leadT1ad

জোহরান মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল চায় রিপাবলিকানরা, এটা কি সম্ভব

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

কয়েকজন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা মামদানির নাগরিকত্বের প্রক্রিয়া নিয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত।

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে জোহরান মামদানি সহজ জয় পাওয়ার পর রিপাবলিকান নেতারা তার বিরুদ্ধে নতুন অভিযানে নেমেছেন। শহরের প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র হিসেবে তার বিজয়কে ঘিরে ওয়াশিংটনের রিপাবলিকানদের একাংশ ঘোষণা দিয়েছে, তারা তাকে দায়িত্ব গ্রহণে বাধা দেবে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগেই হুমকি দিয়েছিলেন, মামদানি জয়ী হলে নিউইয়র্ক সিটির জন্য ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেবেন। নির্বাচনের পর তিনি মামদানির নাগরিকত্ব নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন তোলেন এবং উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ৩৪ বছর বয়সী এই রাজনীতিককে মিথ্যা অভিযোগে ‘কমিউনিস্ট’ বলেন।

কয়েকজন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা মামদানির নাগরিকত্বের প্রক্রিয়া নিয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, মামদানি নাগরিকত্ব পাওয়ার সময় তথ্য গোপন করেছেন এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব বাতিল করে উগান্ডায় ফেরত পাঠানো উচিত। তবে এসব অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেননি।

রিপাবলিকান প্রতিনিধি অ্যান্ডি ওগলস ২৯ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘যদি মামদানি নাগরিকত্বের নথিতে মিথ্যা বলে থাকেন, তবে তিনি নাগরিক নন এবং নিউইয়র্ক সিটির মেয়রও হতে পারেন না। একটি মহান শহর এখন এমন একজন কমিউনিস্টের হাতে যাচ্ছে, যিনি প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী মতাদর্শের সমর্থন করেছেন।’ তিনি মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে তদন্তের আহ্বান জানান।

ওগলস আরও বলেন, ‘আমেরিকার নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ায় কমিউনিস্ট বা সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে তা অবশ্যই জানাতে হয়। আমি সন্দেহ করি, তিনি তা জানাননি। প্রমাণ মিললে তাকে প্রথম ফ্লাইটে উগান্ডায় ফেরত পাঠানো উচিত।’

ফ্লোরিডার রিপাবলিকান প্রতিনিধি র‍্যান্ডি ফাইনও মামদানির বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। ২৭ অক্টোবর নিউজম্যাক্সে তিনি বলেন, ‘বর্বররা আর দরজায় নয়, তারা এখন ভেতরে। মামদানি মাত্র আট বছর আগে এখানে এসেছেন, আর এখন নাগরিক হয়েছেন—এটাই প্রমাণ যে তিনি শর্ত পূরণ করেননি।’

তথ্য যাচাই সংস্থা পলিটিফ্যাক্ট জানিয়েছে, মামদানি নাগরিকত্বের আবেদনপত্রে কোনো মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন এমন প্রমাণ নেই।

মামদানি উগান্ডায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৮ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ২০১৮ সালে তিনি নাগরিকত্ব লাভ করেন। প্রাপ্তবয়স্কদের নাগরিক হতে হলে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে টানা পাঁচ বছর বৈধভাবে বসবাস করতে হয় (যদি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিত হন, তবে তিন বছর)।

নাগরিকত্ব বাতিল বা ‘ডিন্যাচারালাইজেশন’ একটি বিরল ও কঠোর প্রক্রিয়া। এটি কেবল আদালতের আদেশে সম্ভব হয়। সাধারণত এটি ব্যবহৃত হয় যুদ্ধপরাধী নাৎসি বা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।

অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মামদানির বিষয়ে কোনো প্রমাণ তারা দেখেননি। অভিবাসন আইনজীবী জেরেমি ম্যাককিনি বলেন, ‘নাগরিকত্ব বাতিল একটি চরম পদক্ষেপ, যা কেবল তখনই সম্ভব যখন সরকার প্রমাণ করতে পারে যে নাগরিকত্ব অবৈধভাবে অর্জিত হয়েছে বা আবেদনকারী ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেছেন। তা-ও নিশ্চিত ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকতে হয় যে এই তথ্য নাগরিকত্বের সিদ্ধান্ত বদলে দিত।’

ওগলস ও ফাইন পলিটিফ্যাক্ট-এর মন্তব্য চাওয়ার অনুরোধের জবাব দেননি।

বিশেষজ্ঞদের মত: মামদানির নাগরিকত্ব নিয়ে অভিযোগ দুর্বল ও ভিত্তিহীন

জোহরান মামদানির নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয় গত গ্রীষ্মে, যখন তিনি ডেমোক্র্যাট দলের মেয়র প্রার্থী হন।

জুন মাসে প্রতিনিধি অ্যান্ডি ওগলস অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে লেখা এক চিঠিতে বিচার বিভাগকে মামদানির নাগরিকত্ব বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, মামদানি ‘ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য প্রদান বা সন্ত্রাসে সহায়তার বিষয় গোপন করে’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন।

ওগলস উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালে মামদানি যে গান লিখেছিলেন, তাতে ‘হোলি ল্যান্ড ফাইভ’-এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছে। এই নামটি ২০০৮ সালে হামাসকে সহায়তার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত মুসলিম দাতব্য সংস্থা হোলি ল্যান্ড ফাউন্ডেশন-এর পাঁচ কর্মকর্তাকে নির্দেশ করে। তবে অনেক আইনজীবী বলেন, মামলাটির প্রমাণ ছিল দুর্বল এবং গুজবনির্ভর।

ওগলস ও ফ্লোরিডার প্রতিনিধি র‍্যান্ডি ফাইন আরও দাবি করেন, মামদানি নাগরিকত্বের ফর্মে তাঁর ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকা (ডিএসএ) সদস্যপদ গোপন করেছেন। তাঁদের মতে, এই সংগঠনটি কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং এর সদস্যপদ মামদানিকে নাগরিকত্বের জন্য অযোগ্য করতে পারে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ফর্মে শুধুমাত্র কমিউনিস্ট বা একনায়কতান্ত্রিক দলে সদস্যতার বিষয় জানতে চাওয়া হয়। ডিএসএ কোনো কমিউনিস্ট সংগঠন নয়।

এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কিন কমিউনিজম ইতিহাসবিদ হার্ভি ক্লেয়ার বলেন, ডেমোক্র্যাটিক সমাজতন্ত্র আসলে কমিউনিজমের বিকল্প এক ধারা। এই সমাজতান্ত্রিকরা সাধারণত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং উৎপাদনের উপকরণ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকা উচিত—এই কমিউনিস্ট ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন।

অভিবাসন আইনজীবী জেরেমি ম্যাককিনি বলেন, ‘ডিএসএ-র সদস্য হওয়া নাগরিকত্বের পথে কোনো বাধা নয়। নাগরিকত্ব ফর্মে কোনো বৈধ রাজনৈতিক সংগঠনের নাম না লেখাকে প্রতারণা বলা যায় না, যদি তা প্রকাশ করলে আবেদন বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। আর কোনো গানের লিরিকে হোলি ল্যান্ড ফাইভ-এর উল্লেখ করা মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ—যতক্ষণ না তা কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বাস্তব সহায়তা দেয়।’

নির্বাচন চলাকালে প্রচারিত ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্যের সমালোচনা করে কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) এবং ডেমোক্র্যাট দলের কয়েকজন সদস্য। মুসলিম নাগরিক অধিকার সংস্থা সিএআইআর মামদানির নাগরিকত্ব বাতিলের দাবিকে ‘বর্ণবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী’ বলে অভিহিত করে।

অক্টোবর মাসে এমএসএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মামদানি বলেন, ‘ইসলামোফোবিয়া এখন মার্কিন রাজনীতির একটি স্থায়ী অংশ হয়ে গেছে। এটি স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। এখন কেউ যখন এর বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন বলা হয় সে অযথা বিষয়টি বড় করছে। আসলে আমরা কেবল এমন এক বাস্তবতাকেই নাম দিচ্ছি যা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান। এই মনোভাবের মূল কারণ হলো—অনেকেই এখনো মেনে নিতে পারেন না যে মুসলিমরাও এই শহরের অংশ।’

মামদানিকে দায়িত্ব গ্রহণে বাধা দেওয়ার উদ্যোগ

নিউ ইয়র্ক ইয়াং রিপাবলিকান ক্লাব মামদানির দায়িত্ব গ্রহণ ঠেকাতে নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে। নিউ ইয়র্ক পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীকে ভিত্তি হিসেবে নিচ্ছে।

এই সংশোধনী অনুযায়ী, কেউ যদি বিদ্রোহে অংশ নেয় বা শত্রুপক্ষকে সহায়তা করে, তবে সে সরকারি পদে থাকতে পারে না।

রাজ্য রিপাবলিকান দল অভিযোগ করেছে যে মামদানি ‘প্রো-হামাস’ সংগঠনকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদের সহায়তা করেছেন। এছাড়া, তিনি অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) কর্মকর্তাদের বিরোধিতার আহ্বান জানিয়ে গ্যাংদের সমর্থন করেছেন বলে দাবি করা হয়েছে।

তবে মামদানিকে অযোগ্য ঘোষণার এই প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন করা কঠিন। এর জন্য কংগ্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। এমন আইন পাস হলেও তা সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা পলিটিফ্যাক্টকে বলেছেন, আইসিই-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ১৪তম সংশোধনীর আওতায় পড়ে না। কারণ, সংশোধনীর ধারা কেবল বিদ্রোহ বা যুদ্ধে শত্রুকে সহায়তার সঙ্গে সম্পর্কিত, দেশীয় নীতির সমালোচনার সঙ্গে নয়।

নাগরিকত্ব বাতিলের প্রক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ দুটি পথে নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে— ফৌঁজদারি অভিযোগ দায়ের করে অথবা দেওয়ানি মামলা করে।

দুই ক্ষেত্রেই সরকারকে প্রমাণ করতে হয় যে আবেদনকারী নাগরিকত্বের আবেদনে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন এবং সেই তথ্য সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারত।

অপরাধমূলক মামলায় প্রমাণের মানদণ্ড বেশি কঠোর— ‘যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের অতীত’ পর্যায়ে দোষ প্রমাণ করতে হয়।

অন্যদিকে, দেওয়ানি মামলায় ‘পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ দেখালেই যথেষ্ট। তবে দেওয়ানি প্রক্রিয়ায় কিছু সাংবিধানিক অধিকার নেই, যেমন বিনামূল্যে আইনজীবী পাওয়ার অধিকার।

কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্যাসান্দ্রা বার্ক রবার্টসন বলেছেন, মামদানির বিরুদ্ধে এমন কোনো পদক্ষেপ সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

তার মতে, বড় ঝুঁকি হলো—এ ধরনের মামলা কম সম্পদশালী মানুষদের ভয় দেখাতে পারে, ফলে তারা সরকারের সমালোচনায় মুখ খুলতে ভয় পাবে।

হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইরিনা মান্টা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব বাতিলের ঘটনা সাধারণত বিরল। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে এসব মামলা বেড়েছিল।

চলতি বছরের জুনে বিচার বিভাগ একটি নির্দেশনা জারি করেছে। এতে আইনজীবীদের নাগরিকত্ব বাতিল সংক্রান্ত মামলা অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়। অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি, গ্যাং সদস্য এবং ‘অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মামলা’ হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের।

যদি মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল হয়, তবে তার অভিবাসন মর্যাদা আগের অবস্থায়— বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা— ফিরে যাবে। এ অবস্থায় তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।

সূত্র: আল-জাজিরা

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত