leadT1ad

বন্দর বিষয়ে চৌধুরী সাহেব যেসব প্রশ্নের উত্তর দেননি

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ২৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদল বলছে, বিদেশি কোম্পানির কাছে দিয়ে অতি উত্তম কাজ হয়েছে—এবার দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। অন্যদল বলছে, দেশ বিক্রি হয়ে গেল, সার্বভৌমত্ব চলে গেল। আসলে কী হলো, তার জবাব দেয়ার দায় স্বাভাবিকভাবেই সরকারের বেশি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে খোলাসা করে কিছু বলা হচ্ছে না, চুক্তির গোপনীয়তার শর্তে।

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী তার ফেসবুক পেজে নানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অনেকটা এফএকিউ আদলে—নিজেই কিছু প্রশ্ন করে তার উত্তর দিয়েছেন। যেহেতু চুক্তিতে গোপনীয়তার শর্ত আছে, ধরে নেওয়া যায়, বিডা চেয়ারম্যান অনেক কিছুই বলেননি। যেহেতু দেশ জুড়ে বিতর্ক চলছে, এ বিষয়ে যত গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে, ততই বিতর্ক ও গুজব ডালপালা মেলবে।

অনেকেই অভিযোগ করছেন, আশিক চৌধুরীর সেসব প্রশ্নোত্তর অনেকাংশেই সত্য আড়াল করার চেষ্টা, চাতুরিপূর্ণ এবং পরস্পরবিরোধী। যদি নির্মোহভাবে দেখা যায়, তাহলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

তবে আশিক চৌধুরী একটি ভুল করেছেন। ঠিক ভুল না, হয়তো একে অন্যায়ই বলা যাবে। প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের তিনি বন্দরের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিহিত করেছেন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁদের মতামতকে তিনি ‘হাউ মাউ কাউ’ বলে উল্লেখ করেছেন। একটা দেশে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যা অবমাননাকরই শুধু নয়, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এবার দেখা যাক, তিনি কোন কোন বিষয় এড়িয়ে গেছেন, বা কোন কোন প্রশ্নের উত্তর দেননি।

প্রশ্ন ১: বন্দরের মূল সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন

চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি আর অদক্ষতা। এগুলোর সমাধান অসম্ভব নয়। সম্প্রতি দেশে একটা লুটেরা ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অবসান হয়েছে। এরপরের জন-আকাঙ্ক্ষা প্রধান বিষয়টিই ছিল দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে এবং সরকারি কার্যক্রমের দক্ষতা বাড়বে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল প্রতিশ্রুতির অংশই ছিল এ ধরনের সংস্কার।

তবে সরকার অন্তত বন্দরের বিষয়ে সে পথে হাঁটল না। একরকম ঘোষণাই দিয়ে দিল, এই দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।

চট্টগ্রাম বন্দরে দুর্নীতি ও অদক্ষতা সত্ত্বেও এটি এখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কাজেই কিছু ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি হ্রাস করলে এই প্রতিষ্ঠান এখনই অনেক সুফল দিতে সক্ষম। অথচ সরকার সেটা কেন করল না, সেটা পরিষ্কার নয়।

বন্দরের দুর্নীতি সমাধানযোগ্য ছিল। সরকারের হাতের নাগালেই ছিল তা, শুধু সদিচ্ছা থাকলেই তা দূর করা যেত। কিন্তু, গোপনীয়তার মাধ্যমে অস্বাভাবিক দ্রুততায় প্রায় কোনোরকম যাচাই-বাছাই না করে, স্বচ্ছ টেন্ডার না করে পছন্দের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা—নিজেই একটা বড় দুর্নীতির উদাহরণ।

তার চেয়েও বড় কথা, এই বিদেশি কোম্পানি যেসব দুর্নীতি করবে, তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের থাকবে না। তারা যদি টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগের নামে আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দুর্নীতি করে, তা হবে দেশের সীমারেখা ও ক্ষমতার বাইরে। নাইজেরিয়ার লাগোস বন্দরসহ আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের বন্দরে এপিএম টার্মিনালের দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে।

চুক্তিতে কী আছে তা কেউ জানে না। বাংলাদেশের অতীতের কিছু বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে এ ধরনের চুক্তির অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ ধরনের চুক্তিতে এমন কোনো বিধান আছে, যা এপিএম টার্মিনালকে বাংলাদেশে অভিযোগ ও বিচারের বাইরে রাখবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে দুর্নীতি ও অদক্ষতা সত্ত্বেও এটি এখনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কাজেই কিছু ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও দুর্নীতি হ্রাস করলে এই প্রতিষ্ঠান এখনই অনেক সুফল দিতে সক্ষম। অথচ সরকার সেটা কেন করল না, সেটা পরিষ্কার নয়।

প্রশ্ন ২: কাস্টমসের কাজও কি বিদেশি কোম্পানি ডিল করবে

চট্টগ্রাম বন্দরে দুর্নীতি বা দীর্ঘসূত্রতা ঘটে কাস্টমসের জনবল ও অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে। প্রতিদিন হাজার হাজার কন্টেইনারে কী আসছে, তা যাচাই করার কাজটি কাস্টমসের। অনেক বিষয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য তাদের বুয়েট বা সায়েন্স ল্যাবরেটরির মতো তৃতীয় পক্ষের সহায়তার দরকার হয়। ফলে সময় লেগে যায়। আমদানীকারক ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষেত্রেই অতটা সময় দিতে রাজি হন না। তাঁদের অর্ডার বাতিলের বা সময়ের কারণে লোকসানের ঝুঁকি থাকে। ফলে তাঁরা ঘুষ দিয়ে হলেও কন্টেইনার ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। কাস্টমসের সক্ষমতা, জনবল ও অবকাঠামো বৃদ্ধি করলেই দীর্ঘসূত্রতা এড়ানো সম্ভব।

এখন যে বলা হচ্ছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কন্টেইনার খালাস করা হবে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কাস্টমসের কাজটি কীভাবে হবে? তাদের কি সক্ষমতা ও অবকাঠামো বাড়ানো হবে? যদি তাই হয়, তাহলে তো বিদেশি কোম্পানির আর প্রয়োজন পড়ে না। বিদ্যমান কাঠামোতেই কন্টেইনার খালাস দ্রুততর করা যায়।

লাখ কোটি আয়ের সুযোগ সামনে রেখে সেই ছয় হাজার কোটি টাকা তো আমরাই বিনিয়োগ করতে পারতাম। ব্যাংক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তাহলে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতি কেন করা হবে না?

তাহলে কি কাস্টমসের কাজটিও বিদেশি কোম্পানি করবে? কাস্টমসের কাজ বা তদারকি সরকারের হাতের বাইরে চলে যাওয়া একটি দেশের সরকারের মারাত্মক অকার্যকারিতার প্রমাণই শুধু নয়, এটা দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

দেশের কৃষি ও শিল্পের সুরক্ষার স্বার্থে আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কাস্টমসের সক্ষমতা বৃদ্ধি নাকি কাস্টমসের কাজ বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার বিষয়ে চৌধুরী সাহেব কোনো প্রশ্নোত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।

প্রশ্ন ৩: বন্দর থেকে লাখো কোটি টাকা আয়ের সুযোগ হাতছাড়া করব কেন

সম্প্রতি ভুটানের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পরিচালনার ব্যাপারে বাংলাদেশের চুক্তি হয়েছে। নেপালের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। হয়তো ভারতও তাদের সেভেন সিস্টার্সের জন্য এই বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হবে। তার মানে, শুধু বাংলাদেশের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং নয়, আগামী বছরগুলোতে আরও অন্তত তিনটি দেশের বিপুল পরিমাণ কন্টেইনার চলাচল করবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। যা বাংলাদেশ সরকারের সামনে লাখো কোটি টাকা আয়ের সুযোগ তৈরি করতে পারে।

এই অভাবনীয় সুযোগ আমরা হাতছাড়া করব শুধু বিদেশি কোম্পানিটি ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে? আর সামান্য কমিশন দেবে বলে? কন্টেইনার প্রতি তারা আয় করবে ১৭৮ ডলার, যেখান থেকে বাংলাদেশ পাবে মাত্র ২১ ডলার। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ১০ লাখ টিইইউ ছাড়ালে তা বেড়ে দাঁড়াবে হবে ২৩ ডলার। এটাকেই আশিক চৌধুরী সম্ভবত বলেছেন, যত হ্যান্ডলিং হবে, আমাদের তত আয়। বাংলাদেশ নিজেই যদি ১৭৮ ডলার নিতে পারে, সেখানে ২১ ডলারে খুশি হয়ে যাওয়া কতটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয়?

লাখ কোটি আয়ের সুযোগ সামনে রেখে সেই ছয় হাজার কোটি টাকা তো আমরাই বিনিয়োগ করতে পারতাম। ব্যাংক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তাহলে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতি কেন করা হবে না?

এক দিনের মধ্যে অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করার নামে এই কোম্পানিকে বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ করে দেওয়া হলো কার স্বার্থে? এভাবেই বুঝি বাংলাদেশ ধনী হয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি চোধুরী সাহেবের পোস্টে।

বন্দর চুক্তির বিরোধিতাকারীরা বলছেন, দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আর আশিক চৌধুরী তা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, বিদেশি কোম্পানিকে অপারেট করতে দিলেই কি দেশ বিক্রি হয়ে যায়? কিন্তু কোনো পক্ষই পরিষ্কার করতে পারেননি।

প্রশ্ন ৪: চুক্তির ঠিক আগে আগে চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বাড়ানো হলো কেন

চুক্তির ঠিক আগে চট্টগ্রাম বন্দরের শুল্ক ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ প্রায় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর কারণ কী? হঠাৎ করে ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি কি অস্বাভাবিক নয়? বন্দর তো ইতিমধ্যেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। হঠাৎ করে এতটা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ল কি বিদেশি কোম্পানিটি যাতে উচ্চমাত্রায় ফি আদায় করতে পারে, তা সিদ্ধ করার জন্য? এ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?

পৃথিবীর কোথাও বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানির হাতে কোনো পরিচালনার ভার দেওয়ার পর খরচ কমে যাওয়ার কোনো উদাহরণ নেই। নিজেদের লাভ সর্বোচ্চকরণই বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির মূল মনোযোগ, জনসেবা নয়। কাজেই, এমন ভরসা করার কোনো যুক্তি নেই, বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর দিলে ভবিষ্যতে বন্দরের শুল্ক ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ কমে আসবে। চৌধুরী সাহেব এ ব্যাপারে মিথ্যা বলেছেন। জেনেশুনেই বলেছেন।

এটি অনিবার্য যে বন্দরে বিদেশি কোম্পানির পরিচালনা শুরু হলে আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়বে। যার ফলাফল হিসেবে দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, রপ্তানি বাণিজ্য ব্যয় বাড়বে, ব্যবসায়ীদের বিদেশে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে যাবে। ফলে, তারা অন্যদিকে খরচ কমানোর জন্য শ্রমিকের বেতন হ্রাস, ছাঁটাই এবং কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নেবে।

প্রশ্ন ৫: দেশ বিক্রি বা নিরাপত্তা ঝুঁকি বা সার্বভৌমত্বের বিষয়টা কীভাবে সামনে আসছে

বন্দর চুক্তির বিরোধিতাকারীরা বলছেন, দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আর আশিক চৌধুরী তা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, বিদেশি কোম্পানিকে অপারেট করতে দিলেই কি দেশ বিক্রি হয়ে যায়? কিন্তু কোনো পক্ষই পরিষ্কার করতে পারেননি। বিরোধিতাকারীরা বলছেন, বন্দরে বিদেশি কোম্পানি ঢোকালে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। চৌধুরী সাহেব বলছেন, সেখানে নৌবাহিনী আছে। নিরাপত্তার কোনো সমস্যা নেই। এক্ষেত্রেও কোনো পক্ষই নিরাপত্তা বলতে কী বোঝানো হয়, তা পরিষ্কার করতে পারেননি।

দেশ বিক্রি মানে বাজারে এক কেজি পটোল বিক্রি নয়। একজন বিক্রেতা কিছু টাকার বিনিময়ে একটা বস্তু আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করে দিল, দেশ বিক্রি ব্যাপারটা মোটেও এমন কোনো বিষয় না।

‘দেশ বিক্রি’ কথাটা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। মূল বক্তব্যটা হচ্ছে, কিছু টাকার বিনিময়ে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে একটা কোম্পানিকে বড় ধরনের আয় করার সুযোগ করে দেয়া। বাংলাদেশসহ নেপাল, ভুটানের আমদানি রপ্তানি মিলিয়ে আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশ নিজেই বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারত, সেই সুযোগ থেকে দেশকে বঞ্চিত করে সেই আয়ের সুযোগ বড্ড সস্তায় এপিএম টার্মিনালসের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, মাত্র ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের বিনিময়ে। যদি টাকাটা তারা মূল্য হিসাবে এমনি দিয়ে দিতো, তা-ও বুঝতাম। টাকাটা তারা বিনিয়োগ করবে, মানে টাকার মালিক তারাই থাকবে। তার মুনাফাও তারাই ভোগ করবে। বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে, এখন বাংলাদেশের কাছে বিনিয়োগ করার টাকা নেই, যা এখন তারা বিনিয়োগ করবে এবং সেখানে কিছু মানুষ চাকরি পাবে।

সোমালিয়াসহ যুদ্ধরত কয়েকটি দেশের বন্দর দিয়ে অস্ত্র প্রবেশ বা পাচারের সঙ্গে এপিএম টার্মিনালসসহ বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সেটা নিরাপত্তা ঝুঁকি তো বটেই। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ত্বরান্বিত করার জন্য যদি সরকারি প্রতিষ্ঠান কাস্টমসের সক্ষমতা উন্নয়ন না ঘটিয়ে তা বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া হয়, তাহলে এটি নৌবাহিনীও ঠেকাতে পারবে না।

এতো সস্তায় দেশের এতোবড় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া ‘দেশ বিক্রি’ তো বটেই। মাত্র একদিনে অর্থনৈতিক সমীক্ষা করা, মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে ৩০ তথা ৪৫ বছরের জন্য বন্দরের মতো একটা অতি সংবেদনশীল চুক্তি স্বাক্ষর করে ফেলা ‘দেশ বিক্রি’ তো বটেই।

এবার আসি নিরাপত্তা ঝুঁকি বিষয়ে।

সোমালিয়াসহ যুদ্ধরত কয়েকটি দেশের বন্দর দিয়ে অস্ত্র প্রবেশ বা পাচারের সঙ্গে এপিএম টার্মিনালসসহ বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সেটা নিরাপত্তা ঝুঁকি তো বটেই। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ত্বরান্বিত করার জন্য যদি সরকারি প্রতিষ্ঠান কাস্টমসের সক্ষমতা উন্নয়ন না ঘটিয়ে তা বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া হয়, তাহলে এটি নৌবাহিনীও ঠেকাতে পারবে না। চুক্তির শর্ত অনুযায়ীই নৌবাহিনী বাইরে পাহারা দেওয়া ছাড়া বিদেশি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না।

এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি হচ্ছে, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সরকারের কিছু ব্যক্তির অতি উৎসাহী হয়ে বিদেশি কোম্পানির কাছে বন্দর অতি সস্তায় দিয়ে দেওয়া। যাদের হাতে দেশ, তারাই যদি দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়, সেটা নৌবাহিনী কীভাবে পাহারা দেবে?

সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি কোথায়?

পৃথিবীতে অনেক উদাহরণ আছে, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির পর একটি দেশ (বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ, যাদের ক্ষমতা কম) নিজের জনগণের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করতে পর্যন্ত ব্যর্থ হয়, যদি সেই আইন বিদেশি কোম্পানিটির মুনাফায় বাধা হয়। উরুগুয়ের তামাক নিরোধ আইন পাস করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফিলিপ মরিস কোম্পানি। কারণ, এই আইন তাদের তামাক বিক্রি কমিয়ে দেবে—এই অজুহাতে। একটি দেশকে যখন তার জনগণের কল্যাণে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির কথা ভাবতে হয়, জনগণের বদলে কোম্পানির স্বার্থ দেখতে হয় চুক্তির শর্তের কারণে, তখন সেটা সেই দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত। উপনিবেশ আমলের মতো খালি অন্য দেশ দ্বারা দখল হলেই তা সার্বভৌমত্ব হারায় না।

যখন সত্য গোপন করা হয় তখন গুজব পথ করে নেয়। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শত মানুষ সহস্র ব্যাখ্যা হাজির করছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে নানা যুক্তিকে ঘায়েল করছে, যেখানে যুক্তির চেয়ে কুযুক্তি বেশি।

প্রশ্ন ৬: যদি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ লাভবান না হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন কী হবে

সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিয়ে একটা আইন আছে, যেখানে বলা হয়েছে, কর্মকর্তারা যদি ‘সরল বিশ্বাসে’ দেশের কোনো ক্ষতি হবে না ভেবে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর বা কোনো কাজ করেন এবং পরে যদি কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এই ‘সরল বিশ্বাস’ বড় মারাত্মক। বিগত স্বৈরাচারী সরকার এ ধরনের আইন করে রেখেছিল, যাতে তাদের বেপরোয়া ধরনের ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ডের ফলে কোনো ক্ষতি হলে তার দায় এড়াতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অঙ্গীকার ছিল এ ধরনের গণবিরোধী আইন ও চর্চার সংস্কার করে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। সেটি না করে যখন সন্দেহজনক দ্রুততার সঙ্গে, অতি গোপনে এ ধরনের একটি চুক্তি করা হয়, যার মধ্যে দেশের লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি, দেশের নিরাপত্তার ঝুঁকি বেশি, চুক্তির শর্তের বলে যখন দেশ একটা গোলামির দিকে ধাবিত হয়, তখন সন্দেহ জাগে।

যখন সত্য গোপন করা হয় তখন গুজব পথ করে নেয়। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শত মানুষ সহস্র ব্যাখ্যা হাজির করছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে নানা যুক্তিকে ঘায়েল করছে, যেখানে যুক্তির চেয়ে কুযুক্তি বেশি। হিংসা যেখানে জ্বালানি। বিশেষ করে চৌধুরী সাহেবের বক্তব্য প্রচারে বিশাল এক বটবাহিনীর উপস্থিতি লক্ষণীয়, চুক্তির বিরোধিতাকারীকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় আক্রমণ করা, তাদেরকে আওয়ামী লীগের দোসর বলে প্রচার করা যাদের মূল উদ্দেশ্য।

একমুখে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে অন্তর্বর্তী সরকার কেন অন্যমুখে ফেসবুকে হিংসার বাণী ছড়াচ্ছে? এর মাধ্যমে বন্দর চুক্তির বিরোধিতাকারীকে দমন করে তারা কী অর্জন করবেন?

Ad 300x250

সম্পর্কিত