ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গত সোমবার ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁনকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলে শাহিনা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তাঁর ২০ বছরের ছেলে সাজ্জাত হোসেন সোজলকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। পরে তার দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। কয়েক ঘণ্টা পরই ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের চাপে হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ত্যাগ করেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি কঠোরভাবে দেশ শাসন করেছিলেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেদিন আশুলিয়ায় ছয়জন বিক্ষোভকারী ছাত্রকে হত্যা করা হয়। পাঁচজনকে গুলি করে দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আরেকজনকে পুলিশ স্টেশনের ভেতর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে এসব হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে, নিরাপত্তা বাহিনীর এ দমনপীড়নে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ১ হাজার ৪০০-র বেশি মানুষ নিহত হয়।
মাসব্যাপী অনুপস্থিতিতে চলা বিচার শেষে সোমবার ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনা ও খাঁনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তৃতীয় আসামি সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হওয়ায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড পান।
সোমবার রাতে আল জাজিরাকে শাহিনা বেগম বলেন, ‘হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসিতে ঝোলানো না হলে আমার শান্তি নেই।’
তিনি জানান, তাঁর ছেলে পুলিশ স্টেশনের ভেতরে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। কেউ তাকে রক্ষা করেনি। তিনি চান, যারা তার ছেলেকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে তারা যেন আর কোনো মায়ের সন্তানের ক্ষতি করতে না পারে।
গত বছরের অভ্যুত্থানে নিহত শত শত পরিবারের কাছে এই রায় ঐতিহাসিক। তবে অনেকেই মনে করছেন, হাসিনা আদৌ সাজা পাবেন কি না, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই ভারত কি তাঁকে ও খাঁনকে প্রত্যর্পণ করবে, নাকি তাদেরকে বিচার এড়াতে সাহায্য করবে—এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গাইবান্ধার শ্যামপুর গ্রামের পৈত্রিক বাড়ি থেকে শাহিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে পাঁচ মিনিট লেগেছিল। অথচ এই রায় পেতে এক বছরের বেশি সময় লেগেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকার কি সত্যিই তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? যদি সরকার পরিবর্তন হয় এবং নতুন সরকার হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের রক্ষা করে? কে নিশ্চিত করবে যে এই হত্যাকারীরা রেহাই পাবে না?’
‘সাজা অবশ্যই কার্যকর করতে হবে’
সোমবার ঢাকার ট্রাইব্যুনাল ভবনের সামনে শত শত মানুষ জড়ো হয়। সেখানে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, তাঁর ভাই মীর মুগ্ধকে অভ্যুত্থানের সময় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি দাবি করেন, শেখ হাসিনা বহুবার ফাঁসির যোগ্য। তিনি কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান—হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করতে হবে।
তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নিহত বিক্ষোভকারী মুতাসির রহমানের বাবা সৈয়দ গাজী রহমান। তিনি বলেন, রায় দ্রুত ও প্রকাশ্যে কার্যকর করা উচিত। তিনি অভিযোগ করেন, হাসিনা হাজারো পরিবারের হৃদয় শূন্য করে দিয়েছেন।
প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে রংপুর জেলার ভাবনাপুর জাফরপাড়া গ্রামে নিহত আবু সাঈদের স্বজনরাও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন জানান।
সাঈদ জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম নিহত ব্যক্তি ছিলেন। সরকারি চাকরিতে বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন থেকেই ওই অভ্যুত্থান শুরু হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সন্তানদের অস্বাভাবিক সুবিধা দেওয়ার কারণে এই কোটা ব্যবস্থাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করা হতো।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে বিক্ষোভের সময় ছাত্রনেতা সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে।
সিটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ছেলে সোজলের সঙ্গে শাহীনা বেগম। ছবি: সংগৃহীত।সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার হৃদয়ের আগুন আজ কিছুটা নিভেছে। আমি সন্তুষ্ট। তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে বিলম্ব ছাড়াই বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে।’
সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে আর নেই। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। রায় অবশ্যই কার্যকর করতে হবে।’ রায় ঘোষণার পর তাঁদের বাড়িতে আগতদের মধ্যে তারা মিষ্টি বিতরণ করেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখারপুল এলাকায় গুলি করে নিহত দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাসের মা শানজিদা খান দীপ্তি আল জাজিরাকে বলেন যে এই রায় কেবল ‘সান্ত্বনা’ মাত্র।
তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচার তখনই হবে, যেদিন রায় কার্যকর হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন মা হিসেবে আমি মনে করি, হাজার চারশো মৃত্যুদণ্ডও যথেষ্ট নয় সেই ব্যক্তির জন্য, যিনি হাজারো মায়ের বুক শূন্য করেছেন। একজন শাসক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যদি গণহত্যা চালান, তবে বিশ্বকে তার পরিণতি দেখতে হবে। আল্লাহ সময় দেন, কিন্তু কাউকে রেহাই দেন না।’
দীপ্তি আরও জানান, তিনি সাবেক পুলিশপ্রধান আল–মামুনের সাজায় সন্তুষ্ট নন।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হয়েও আবদুল্লাহ আল–মামুন আমাদের সন্তানদের হত্যাকারীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর আরও দীর্ঘ সাজা পাওয়া উচিত ছিল।’
‘আর কোনও স্বৈরশাসকের উত্থান যেন না হয়’
সোমবার শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি মিছিল বের হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত এক মিছিলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আর রাফি বলেন, তাঁরা ভারতের কাছ থেকে হাসিনার প্রত্যর্পণ দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা আপাতত সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা চাই, হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় থাকব যতক্ষণ না রায় বাস্তবায়ন হয়।’
এদিকে ‘মৌলিক বাংলা’ নামের একটি সংগঠন ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার পর ঢাকার শাহবাগ মোড়ে হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের প্রতীকী নাট্যাভিনয় করে।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি বলেন, ‘এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে—কোনো স্বৈরশাসক যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।’
রাজনৈতিক দলগুলোও রায়কে স্বাগত জানায়। বিএনপি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী—উভয় দলই রায়ের পক্ষে মত দেয়।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই রায় প্রমাণ করে, একজন ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরশাসক যতই ক্ষমতাবান হোক, একদিন তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হয়।’
জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, রায় প্রমাণ করেছে যে ‘কোনো সরকারপ্রধান বা ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা আইনের ঊর্ধ্বে নন।’ তিনি বলেন, এ রায় অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের কাছে ‘একটি সান্ত্বনা’ বয়ে এনেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানায়, তারা রায়কে ‘ভুক্তভোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ হিসেবে দেখছে। তবে তারা উদ্বেগ জানায় যে অনুপস্থিতিতে হওয়া বিচার এবং তার ভিত্তিতে প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড যথাযথ প্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণ নাও করতে পারে। সংস্থাটি আবারও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা পুনর্ব্যক্ত করে।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরে। সংগঠনটি জানায়, ভুক্তভোগীরা ‘আরও ভালো ন্যায়বিচারের যোগ্য।’ তারা সতর্ক করে যে তাড়াহুড়া করে অনুপস্থিতিতে বিচার করলে প্রকৃত ন্যায়বিচার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সংগঠনটি জানায়, ‘ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি প্রয়োজন। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড মানবাধিকার লঙ্ঘন আরও বাড়িয়ে দেয়। এটি এক নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানজনক শাস্তি, যার কোনো স্থান ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ায় নেই।’
তবে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, এই রায় দমন-পীড়নের নির্মমতা স্বীকার করেছে এবং তাদের জন্য এক ধরনের আশার সঞ্চার করেছে।
ঢাকার উত্তরা এলাকার ২১ বছর বয়সী টিকটকার আতিকুল গাজী বলেন, এই রায় বার্তা দেয় যে ‘ন্যায়বিচার অনিবার্য।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট খুব কাছ থেকে গুলি খেয়ে বেঁচে গেলেও তিনি বাঁ হাত হারান। তাঁর এক বাহুমুক্ত হাসিমুখের সেলফি ভিডিও গত বছর ভাইরাল হয়েছিল। এতে তিনি প্রতীকীভাবে দৃঢ়তার পরিচয় দেন।
গাজী আল জাজিরাকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে জুলাইয়ের শহীদদের আত্মা এখন কিছুটা শান্তি পাবে।’
(আল-জাজিরার ফিচার প্রতিবেদন থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ)