leadT1ad

একাত্তরে জুতা পলিশের টাকা ‘মহারাষ্ট্রের বাংলাদেশ-সহায়ক সমিতি’তে দেয় পথশিশুরা

সাধারণত পথশিশুরা মানুষের কাছে হাত পাতে, সাহায্য চায়। কিন্তু সেদিন তাঁরা ছিল দাতা। সারা দিন তাঁরা যাত্রীদের জুতা পলিশ করল, হাঁকডাক করে লোক জড়ো করল, সবাইকে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখের কথা বলল। দিনশেষে তাঁদের ছোট ছোট হাতে জমেছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ। সেই টাকা তুলে দিল ‘মহারাষ্ট্রের বাংলাদেশ-সহায়ক সমিতি’র হাতে। টাকার অঙ্কটা হয়তো যুদ্ধের বাজেটের তুলনায় নগণ্যই ছিল, কিন্তু এর পেছনের আবেগ আর ত্যাগ ছিল অমূল্য।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৩১
ক্ষত মুছিয়ে দিতে জুতা পলিশ করছে শিশুরা। সংগৃহীত ছবি

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে বোম্বের ভিক্টোরিয়া টার্মিনালে। ভারতের ব্যস্ততম এই রেলস্টেশনের সামনে প্রতিদিনের মতো জনা কয়েক শিশু ও কিশোর বসে আছে তাদের জুতা পলিশের বাক্স নিয়ে। পরনে জরাজীর্ণ পোশাক, চোখেমুখে দারিদ্র্যের ছাপ। এই ছেলেগুলোর জীবনে ‘আগামীকাল’ বলে কিছু নেই। দিন আনি দিন খাই—এই হলো তাঁদের অবস্থা। অথচ সেদিন তাঁদের চোখে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে—আজকের সারা দিনের উপার্জনের একটি পয়সাও নিজেরা খরচ করবে না। সারা দিনে যত টাকা আয় হবে, তার পুরোটাই তুলে দেবে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের অসহায় শরণার্থীদের জন্য।

তাদের এই উদ্যোগের স্লোগান ছিল—‘উই শাইন শুজ টু হেল্প হিল দ্য ব্রুজ’। বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়,‘পলিশ করি জুতা, মুছিয়ে দিতে ক্ষত।’ জুতা পলিশ করে যে একটি জাতির ক্ষত মোছানোর চেষ্টা করা যায়, তা হয়তো এই ছেলেগুলোই পৃথিবীকে প্রথম দেখিয়েছিল।

সেদিন সকালে ভিক্টোরিয়া টার্মিনালের সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল। ভারতের বিখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ‘মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এসে দাঁড়ালেন এই পথশিশুদের সামনে। তাঁর দামি জুতা জোড়া বাড়িয়ে দিলেন এক কিশোরের দিকে। ছেলেটি পরম যত্ন করে সেই জুতা পলিশ করে দিল। এরপর সেই শিল্পপতি তাঁর পকেট থেকে টাকা বের করে ওই কিশোরের হাতে দিলেন। এভাবেই উদ্বোধন হলো এক ঐতিহাসিক অর্থ সংগ্রহ অভিযানের।

সাধারণত পথশিশুরা মানুষের কাছে হাত পাতে, সাহায্য চায়। কিন্তু সেদিন তাঁরা ছিল দাতা। সারা দিন তাঁরা যাত্রীদের জুতা পলিশ করল, হাঁকডাক করে লোক জড়ো করল, সবাইকে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখের কথা বলল। দিনশেষে তাঁদের ছোট ছোট হাতে জমেছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ। সেই টাকা তুলে দিল ‘মহারাষ্ট্রের বাংলাদেশ-সহায়ক সমিতি’র হাতে। টাকার অঙ্কটা হয়তো যুদ্ধের বাজেটের তুলনায় নগণ্যই ছিল, কিন্তু এর পেছনের আবেগ আর ত্যাগ ছিল অমূল্য। কারণ, একজন কোটিপতির লাখ টাকা দানের চেয়ে একজন দিনমজুরের এক বেলার খাবার দান করা অনেক বেশি কঠিন।

এই খবরটি বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ল পুরো বোম্বে শহরে। খবরটি পৌঁছাল মহারাষ্ট্রের তৎকালীন গভর্নর আলী ইয়ার জংয়ের কানে। তিনি ছিলেন হায়দরাবাদের অভিজাত নিজাম পরিবারের সদস্য। সে সময় ভারতের অনেক মুসলিম অভিজাত পরিবারের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি এক ধরনের সুপ্ত সহানুভূতি ছিল। কিন্তু আলী ইয়ার জং ছিলেন ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কট্টর সমর্থক ছিলেন তিনি।

এই ঘটনাটি কেবল একটি দান বা সাহায্যের গল্প নয়। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি ‘জনযুদ্ধ’ বা ‘পিপলস ওয়ার’। যেখানে জর্জ হ্যারিসন গিটার হাতে লড়েছেন, রবিশংকর সেতার হাতে লড়েছেন, আর মুম্বাইয়ের এই নাম না জানা কিশোররা লড়েছে জুতা পলিশের ব্রাশ হাতে।

বুট পলিশ করা ছেলেদের এই পরম ভালোবাসার কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন গভর্নর। তিনি ভাবলেন, এই মহৎ হৃদয়ের মানুষগুলোকে যথাযথ সম্মান জানানো উচিত। তিনি যা করলেন, তা ছিল প্রথা ভাঙার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি রাজভবনের প্রটোকল ভেঙে এই পথশিশুদের আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বাসভবনে। স্থান—মালাবার হিলের শ্বেতশুভ্র রাজভবন। যেখানে বড় বড় মন্ত্রী, আমলা আর বিদেশি কূটনীতিকদের আনাগোনা। এক বিকেলে সেখানে হাজির হলো একদল ধুলামলিন কিশোর। তাঁদের হাতে কালির দাগ, পরনে হয়তো ছেঁড়া জামা, কিন্তু সেদিন তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো হলো ভিআইপি মর্যাদায়। গভর্নর আলী ইয়ার জং নিজে তাঁদের সঙ্গে চা পান করলেন, গল্প করলেন।

এই ঘটনাটি কেবল একটি দান বা সাহায্যের গল্প নয়। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি ‘জনযুদ্ধ’ বা ‘পিপলস ওয়ার’। যেখানে জর্জ হ্যারিসন গিটার হাতে লড়েছেন, রবিশংকর সেতার হাতে লড়েছেন, আর মুম্বাইয়ের এই নাম না জানা কিশোররা লড়েছে জুতা পলিশের ব্রাশ হাতে।

আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি সাদাকালো ছবি আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। এই ছবিটির দিকে তাকালে আজও আমাদের বুক গর্বে ভরে ওঠে, আবার কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে যায়। আমরা জানি না সেই ছেলেগুলোর নাম কী ছিল, জানি না আজ তাঁরা কোথায় আছে বা বেঁচে আছে কি না। হয়তো জীবনের কঠিন বাস্তবতায় হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে। কিন্তু ১৯৭১ সালের সেই সেপ্টেম্বরে তাঁরা যে মানবতার শিক্ষা দিয়েছিল, তা চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।

তাঁরা আমাদের শিখিয়েছিল, অন্যের ক্ষত মুছিয়ে দেওয়ার জন্য পকেটে অঢেল টাকার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন কেবল একটি সংবেদনশীল হৃদয়ের। ভিনদেশি এই বন্ধুদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। তাঁদের সেই স্লোগান—‘পলিশ করি জুতা, মুছিয়ে দিতে ক্ষত’—আজো আমাদের কানে বাজে মানবতার এক অমর সংগীত হয়ে।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত