডা এবং দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের সাথেই কাটে।

ইফতেখার মাহমুদ: সারাদিন রাজনীতির মতো একটি জটিল ও চাপপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে থাকতে একঘেয়ে লাগে না? এই ক্লান্তি দূর করতে কী করেন?
নাহিদ ইসলাম: সেটা তো কিছুটা লাগে। তখন মাঝে মাঝে চেষ্টা করি একটু পরিবারের সাথে সময় কাটাতে। পরিবারকে সময় দিতে।
ইফতেখার মাহমুদ: যখন আপনি ছাত্র রাজনীতি, আড্ডা এবং নিজেকে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন, তখন আপনার পরিবার বিষয়টি কীভাবে দেখত? তারা কি বুঝতে পারছিলেন যে তাদের সন্তান ধীরে ধীরে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তৈরি হচ্ছে, নাকি তাদের প্রত্যাশা ভিন্ন ছিল?
নাহিদ ইসলাম: পরিবার থেকে যে খুব সমর্থন ছিল এরকম না বা খুব বিরোধিতা ছিল এরকমও না। তারা আমার সম্পৃক্ততার বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পারলেও, এটি যে এই পর্যায়ে, এত মাত্রায় হবে তা বুঝতে পারেনি হয়তো। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো আমার বাবা-মায়েরও স্বপ্ন ছিল, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটি সরকারি চাকরি করব বা বিদেশে চলে যাব—আমার কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল এটাই। কিন্তু যখন আমি ২০১৮ সালের আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ডাকসু নির্বাচনে যুক্ত হলাম, তখন তারা বুঝতে পারলেন যে আমি বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে জড়িত। তবে আমার সম্পৃক্ততা যে এতটা ব্যাপক হবে এবং শেষ পর্যন্ত এই পর্যায়ে এসে পৌঁছাবে, তা তারাও হয়তো ভাবতে পারেননি। ফলে এক ধরনের প্রশ্রয় থাকলেও, জোরালো সমর্থন ছিল না।
এই সমর্থনের ক্ষেত্রে বাবা ও মায়ের অবস্থান ছিল ভিন্ন। বাবা নিজে রাজনীতি করার কারণে বিষয়গুলো বুঝতেন। এমনকি এমনও সময় গেছে যখন বাবা জেলে, আর আমি বাইরে ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা চালাচ্ছি। আর যেহেতু আমি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছিলাম, তাই তার এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। অন্যদিকে, মা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল যে, এসবের কারণে আমার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এবং তিনি সবসময় সেই বিষয়গুলোতেই বেশি জোর দিতেন।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনার আন্দোলন বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময়কার এমন কোনো বিশেষ ঘটনার কথা কি মনে পড়ে, যা থেকে পরিবারের শাসন এবং একই সঙ্গে নীরব সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে?
নাহিদ ইসলাম: আন্দোলনের সময়কার একটি ঘটনার কথা বলি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আমি একবার মারাত্মকভাবে আহত হই; আমার হাত ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। তো বাসা থেকে কোনোভাবেই আর পরের দিন আসতে দিবে না। কিন্তু পরে আবার আমার জোরাজুরিতে তারা একটা পর্যায়ে রাজি হচ্ছে বা আসতে দিচ্ছে। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, আমি জোর করেই বেরিয়ে আসতাম, কিন্তু তারা আমার জেদ দেখে বাধা দিত না, আবার মুখে স্পষ্টভাবে যাওয়ার অনুমতিও দিত না—এক ধরনের দোটানার মধ্যে থাকতো। তবে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের সময় পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। এই আন্দোলনে আমার পরিবারকে যেমন ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, তেমনি তারা সর্বাত্মক সমর্থনও দিয়েছে। আমার মা প্রায় প্রতিদিনই ডিবি অফিসের সামনে গিয়ে বসে থাকতেন, এক থানা থেকে অন্য থানায় ছুটে বেড়িয়েছেন। বাবার ওপরও প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, যে কারণে সেই সময়টায় তাকেও বাসার বাইরে পালিয়ে থাকতে হয়েছে।
আসলে, গত পাঁচ-সাত বছর ধরে আমাদের জীবনটা এভাবেই কেটেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাবাকে প্রায়ই বাসার বাইরে থাকতে হতো, মা সারাক্ষণ গ্রেপ্তারের আতঙ্কে দিন কাটাতেন, আর আমাদের সময় কাটত কোর্ট, জেলখানা আর ক্যাম্পাসে হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে—এই চক্রের মধ্যেই।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি যদি আপনার সচেতন রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা নির্দিষ্ট করতে চান, তাহলে এই যাত্রা কত বছরের বলে মনে করেন?
নাহিদ ইসলাম: আমি তো বলব ১৮ সাল থেকেই…। ওই আন্দোলনের সময় থেকেই আমি সচেতনভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হই। অর্থাৎ রাজনৈতিক যাত্রা প্রায় ছয় বছরের।
ইফতেখার মাহমুদ: আমরা জানি আপনার সহযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই শিল্প-সাহিত্য বা চলচ্চিত্র চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আপনার ক্ষেত্রে বই পড়া বা রাজনীতির বাইরে গান, সিনেমা বা অন্য কোনো সাংস্কৃতিক মাধ্যমের প্রতি কি বিশেষ অনুরাগ ছিল?
নাহিদ ইসলাম: না, আমি শিল্প-সংস্কৃতির জগতে অতটা সক্রিয় ছিলাম না। যেমন, মাহফুজ ভাই আর্ট-কালচারের নানা ধরনের কর্মকাণ্ড এবং সিনেমার প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু আমি গান বা সিনেমার জগতে তেমন ছিলাম না। অবশ্য, কলেজ জীবনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকে কিছু সিনেমা দেখেছি—যেগুলো তখন প্রচলিত বা জনপ্রিয় ছিল, তেমন কিছু বাংলা ও ইংরেজি সিনেমা। তবে আমি খুব বেশি দেখিনি; সিনেমা বা গানের জগৎ থেকে আমি বরাবরই কিছুটা দূরে।

আমার মূল আগ্রহ ছিল সাহিত্যের প্রতি। কলেজ জীবন থেকেই সাহিত্যের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ ছিল এবং প্রথমদিকে আমার ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ারও ইচ্ছা ছিল। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত আমি নিয়মিত বই পড়তাম। আমার পাঠের তালিকায় ছিল বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক ধারার কবিতা ও গদ্য। আমি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ এবং আল মাহমুদের মতো কবিদের ক্লাসিক কবিতাগুলো পড়েছি। সাহিত্যের প্রতি আমার এই আগ্রহের কারণে আমার অনেক বন্ধুবান্ধবও ছিল যারা সাহিত্যচর্চার সঙ্গে, এমনকি ‘লিটল ম্যাগ’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিল। যদিও আমাদের সময়ে লিটল ম্যাগের চর্চা অনেকটাই কমে এসেছিল, তবুও এই পরিমণ্ডলের সাথে আমার এক ধরনের সংযোগ ছিল।
আমার পরিবারের একজন সদস্য, আমার স্ত্রী, তিনিও লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। তবে গানের বিষয়টি সম্ভবত কোনো ভুল বোঝাবুঝি। আমি কখনোই গানের সাথে যুক্ত ছিলাম না, আর আমার কণ্ঠও অত ভালো নয়।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি আপনার রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করছেন। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
নাহিদ ইসলাম: রাজনীতিতে আমি শুরু থেকেই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চেয়ে একটি সামষ্টিক ধারণায় বেশি বিশ্বাসী। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবার চেয়ে, আমাদের প্রজন্ম বা একটি সামষ্টিক সত্তা হিসেবেই চিন্তা করি। তাছাড়া, আমাদের এই যাত্রার সঙ্গে এখন বহু মানুষের আত্মত্যাগ জড়িত, যা বিষয়টিকে আরও গুরুদায়িত্ব করে তুলেছে।
আমরা যেমন একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতিতে এসেছি, তেমনি আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ১০ বছরের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি এবং আমার বিশ্বাস, এই ১০ বছরের মধ্যেই আমরা বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হব, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাব এবং সরকার গঠন করব।
যদি এই ১০ বছরের মধ্যে আমরা আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে না পারি, অর্থাৎ জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমি আর রাজনীতি করব না। এটা আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কারণ আমি সারাজীবন রাজনীতি করার মানসিকতা রাখি না। তাই এই ১০ বছরের সময়সীমাটিই আমার মূল টার্গেট। এই সময়ের মধ্যেই আমি আমাদের রাজনৈতিক দলটিকে প্রতিষ্ঠা করতে, সরকার গঠন করতে এবং আমাদের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে চাই। যদি তা সম্ভব না হয়, আমি এই পথ থেকে সরে দাঁড়াব, কারণ আমি মনে করি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ১০ বছরই যথেষ্ট।
ইফতেখার মাহমুদ: আপনি ১০ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছেন, যা রাজনীতিতে বিরল। যেখানে বহু রাজনীতিবিদ আজীবন ক্ষমতার রাজনীতিতে থাকেন, সেখানে আপনার এই ১০ বছরের পরিকল্পনার পেছনের কারণ বা দর্শনটা কী?
নাহিদ ইসলাম: আমরা তো দেখি, অনেক রাজনৈতিক দল বছরের পর বছর ধরে রাজনীতি করেও সফলতা পায় না; আবার অনেকে সফলতা পেয়েও তা ধরে রাখতে পারে না। একারণেই আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজের জন্য দশ বছরের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছি, যা দুটি নির্বাচনী টার্মের সমান। এই দশ বছরই আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য।
আর আমি মনে করি, আমরা ইতোমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দশ বা পনেরো বছরে যে অবস্থানে পৌঁছায়, আমরা সেই জায়গায় ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছি। একারণেই আমি দশ বছরের কথা বলছি, কারণ সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান আমাদের যাত্রাকে দশ থেকে পনেরো বছর এগিয়ে দিয়েছে। এখন বাকি কাজটুকু আমাদেরকেই করতে হবে। জনগণ আমাদের ওপর সেই সুযোগ ও দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এখন বাকি পথটুকু আমাদের নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা ও নিষ্ঠা দিয়েই অতিক্রম করতে হবে।
ইফতেখার মাহমুদ: এটা কি ৫ই আগস্টের আন্দোলনের আগে থেকেই আপনারা এভাবে ভাবতেন নাকি ৫ই আগস্টের পরে রাজনৈতিক দল গঠন করার পরে আপনি এরকম ভাবলেন যে আমরা ১০ বছরের একটা টার্গেট...
নাহিদ ইসলাম: ৫ই আগস্টের আগে আমি ঠিক এভাবে ভাবিনি। তখন আমাদের কৌশল ও পরিকল্পনা কিছুটা ভিন্ন ছিল, কারণ এই ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন কখন বা কীভাবে ঘটবে, সে বিষয়ে আমরা কেউই নিশ্চিত ছিলাম না। তবে আমরা যে রাজনীতিতে থাকব এবং দেশের জাতীয় রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আসবে—এই বিষয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম। ৫ই আগস্টের পরেই মূলত আমার এই ভাবনাটি আরও দৃঢ় হয়। আর এটি আমার ব্যক্তিগত একটি ভাবনা যে, দল হয়তো ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে, কিন্তু আমার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হলো আগামী দশ বছরের মধ্যে এই দলটিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে যাওয়া।
ইফতেখার মাহমুদ: ঠিক আছে, আপনার প্রতি আমাদের শুভকামনা রইল। ঢাকা স্ট্রিমের জন্য যদি কিছু বলেন।
নাহিদ ইসলাম: আপনাদেরকে এবং ঢাকা স্ট্রিমের সকল দর্শককে ধন্যবাদ। ৫ই আগস্টের পর একটি নতুন গণমাধ্যম হিসেবে ঢাকা স্ট্রিমের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, এবং আমি মনে করি এটিও গণঅভ্যুত্থানেরই একটি ফসল। এ কারণে, আমাদের দল এনসিপি-র প্রতি যেমন জনগণের অনেক প্রত্যাশা ও চাপ রয়েছে, আমি মনে করি ঢাকা স্ট্রিমের প্রতিও একই ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কারণ গত ১৬ বছরে আমরা পুরোনো গণমাধ্যমগুলোর একমুখী চরিত্র দেখেছি। তাই আমাদেরও প্রত্যাশা থাকবে, ঢাকা স্ট্রিম গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে বাংলাদেশকে নতুন কিছু উপহার দেবে।
.png)

নিউ ইয়র্কের জোহরান মামদানি সম্প্রতি মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সাফল্য কেবল রাজনীতির নয়—এটি এক দারুণ যোগাযোগ ও সম্পর্কের গল্প। তিনি প্রচারণা চালিয়েছেন ভিন্ন উপায়ে।
৩ ঘণ্টা আগে
গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ নভেম্বর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য উইক-এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। নিবন্ধের শিরোনাম ‘অতীতেও আমি অনির্বাচিত রাজনীতিবিদদের মোকাবিলা করেছি’ শিরোনামে।
২০ ঘণ্টা আগে
মুফতি মনির হোসেন কাসেমী; হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব। বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিএনপি'র সঙ্গে সম্ভাব্য জোট গঠন এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির রাজনৈতিক ও আদর্শিক কারণগুলো নিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
১ দিন আগে
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রস্তাবিত নতুন পে-স্কেল কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ও আর্থিক শৃঙ্খলার যৌথ পরীক্ষা।
১ দিন আগে