কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্মদিন আজ
আজ কবি ও গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্মদিন। জীবদ্দশায় শুধু সাহিত্য নিয়েই মেতে থেকেছেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি গল্প, প্রবন্ধ, গবেষণা—বিচিত্র দিকে ছিল তাঁর ঝোঁক। সবসময় চলতেন তরুণদের সঙ্গে। তবে শেষ জীবনে প্রাণোচ্ছ্বল এ মানুষটির চারপাশে কি শূন্যতার ছায়া ছিল? কবির জন্মদিনে গল্পে গল্পে সেসব খোলাসা করেছেন আশির দশকের অন্যতম কবি ও কথাসাহিত্যিক কাজল শাহনেওয়াজ।
কাজল শাহনেওয়াজ
কিছুদিন আড্ডা হলো আলিয়স ফ্রঁসেজে। বিকেলে ওদের ক্যাফেতে বসে। আমি তখন ধানমন্ডি রোড ১১-এতে ভাড়া বাসায় থাকি। আড্ডাস্থল হাঁটা পথের দূরত্ব। আবদুল মান্নান সৈয়দ—মান্নান ভাই আসেন গ্রিনরোডের নিজের বাসা থেকে।
মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা শুরু হয়েছে লালবাগ বা নবাবগঞ্জে ‘কবি’ পত্রিকার দফতরে চা-পুরি খেতে খেতে। তারপর একসময় আজিজ মার্কেটে অন্তর রেস্তোরাঁয় ভাজি পরোটার সঙ্গে। কিন্তু তা ছিল প্রলেতারিয়ান মুডে। হইচই, নয়েজ আর কথার পিঠে কথার পিঠাপিঠি। উত্তেজনা আর যুদ্ধে মোড়ানো। আলাপে থাকত সাহিত্য-রথীমহাজনদের রেফারেন্স। মান্নান ভাই কথায় কথায় সূত্র ধরে চলে যেতেন কলকাতার গল্পে। বা ভ্রাতা আল মাহমুদ বা শহীদ কাদরীর গল্পে। বা শামসুর রাহমান প্রসঙ্গে। কিন্তু আজ আলিয়সের এসি কাফেতে নীরবতার আড়ালে কথা হচ্ছে শুধু আমাদের দুজনে। মান্নান শোনাচ্ছেন তাঁর সদ্য এক প্রেমে পড়ার গল্প। তরুণ সেই কন্যার সঙ্গে রাত-বিরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলা চলছে। শুধু ঘরে বসে নয়, পথে-ঘাটে, রিকশায় চলতে চলতে কথা চলে। আর বাসায় ফিরে লেখেন রোজনামচা। তাতে ভরে থাকে গদ্যে পদ্যে নতুন প্রেমে পড়ার ঢেউ।
তখন একদিন আমার হাতে গুঁজে দিলেন ছোট্ট একটা পাণ্ডুলিপি। কাব্যনাটক: ‘কবি ও অন্যেরা’। মাত্র আট পৃষ্ঠার। আমার একটা গুপ্ত প্রকাশনা আছে, ‘ফৃ গ্রন্থিকা আন্দোলন’ নামে—সেখানে প্রকাশনার জন্য। নিজের হাতে টাইপ করে অফিসের লেজার প্রিন্টারে মাস্টার প্রিন্ট নিয়ে এবং ফটোকপিয়ার থেকে কপি করে পাতলা মলাটের একক বই প্রকাশ করি। এভাবে ইতিমধ্যে দুটো প্রকাশনা হয়েছে। মুস্তফা আনোয়ারের কাব্য নাটক ‘পতন নাই পুনরুত্থান নাই’ আর আমার একটা গল্প ‘বাবা নুরদীন’ নামে। মান্নান ভাই প্রেমাবেগে থরথর করে কবিতা লিখেছেন।
কবি: জানো নিনা, তোমার সংস্পর্শে এলে
কেন যেন আবার যুবক হয়ে উঠি।
আবার কবিতা আসে রাশি রাশি—
যেমন চৈত্রের পাতা ঝরে অফুরান
কিংবা শ্রাবণের বৃষ্টি অবিরল।
নিনা: [হাসে]! আমার তো সবসময় মনে হয় তুমি এক তরুণ যুবক—
তেইশ-চব্বিশ বছরের।
কবি: কী বলছো? জানো, আমি উত্তর-পঞ্চাশ?
মাতামহ হয়ে গেছি?
এত অপরূপ চোখ—
আমি ওই চোখের ভিতর দিয়ে
চলে যাচ্ছি মিশরের সূর্যাস্তবেলায়—গ্রিসের প্রাসাদে।
ওই অপরূপ নাসা,
ওই অপরূপ ঠোঁট—যা ক্রমশ খুলে যাচ্ছে
সোনার কৌটোর মতো,
আমি ওর ভিতরে প্রবেশ করব।
ঝটপট ফৃ গ্রন্থিকা আন্দোলন ০৩—‘কবি ও অন্যেরা’ হয়ে গেল। ফটোকপি করে ৫০ কপি তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, ছড়িয়ে দেন বাতাসে।
ঢাকায় তখন খুব বেশি লোডশেডিং। ২০০৮ সাল। সেই গ্রীষ্মের গরমে দুপুরবেলা বিদ্যুৎবিহীন ঘামে ভিজতে ভিজতে আমি একগুচ্ছ কবিতা লিখে ফেলেছি। ঢাকা শহরের দুইপ্রান্তের দুজনের মধ্যে টাওয়ারে টাওয়ারে চলে ভাবের লেনাদেনা। চাঁদটাকে দুই টুকরো করে তারা টানাটানি করে। বিদ্যুৎবিহীন রাতে আবাহনী মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে অত্যন্ত জ্বলজ্বলে তারাভরা আকাশের দিকে কবিতা ছোঁড়ে কবি। একের পর এক কবিতা হয়ে যায় হুতাশে। আলিয়ঁসের আড্ডায় মান্নান সৈয়দের কবিতা শুনে পরদিন পকেটে নিয়ে যাই সেই কবিতাগুলো। আমার ভেতরে ভীষণ কাব্যকাম খেলা করে উঠেছিল সেদিন। তাঁকে বলি, ‘মান্নান ভাই একগুচ্ছ কবিতা শোনাই।’ তাঁর সম্মতির অপেক্ষা না করেই এক বসাতেই পুরো সিরিজ পাঠ করে ফেলি। এভাবে জীবনে প্রথম কবিতা শোনানো হয় তাঁকে। প্রেমিক কবি আমার কবিতা শুনে উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত। ধানমন্ডি লেকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো যুগল যেন আমাদের টেবিলে এসে হাততালি দিচ্ছে, এমন হয়ে যায় দৃশ্য। কফিখানা তাঁর উদাত্তস্বর শুনে সচকিত হয়ে ওঠে। নীরবতা ভেঙে পড়ে। কফির কাপ ছলকায়। পাশের টেবিলে থেমে যায় গুলতানি।
২.
আড্ডা হতো আবিদ আজাদের ‘শিল্পতরু’ অফিসে।
‘শিল্পতরু’ তখন পুরোনো ঢাকা ছেড়ে নতুন ঢাকায়। লালবাগ-নবাবগঞ্জ থেকে বকশীবাজার ঢাকেশ্বরী রোড হয়ে ঠিকানা হলো কাঁঠালবাগান ঢালে। সোনারগাঁও রোড থেকে নেমে গেছে সরু লেন—লেনের একমাথায় ‘শিল্পতরু’ তারপর আমার বাসা—কাঁঠালবাগান বাজার হয়ে গ্রিনরোডে মিশেছে সেই রাস্তা। সেখানে মান্নান ভাইয়ের পৈত্রিক বাড়ি। ‘শিল্পতরু’তে গিয়ে প্রতিদিন বিকেলে তাই আড্ডা দিতে পরিশ্রম করতে হয় না। আমি আসলে তখন সদ্য বিয়ে করে জীবনের প্রথম পারিবারিক বাসা নিয়েছি ‘শিল্পতরু’র অফিসের কাছাকাছি, শাহবাগের আজিজ মার্কেটের সন্নিকটে। আগে থাকতাম বুয়েট অফিসার্স কোয়াটারে সাবলেটে। ব্যাচেলর লাইফ শেষে ফ্যামিলি লাইফে রূপান্তরিত হয়েও আমার স্বভাব বদলালো না। আড্ডা যথাপূর্ব সেই একই রকম।
পত্রিকার সম্পাদক আবিদ আজাদ। মোটাসোটা সাহিত্যশিল্পের মাসিকপত্র ‘শিল্পতরু’। এ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক হলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। সহকারী কখনো আহমদ মুজিব, কখনো অমিতাভ পাল। আড্ডা দিতে আসেন শিহাব সরকার, মাহবুব হাসান, রিফাত চৌধুরী, পুলক হাসান—অগ্রজ ও অনুজ অনেকে। আসেন আল মাহমুদ, মুস্তফা আনোয়ার।
মান্নান ভাই বাইরে জাঁদরেল কিন্তু ভেতরে শিশু। আড্ডায় মিনিটে মিনিটে নিজের কায়দায় অট্টহাসিতে ছড়িয়ে দেন প্রশংসা বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। হাসতে হাসতে কখনো তাঁর চোখের কোনায় এক ফোঁটা আবেগের পানি জমে। দেখে মনে হয় জীবনের প্রথম এ লোকটাকে জীবনানন্দ নিয়ে লেখা বই ‘শুদ্ধতম কবি’ পড়ে কত না গম্ভীর পণ্ডিত মনে হয়েছিল!
মান্নান ভাই হলেন বৈপরীত্যে ভরা প্রতিভা। তাঁর কবিতা সত্যিকারের বিশ্বায়ন। ছোটগল্পও তাই। কিন্তু কেন যে উপন্যাস লিখেছিলেন বুঝি না। আবার ঐতিহ্য-ইতিহাস অনুসন্ধানে যা কিছু গবেষণা করেছেন তা গবেষকের নিপুণ মুনশিয়ানা থেকে ছড়ায়ে গেছে ক্রিয়েটিভ স্পেকট্রামেও। রাত জাগতেন সৃষ্টির আনন্দে আর শেষে মুখামুখি হয়েছেন শূন্যতার। স্বজন ছিল শহরজুড়ে, শত্রুর অভাব ছিল না। কিন্তু সত্যিকারে নিঃসঙ্গ ছিলেন।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে লিখেছিলেন একটা কবিতা, প্রায় চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের। আজ হঠাৎ চোখে পড়ল। ‘কবিতার বই’ নামে বইয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। সহজ সরল কবিতা। কিন্তু বেদনায় দীর্ণ। তাঁর বিরাট পাণ্ডিত্য ভুলিয়ে আর স্বপ্নবাজের কল্পনা থেকে বেরিয়ে হাহাকার আর আর্তনাদ প্রকাশক মনে হয় কবিতাটাকে। দেশভাগ-পূর্ব বাংলার ভাষাঋণ এতে তেমন ছিল না। শুধু নজরুলের আভাস মনে ওঠে ‘বিলকুল’ শব্দে। পথের টানে এক রিক্ত প্রাণের দেখা পাই। নিঃসঙ্গ পলাশ-অশোকের রঙে বর্ণিল প্রেমিকটা গ্রিনরোডের মিডলক্লাশ সৈয়দ চরিত্র থেকে যেন আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন কিছু গোপন কথা। ব্যালাড? বিচ্ছেদগীতি? অন্তরট্রাজেডি? কি জানি কী!
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল ৷
দেখিনি তো সব ক-টি ডাল
ফুটন্ত পলাশে লালে-লাল।
আমি সে-পথেই যাচ্ছিলাম।
ঘুমের ভিতরে তারপর
চলে গেছে অনেক বছর।
সব সঁপেছিলাম অক্ষরে
মূর্খের মতন—মনে পড়ে।
আর মনে পড়ে দুটি চোখ:
দুপুরের পলাশ-অশোক ৷
আজ শুধু পড়ে দীর্ঘশ্বাস:
ও পলাশ! রক্তিম পলাশ!
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল।
রাস্তায় পড়ে আছে ফুল।
১২-১-২০০৬
২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ফোন করে আ.মা.সৈ. আমাকে বলেছিলেন, তাঁর প্রিয় বিষয় হচ্ছে লোক চটানো ও শাড়ি কেনা। তারপর বললেন, ‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ মুসলমান তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করেন না।’
মান্নানকে আমি মজার একটা সজারু ভাবি। তিনি আমাকে তাঁর সত্তর বছর বয়সে বলেছিলেন রবিবাবুর কথা, রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁর বউকে বলতেন, এটা রাঁধো, ওটা রাঁধো... কিন্তু নিজে কোনো রান্না করেননি। আর মান্নান সৈয়দ তাঁর বউকে বলেন, ডিম ভাঁজো, চিনি দাও... নিজে কিন্তু কাজটা করেন না...।
রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমান মন নিয়া লেখেননি? জীবনানন্দ কেন আধ্যাত্মিকতা নিয়ে?
এটা ছিল তাঁর জিজ্ঞাসা!
আসলে তিনি অনুবাদ করছেন। মান্নান সৈয়দ অনুবাদ করতেন। মান্নানের কাজই ছিল অনুবাদ। তাঁর নিজের ভাষায় সবাইকে অনুবাদ করতেন আবদুল মান্নান সৈয়দ কবি।
কিছুদিন আড্ডা হলো আলিয়স ফ্রঁসেজে। বিকেলে ওদের ক্যাফেতে বসে। আমি তখন ধানমন্ডি রোড ১১-এতে ভাড়া বাসায় থাকি। আড্ডাস্থল হাঁটা পথের দূরত্ব। আবদুল মান্নান সৈয়দ—মান্নান ভাই আসেন গ্রিনরোডের নিজের বাসা থেকে।
মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা শুরু হয়েছে লালবাগ বা নবাবগঞ্জে ‘কবি’ পত্রিকার দফতরে চা-পুরি খেতে খেতে। তারপর একসময় আজিজ মার্কেটে অন্তর রেস্তোরাঁয় ভাজি পরোটার সঙ্গে। কিন্তু তা ছিল প্রলেতারিয়ান মুডে। হইচই, নয়েজ আর কথার পিঠে কথার পিঠাপিঠি। উত্তেজনা আর যুদ্ধে মোড়ানো। আলাপে থাকত সাহিত্য-রথীমহাজনদের রেফারেন্স। মান্নান ভাই কথায় কথায় সূত্র ধরে চলে যেতেন কলকাতার গল্পে। বা ভ্রাতা আল মাহমুদ বা শহীদ কাদরীর গল্পে। বা শামসুর রাহমান প্রসঙ্গে। কিন্তু আজ আলিয়সের এসি কাফেতে নীরবতার আড়ালে কথা হচ্ছে শুধু আমাদের দুজনে। মান্নান শোনাচ্ছেন তাঁর সদ্য এক প্রেমে পড়ার গল্প। তরুণ সেই কন্যার সঙ্গে রাত-বিরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলা চলছে। শুধু ঘরে বসে নয়, পথে-ঘাটে, রিকশায় চলতে চলতে কথা চলে। আর বাসায় ফিরে লেখেন রোজনামচা। তাতে ভরে থাকে গদ্যে পদ্যে নতুন প্রেমে পড়ার ঢেউ।
তখন একদিন আমার হাতে গুঁজে দিলেন ছোট্ট একটা পাণ্ডুলিপি। কাব্যনাটক: ‘কবি ও অন্যেরা’। মাত্র আট পৃষ্ঠার। আমার একটা গুপ্ত প্রকাশনা আছে, ‘ফৃ গ্রন্থিকা আন্দোলন’ নামে—সেখানে প্রকাশনার জন্য। নিজের হাতে টাইপ করে অফিসের লেজার প্রিন্টারে মাস্টার প্রিন্ট নিয়ে এবং ফটোকপিয়ার থেকে কপি করে পাতলা মলাটের একক বই প্রকাশ করি। এভাবে ইতিমধ্যে দুটো প্রকাশনা হয়েছে। মুস্তফা আনোয়ারের কাব্য নাটক ‘পতন নাই পুনরুত্থান নাই’ আর আমার একটা গল্প ‘বাবা নুরদীন’ নামে। মান্নান ভাই প্রেমাবেগে থরথর করে কবিতা লিখেছেন।
কবি: জানো নিনা, তোমার সংস্পর্শে এলে
কেন যেন আবার যুবক হয়ে উঠি।
আবার কবিতা আসে রাশি রাশি—
যেমন চৈত্রের পাতা ঝরে অফুরান
কিংবা শ্রাবণের বৃষ্টি অবিরল।
নিনা: [হাসে]! আমার তো সবসময় মনে হয় তুমি এক তরুণ যুবক—
তেইশ-চব্বিশ বছরের।
কবি: কী বলছো? জানো, আমি উত্তর-পঞ্চাশ?
মাতামহ হয়ে গেছি?
এত অপরূপ চোখ—
আমি ওই চোখের ভিতর দিয়ে
চলে যাচ্ছি মিশরের সূর্যাস্তবেলায়—গ্রিসের প্রাসাদে।
ওই অপরূপ নাসা,
ওই অপরূপ ঠোঁট—যা ক্রমশ খুলে যাচ্ছে
সোনার কৌটোর মতো,
আমি ওর ভিতরে প্রবেশ করব।
ঝটপট ফৃ গ্রন্থিকা আন্দোলন ০৩—‘কবি ও অন্যেরা’ হয়ে গেল। ফটোকপি করে ৫০ কপি তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, ছড়িয়ে দেন বাতাসে।
ঢাকায় তখন খুব বেশি লোডশেডিং। ২০০৮ সাল। সেই গ্রীষ্মের গরমে দুপুরবেলা বিদ্যুৎবিহীন ঘামে ভিজতে ভিজতে আমি একগুচ্ছ কবিতা লিখে ফেলেছি। ঢাকা শহরের দুইপ্রান্তের দুজনের মধ্যে টাওয়ারে টাওয়ারে চলে ভাবের লেনাদেনা। চাঁদটাকে দুই টুকরো করে তারা টানাটানি করে। বিদ্যুৎবিহীন রাতে আবাহনী মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে অত্যন্ত জ্বলজ্বলে তারাভরা আকাশের দিকে কবিতা ছোঁড়ে কবি। একের পর এক কবিতা হয়ে যায় হুতাশে। আলিয়ঁসের আড্ডায় মান্নান সৈয়দের কবিতা শুনে পরদিন পকেটে নিয়ে যাই সেই কবিতাগুলো। আমার ভেতরে ভীষণ কাব্যকাম খেলা করে উঠেছিল সেদিন। তাঁকে বলি, ‘মান্নান ভাই একগুচ্ছ কবিতা শোনাই।’ তাঁর সম্মতির অপেক্ষা না করেই এক বসাতেই পুরো সিরিজ পাঠ করে ফেলি। এভাবে জীবনে প্রথম কবিতা শোনানো হয় তাঁকে। প্রেমিক কবি আমার কবিতা শুনে উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত। ধানমন্ডি লেকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো যুগল যেন আমাদের টেবিলে এসে হাততালি দিচ্ছে, এমন হয়ে যায় দৃশ্য। কফিখানা তাঁর উদাত্তস্বর শুনে সচকিত হয়ে ওঠে। নীরবতা ভেঙে পড়ে। কফির কাপ ছলকায়। পাশের টেবিলে থেমে যায় গুলতানি।
২.
আড্ডা হতো আবিদ আজাদের ‘শিল্পতরু’ অফিসে।
‘শিল্পতরু’ তখন পুরোনো ঢাকা ছেড়ে নতুন ঢাকায়। লালবাগ-নবাবগঞ্জ থেকে বকশীবাজার ঢাকেশ্বরী রোড হয়ে ঠিকানা হলো কাঁঠালবাগান ঢালে। সোনারগাঁও রোড থেকে নেমে গেছে সরু লেন—লেনের একমাথায় ‘শিল্পতরু’ তারপর আমার বাসা—কাঁঠালবাগান বাজার হয়ে গ্রিনরোডে মিশেছে সেই রাস্তা। সেখানে মান্নান ভাইয়ের পৈত্রিক বাড়ি। ‘শিল্পতরু’তে গিয়ে প্রতিদিন বিকেলে তাই আড্ডা দিতে পরিশ্রম করতে হয় না। আমি আসলে তখন সদ্য বিয়ে করে জীবনের প্রথম পারিবারিক বাসা নিয়েছি ‘শিল্পতরু’র অফিসের কাছাকাছি, শাহবাগের আজিজ মার্কেটের সন্নিকটে। আগে থাকতাম বুয়েট অফিসার্স কোয়াটারে সাবলেটে। ব্যাচেলর লাইফ শেষে ফ্যামিলি লাইফে রূপান্তরিত হয়েও আমার স্বভাব বদলালো না। আড্ডা যথাপূর্ব সেই একই রকম।
পত্রিকার সম্পাদক আবিদ আজাদ। মোটাসোটা সাহিত্যশিল্পের মাসিকপত্র ‘শিল্পতরু’। এ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক হলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। সহকারী কখনো আহমদ মুজিব, কখনো অমিতাভ পাল। আড্ডা দিতে আসেন শিহাব সরকার, মাহবুব হাসান, রিফাত চৌধুরী, পুলক হাসান—অগ্রজ ও অনুজ অনেকে। আসেন আল মাহমুদ, মুস্তফা আনোয়ার।
মান্নান ভাই বাইরে জাঁদরেল কিন্তু ভেতরে শিশু। আড্ডায় মিনিটে মিনিটে নিজের কায়দায় অট্টহাসিতে ছড়িয়ে দেন প্রশংসা বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। হাসতে হাসতে কখনো তাঁর চোখের কোনায় এক ফোঁটা আবেগের পানি জমে। দেখে মনে হয় জীবনের প্রথম এ লোকটাকে জীবনানন্দ নিয়ে লেখা বই ‘শুদ্ধতম কবি’ পড়ে কত না গম্ভীর পণ্ডিত মনে হয়েছিল!
মান্নান ভাই হলেন বৈপরীত্যে ভরা প্রতিভা। তাঁর কবিতা সত্যিকারের বিশ্বায়ন। ছোটগল্পও তাই। কিন্তু কেন যে উপন্যাস লিখেছিলেন বুঝি না। আবার ঐতিহ্য-ইতিহাস অনুসন্ধানে যা কিছু গবেষণা করেছেন তা গবেষকের নিপুণ মুনশিয়ানা থেকে ছড়ায়ে গেছে ক্রিয়েটিভ স্পেকট্রামেও। রাত জাগতেন সৃষ্টির আনন্দে আর শেষে মুখামুখি হয়েছেন শূন্যতার। স্বজন ছিল শহরজুড়ে, শত্রুর অভাব ছিল না। কিন্তু সত্যিকারে নিঃসঙ্গ ছিলেন।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে লিখেছিলেন একটা কবিতা, প্রায় চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের। আজ হঠাৎ চোখে পড়ল। ‘কবিতার বই’ নামে বইয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। সহজ সরল কবিতা। কিন্তু বেদনায় দীর্ণ। তাঁর বিরাট পাণ্ডিত্য ভুলিয়ে আর স্বপ্নবাজের কল্পনা থেকে বেরিয়ে হাহাকার আর আর্তনাদ প্রকাশক মনে হয় কবিতাটাকে। দেশভাগ-পূর্ব বাংলার ভাষাঋণ এতে তেমন ছিল না। শুধু নজরুলের আভাস মনে ওঠে ‘বিলকুল’ শব্দে। পথের টানে এক রিক্ত প্রাণের দেখা পাই। নিঃসঙ্গ পলাশ-অশোকের রঙে বর্ণিল প্রেমিকটা গ্রিনরোডের মিডলক্লাশ সৈয়দ চরিত্র থেকে যেন আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন কিছু গোপন কথা। ব্যালাড? বিচ্ছেদগীতি? অন্তরট্রাজেডি? কি জানি কী!
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল ৷
দেখিনি তো সব ক-টি ডাল
ফুটন্ত পলাশে লালে-লাল।
আমি সে-পথেই যাচ্ছিলাম।
ঘুমের ভিতরে তারপর
চলে গেছে অনেক বছর।
সব সঁপেছিলাম অক্ষরে
মূর্খের মতন—মনে পড়ে।
আর মনে পড়ে দুটি চোখ:
দুপুরের পলাশ-অশোক ৷
আজ শুধু পড়ে দীর্ঘশ্বাস:
ও পলাশ! রক্তিম পলাশ!
ভুল হয়ে গেছে বিলকুল।
রাস্তায় পড়ে আছে ফুল।
১২-১-২০০৬
২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ফোন করে আ.মা.সৈ. আমাকে বলেছিলেন, তাঁর প্রিয় বিষয় হচ্ছে লোক চটানো ও শাড়ি কেনা। তারপর বললেন, ‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ মুসলমান তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করেন না।’
মান্নানকে আমি মজার একটা সজারু ভাবি। তিনি আমাকে তাঁর সত্তর বছর বয়সে বলেছিলেন রবিবাবুর কথা, রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁর বউকে বলতেন, এটা রাঁধো, ওটা রাঁধো... কিন্তু নিজে কোনো রান্না করেননি। আর মান্নান সৈয়দ তাঁর বউকে বলেন, ডিম ভাঁজো, চিনি দাও... নিজে কিন্তু কাজটা করেন না...।
রবীন্দ্রনাথ কেন মুসলমান মন নিয়া লেখেননি? জীবনানন্দ কেন আধ্যাত্মিকতা নিয়ে?
এটা ছিল তাঁর জিজ্ঞাসা!
আসলে তিনি অনুবাদ করছেন। মান্নান সৈয়দ অনুবাদ করতেন। মান্নানের কাজই ছিল অনুবাদ। তাঁর নিজের ভাষায় সবাইকে অনুবাদ করতেন আবদুল মান্নান সৈয়দ কবি।
জয়া না বিপাশা– কে বেশি সুন্দর? দুই দিন ধরে ফেসবুকীয় বাহাসের শীর্ষে এই প্রশ্ন। শুনে মনে হতে পারে সালটা ২০০৪। যেখানে সদ্য গোঁফ-গজানো দুই কিশোর সিডির দোকানের বাইরে এই তর্কে-বিতর্কে মশগুল।
১৪ ঘণ্টা আগে১৯৫০ সাল। মাত্র ২১ বছর বয়স তখন কিশোর কুমারের। বছর চারেক আগেই আভাস কুমার গাঙ্গুলী নাম পাল্টে হয়েছেন ‘কিশোর কুমার’। গায়ক হিসেবে তেমন পরিচিত নন তখনও। তাঁর দাদা অশোক কুমার সে সময় হিন্দি সিনেমার আইকনিক অভিনেতা। অশোকের ছোট ভাই হিসেবেই মানুষ তাঁকে চেনে।
১৬ ঘণ্টা আগেআজকের ঢাকা, কলকাতা বা লন্ডনে বাস ছাড়া এক মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। এক সময় একসঙ্গে এতজন নিয়ে কোনো যানবাহন চলাচল করবে, তা হয়তো কেউ চিন্তাও করে নি। কিন্তু ধীরে ধীরে এই চিন্তাটা মানুষ করেছে। কে প্রথম ভাবল সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার কথা?
১৬ ঘণ্টা আগেঢাকায় একসময় আফিম থেকে তৈরি নেশাদ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ফেসবুকে পুরান ঢাকার একটি আফিমের দোকানের ছবি মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা, 'আফিমের দোকান'। চার শ বছরের ঐহিত্যবাহী শহর ঢাকায় প্রথম কাদের হাত ধরে এসেছিল আফিম নামের নেশাদ্রব্য? কোন স্বার্থে কারা এর বিস্তার ঘটালেন?
৪ দিন আগে