leadT1ad

কনফুসিয়াসের দায় ও দরদের রাজনৈতিক দর্শন

রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা আনতে চাইলে প্রথমে শাসন মসনদের নাম ও কাজের দায়িত্ব সঠিক হতে হবে। এই নীতির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ঝেংমিং’। যার বাংলা দাঁড়ায় ‘নামের যথার্থতা’। অর্থাৎ রাজা যেন সত্যিই রাজার মতো আচরণ করেন, পিতা যেন পিতার মতো দায়িত্ব নেন।

প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮: ৪৭
দার্শনিক কনফুসিয়াস। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রাচীন চীনে তখন চলছে অশান্ত সময়। চারদিকে যুদ্ধ, রাজনৈতিক ভাঙন আর নৈতিক অবক্ষয়। সমাজে শান্তি খুঁজে পাওয়া যেন ছিল প্রায় অসম্ভব। এমন সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন দার্শনিক কনফুসিয়াস (৫৫১–৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব)। অশান্ত প্রাচীন চীনে কনফুসিয়াস এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে শাসকের শক্তি নির্ভর করবে তার নৈতিকতা ও মানবিকতার ওপর। যাকে আরেক কথায় বলা যায় দায় ও দরদের রাজনীতির দর্শন।

সময়ের বিচারে তিনি প্রাচ্যের দর্শনে গৌতম বুদ্ধ ও পশ্চিমা দর্শনে হেরাক্লিটাস-এর সমসাময়িক। প্রভাবের বিচারেও চীনে তিনি এই দুইজনের সমান মর্যাদাবান।

জীবদ্দশায় রাজনীতি ও শাসনের এক ভিন্ন দর্শন তুলে ধরেছিলেন কনফুসিয়াস। তাঁর মতে, শাসনের শক্তি সৈন্য বা আইন-কানুনের কঠোরতার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে নৈতিক নেতৃত্ব ও মানবিকতার ওপর।

কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন, রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে নৈতিকতা। যদি শাসক সৎ ও নৈতিক হন, জনগণ স্বেচ্ছায় তাঁকে অনুসরণ করবে। বাতাসের দোলা যেমন ঘাসকে নত করে, কনফুসিয়াস মনে করতেন শাসকের নৈতিকতাও জনগণের ওপর তেমনি প্রভাব রাখতে পারে। শক্তি বা শাস্তির ভয় মানুষকে সাময়িকভাবে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু সত্যিকারের আনুগত্য আসে সম্মান থেকে।

জনগণকে আইন দিয়ে শাসন করলে তারা কেবল শাস্তির ভয়ে বাধ্য হবে। কিন্তু নৈতিকতা দিয়ে শাসন করলে তারা অন্তরের লজ্জা থেকে সৎ থাকবে। কনফুসিয়াস

তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো শাস্তির বদলে উদাহরণ সৃষ্টি করে শাসন করা। কনফুসিয়াস মনে করতেন শাসকের চরিত্রই জনগণের আচরণের প্রতিফলন ঘটায়। যদি রাজা বা মন্ত্রী দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, প্রজারা তাহলে নৈতিক হবে না। তাই তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা আনতে চাইলে প্রথমে শাসন মসনদের নাম ও কাজের দায়িত্ব সঠিক হতে হবে। এই নীতির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ঝেংমিং’। যার বাংলা দাঁড়ায় ‘নামের যথার্থতা’। অর্থাৎ রাজা যেন সত্যিই রাজার মতো আচরণ করেন, পিতা যেন পিতার মতো দায়িত্ব নেন। দায়িত্বের নামে আর কাজে যেন ফারাক না থাকে।

রাষ্ট্র একটা পরিবার

কনফুসিয়াস রাষ্ট্রকে একটি বৃহৎ পরিবারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাঁর মতে, শাসক হচ্ছে জনগণের অভিভাবক, আর জনগণ হচ্ছে সন্তানের মতো। সন্তানদের যেমন উচিত অভিভাবকের প্রতি ভক্তি দেখানো, তেমনি জনতারও উচিৎ শাসকের প্রতি আনুগত্য ধরে রাখা। কিন্তু সম্পর্কটি একপাক্ষিক নয়—শাসকেরও দায়িত্ব হলো সন্তানের মতো জনগণের যত্ন নেওয়া। অন্যথায় সংঘাত অনিবার্য। পারিবারিক আদর্শই কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শনের হৃদয়স্থল। রাষ্ট্র পরিচালনাকে তিনি পরিবারের মতো দেখলেও, পরিবারতান্ত্রিকতাকে তিনি মোটেও সমর্থন করতেন না।

কনফুসিয়াসের সময়ে সমাজের নেতৃত্ব সাধারণত তৈরি হতো বংশানুক্রমে। কনফুসিয়াস এই নেতৃত্বের কাঠামোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নেতৃত্ব জন্মসূত্রে নয়, বরং নৈতিকতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া উচিত। তাঁর চোখে আদর্শ নেতা হলেন ‘জুনজি’ বা নৈতিক ভদ্রলোক। যে ভদ্রলোক মানবিকতা, ন্যায় এবং শিষ্টাচার মেনে চলেন।

কনফুসিয়াস নিজে কোনো বই লেখেননি। শিষ্যরা তাঁর বক্তব্য সংগ্রহ করে ‘লুনইউ’ নামের গ্রন্থে সংকলন করেন। লুনইউ শব্দের অর্থ উক্তি। এই বইতে ছোট ছোট সংলাপ আকারে তাঁর নীতি, উপদেশ ও চিন্তাধারা পাওয়া যায়।

কনফুসিয়াসের এই ধারণা থেকেই পরে চীনে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশাসনিক পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম কাঠামো হিসেবে তা চীনে স্থায়ী হয়।

নৈতিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিলেও কনফুসিয়াস আইনকে অস্বীকার করেননি। তাঁর মতে, আইন মানুষের ভয় জাগাতে পারে, কিন্তু নৈতিকতা মানুষকে ভেতর থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। যদি জনগণ সম্মান ও লজ্জাবোধ থেকে সঠিক কাজ করে, তবে আইন প্রয়োগের প্রয়োজন অনেকটাই কমে যাবে। এ বিষয়ে তাঁর একটা বিখ্যাত বিখ্যাত উক্তি আছে— ‘জনগণকে আইন দিয়ে শাসন করলে তারা কেবল শাস্তির ভয়ে বাধ্য হবে। কিন্তু নৈতিকতা দিয়ে শাসন করলে তারা অন্তরের লজ্জা থেকে সৎ থাকবে।’

কনফুসিয়াস নিজে কোনো বই লেখেননি। শিষ্যরা তাঁর বক্তব্য সংগ্রহ করে ‘লুনইউ’ নামের গ্রন্থে সংকলন করেন। লুনইউ শব্দের অর্থ উক্তি। এই বইতে ছোট ছোট সংলাপ আকারে তাঁর নীতি, উপদেশ ও চিন্তাধারা পাওয়া যায়। কনফুসিয়াস সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানি, তার বেশিরভাগই জানি লুনইউ নামের সেই প্রাচীন গ্রন্থের কল্যাণে।

কনফুসিয়াসের প্রভাব

কনফুসিয়াসের এই রাজনৈতিক দর্শন কেবল তাঁর সময়েই আলোড়ন তোলেনি, বরং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিক্ষা ও নৈতিকতা কনফুসিয়াসের চিন্তার মূল উপাদান ছিল। এজন্য শত শত বছর ধরে চীনের সরকারি পরীক্ষায় কনফুসিয়াসের গ্রন্থ পড়ানো ছিল বাধ্যতামূলক। কেবল চীন নয়, কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনামসহ পূর্ব এশিয়ার সমাজগুলোতেও তাঁর দর্শনের গভীর প্রভাব পড়েছে।

কনফুসিয়াসের রাজনৈতিক দর্শনের সারমর্ম হলো—রাষ্ট্রের উন্নতি আসে নৈতিক নেতৃত্ব থেকে। একজন শাসক যদি সৎ, মানবিক ও দায়িত্বশীল হন, তবে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ন্যায়নীতির পথে চলবে। আইন, শক্তি বা ভয় নয়; বরং উদাহরণ, দায়িত্ব ও নৈতিকতাই সমাজকে স্থিতিশীল করে। দুই হাজার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তাঁর এই শিক্ষা আজও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত