১৯৮৬ সাল। মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। ফকল্যান্ড যুদ্ধের রেশ তখনো টাটকা। মাঠে উত্তেজনা। ম্যাচের ৫০ মিনিট পার হলো। তখনো কেউ গোলের দেখা পায় নি। ৫১ মিনিটে ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে উঠে ম্যারাডোনা বল জালে জড়ালেন। রেফারির চোখ এড়িয়ে হাত দিয়েই গোলটি দিলেন তিনি। কেউ বুঝতে পারলেন না। গোল উদ্যাপনে ব্যস্ত খেলোয়ারেরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি গোলের আসল রহস্য। পরবর্তীকালে সেই গোলটিকে ‘ঈশ্বরের হাত’ (হ্যান্ড অব গড) বলে অভিহিত করা হয়। এই বিতর্কিত গোলটি আজও ইংরেজদের কাছে এক গভীর ক্ষতের নাম। শিলটন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ‘প্রতারণা’র জন্য ম্যারাডোনার ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়টি ভুলতে পারেননি। অথচ ম্যারাডোনা এটিকে স্রেফ ‘চাতুর্য’ বলেই পার পেয়ে যান।
আলোচিত-সমালোচিত সেই ‘হ্যান্ড অব গড’ মুহূর্ত। সংগৃহীত ছবিফুটবল ইতিহাসের পাতায় একজন খেলোয়াড়কে ‘ফুটবলের রাজপুত্র’ আবার ‘শতাব্দীর সবচেয়ে ধূর্ত ফুটবলার’-ও বলা যায়। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সবার প্রিয় ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টাইন এই কিংবদন্তি যেমন বল পায়ে কারিশমার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছেন, তেমনি তাঁর ব্যক্তিজীবন ছিল বিতর্ক আর পাগলামির এক উন্মাতাল গোলকধাঁধা। মাঠে ও মাঠের বাইরে—সব জায়গাতেই তিনি ছিলেন এক ভিন্ন গ্রহের মানুষ। তাঁকে নিয়ে যত কথা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ছিল হয় মুগ্ধতার চূড়ান্ত অথবা সমালোচনার কশাঘাত। তাঁর জীবনের নানা পাগলামি আর বিতর্কিত গল্পের কয়েকটা জেনে নেওয়া যাক।
১৯৮৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল আসরে জয়ের পর ট্রফি হাতে ম্যারাডোনার উদযাপন। ছবি: এএপিশতাব্দীর সেরা গোল
১৯৮৬ সালের সেই ম্যাচের চার মিনিটের মাথায় ম্যারাডোনা যে গোলটি করেছিলেন, তা তর্কাতীতভাবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা গোলগুলোর অন্যতম। প্রায় মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে তিনি একাই ইংল্যান্ডের পাঁচজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে, গোলরক্ষক শিলটনকে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন। এই গোলটি প্রমাণ করে, ম্যারাডোনা চাইলে ‘ঈশ্বর’-এর হাত ছাড়াই শুধু পায়ের জাদুতে কী অসম্ভব কাজও করতে পারতেন। এই গোল আর ‘ঈশ্বরের হাত’—এই দুই বিপরীতমুখী ঘটনাই এক ম্যাচে ঘটিয়ে ম্যারাডোনা যেন নিজেকে ফুটবলের ইতিহাসে এক ‘আশ্চর্য প্রতিভা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
মাদক সেবনের দায়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ফুটবল কিংবদন্তি ম্যারাডোনা। সংগৃহীত ছবিকোকেন আসক্তি ও প্রথম নিষেধাজ্ঞা
ফুটবল ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা জুড়েই ম্যারাডোনা ছিলেন কোকেনের মতো মারণ নেশায় আসক্ত। ইতালির নাপোলিতে থাকাকালীন মাফিয়াদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। মাদকাসক্তি তাঁকে গ্রাস করে। ১৯৯১ সালে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়ার পর তাকে ১৫ মাসের জন্য ফুটবল হতে নিষিদ্ধ করা হয়। এই আসক্তির কারণে তাঁর ক্যারিয়ারের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। শুধু ম্যারাডোনার জন্যই নয়, এটি ছিল ফুটবলের জন্যও এক অপূরণীয় ক্ষতি।
গ্রিসের বিরুদ্ধে গোল করার পর ম্যারাডোনার হুঙ্কার। সংগৃহীত ছবি৯৪ বিশ্বকাপের পাগলাটে উদ্যাপন ও বহিষ্কার
১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে গ্রিসের বিপক্ষে গোল করার পর ম্যারাডোনা যে বন্য উদ্যাপন করেন, তা আজও ফুটবলপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছে। দৌড়ে কর্নার পতাকার দিকে গিয়ে তিনি টেলিভিশন ক্যামেরার লেন্সে মুখ রেখে এক অস্বাভাবিক চিৎকার করে ওঠেন। সেই উদ্যাপন মূলত ছিল তাঁর শরীরে নিষিদ্ধ শক্তিবর্ধক ওষুধ এফিড্রিনের প্রভাব। ফলস্বরূপ পরবর্তী ম্যাচেই ডোপ টেস্টে তিনি অকৃতকার্য হন এবং বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হন। প্রিয় তারকার এমন পতন সে সময় কোটি কোটি ভক্তের হৃদয় ভাঙার কারণ হয়েছিল।
বার্সেলোনার জার্সি গায়ে চাপিয়ে ম্যারাডোনা। সংগৃহীত ছবিবার্সেলোনায় হাতাহাতি: বিদায় ঘণ্টা
বার্সেলোনায় মাত্র দুই মৌসুমেই ম্যারাডোনা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। সময়টা ১৯৮৩-৮৪ কোপা দেল রে ফাইনাল, প্রতিপক্ষ অ্যাথলেটিক বিলবাও। পুরো ম্যাচেই বিলবাওয়ের খেলোয়াড়েরা ম্যারাডোনাকে বাজে ট্যাকল ও উত্ত্যক্ত করে। শেষ পর্যন্ত খেলা শেষে মাঠেই শুরু হয় হাতাহাতি। ম্যারাডোনা ক্ষেপে গিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে তেড়ে যান। স্টেডিয়ামে বসে থাকা স্পেনের রাজা হুয়ান কার্লোসও সেটি দেখেন। এরপর বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিক্রি করে দেয় ইতালির নাপোলির কাছে। এই ঘটনায় তাঁর উগ্র মেজাজ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব স্পষ্ট বোঝা যায়।
১৯৮৭ সালের ১০ মে নেপলসে ‘নাপোলি’ তাদের প্রথম ইতালীয় মেজর লিগ শিরোপা জয়ের পর দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা উল্লাস করছেন। ছবি: আল-জাজিরানাপোলির ‘রাজা’
নাপোলিতে ম্যারাডোনা ছিলেন ঈশ্বরের চেয়েও বেশি কিছু। ইতালির অবহেলিত দক্ষিণ অঞ্চলের এই ক্লাবটিকে তিনি তাঁর জাদুকরি ক্যারিশমা দিয়ে দুইবার ‘সিরি-আ’ শিরোপা জেতান। নেপলসবাসী তাঁকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। কথিত আছে, একবার জয়ের পর রাস্তায় নেমে হুল্লোড়ের সময় এক বৃদ্ধা তাকে ‘শয়তান’ বললে ম্যারাডোনা হেসে উত্তর দেন, ‘আমি ডিয়েগো, নেপলসের রাজা।’ মাদক সেবন, মাফিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বেপরোয়া জীবনযাপন করেও তিনি নেপলসবাসীর কাছে ছিলেন মুক্তি ও জয়ের প্রতীক।
সাংবাদিকদের ওপর গুলি চালাচ্ছেন ম্যারাডোনা। ছবি: বিবিসিসাংবাদিকদের ওপর গুলি
২০০৬ সালে ম্যারাডোনার একটি কাণ্ড বিশ্বজুড়ে আলোড়ন বেশ ফেলেছিল। নিজের বাড়ির বাইরে সাংবাদিকদের ভিড় দেখে তিনি এতটাই ক্ষিপ্ত হন যে, একটি এয়ার রাইফেল নিয়ে তাদের দিকে গুলি ছোড়েন। এতে কয়েকজন সাংবাদিক সামান্য আহত হন। আদালত তাঁকে এই কাজের জন্য চার বছর আট মাসের গৃহ কারাবাস (হোম ইমপ্রিজনমেন্ট) দেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে মিডিয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ তিনি কখনই সহ্য করতে পারেননি।
নিজের পায়ে আঁকা চে’র উল্কির ছবি ফিদেল কাস্ত্রোকে দেখাচ্ছেন ম্যারাডোনা। সংগৃহীত ছবিকিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ভক্ত
ম্যারাডোনা তাঁর শরীরে কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ও আর্জেন্টিনার বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারার ট্যাটু এঁকেছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল গভীর। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে তিনি কিউবাতে চিকিৎসাও নিয়েছেন। পশ্চিমাদের প্রবল সমালোচনা সত্ত্বেও এমন রাজনৈতিক আইকনদের প্রতি ভালোবাসা ছিল ম্যারাডোনার এক ধরনের পাগলামি।
ফুটবলের রাজপুত্র ডিয়েগো ম্যারাডোনার শেষ বিদায়। সংগৃহীত ছবিঅগণিত সন্তান ও সঙ্গী নিয়ে বিতর্ক
ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত জীবন ছিল চরম বিশৃঙ্খল। একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক, একাধিক সন্তান জন্মদান ও স্ত্রীর সঙ্গে কলহ—সবকিছুই তাঁকে নিয়মিত বিতর্কের কেন্দ্রে রাখত। অনেকবার তো তিনি তাঁর সন্তানদের স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকৃতি জানান, যা নিয়ে আদালত পর্যন্ত মামলা গড়ায়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়েও নানা বিতর্ক দেখা দেয়।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন অসামান্য প্রতিভাধর একজন শিল্পী। আর মানুষ হিসেবে ছিলেন ভীষণ খ্যাপাটে। তাঁর ফুটবল জাদু তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল ‘ফুটবল ঈশ্বরের’ আসনে, আর তাঁর বিতর্কিত জীবন তাঁকে টেনে নামিয়েছিল মাটির কাছাকাছি। এই দুই সত্তার দ্বন্দ্বই সবসময় তাঁকে অমর করে রাখবে ফুটবল ইতিহাসের পাতায়।