leadT1ad

নজরুলের ফারসি বহুলতাকে পূর্ব বাংলার কৃষক-সন্তানেরা যে কারণে গ্রহণ করেছিল

আজ কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিন। বিদ্রোহী এই কবিকে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মানুষেরা কেন আপন করে নিয়েছিল, তার পেছনে রয়েছে সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তত্ত্বিক কারণ। কবির প্রয়াণ দিবসে তার সুলুক-সন্ধান।

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ২০: ৫৩
আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ২১: ২২
স্ট্রিম গ্রাফিক

কাজী নজরুল ইসলামের ভাষার জগত একটা কুহকের মতো। যেসব জিনিস একে অপরের সঙ্গে খাপ খায় না বলে রীতিমত প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে আধুনিক সমাজে, নজরুল সেসব নিয়ে ‘বিরাট শিশু’র মতো খেলে গেছেন। তবে একটু যদি সেসবের পেছনের যে ইতিহাস আড়াল করে রাখা হয়েছে, সেদিকে নজর দেওয়া যায়, তবে অনেক কৌতুহলউদ্দিপক কাণ্ড-কারখানা বের হয়ে আসবে। তেমনই এক বিষয় হলো নজরুল কেন তাঁর কবিতায় ফারসি ভাষা নানাভাবে ব্যবহার করেছেন, কেন উর্দু ভাষা এ কবির কবিতায় সেভাবে গৃহীত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে জটিল এক সমাজিক ইতিহাস ও মনস্তত্ত্ব। কখনো কখনো যাকে শ্রেণী-দ্বন্দ হিসেবেও হয়তো দেখা যেতে পারে।

কীভাবে তিনি ফারসি শিখলেন

নজরুল তাঁর কাব্যে ব্যাপকভাবে ফারসি শব্দ ও ভাব ব্যবহার করেছেন। এ ব্যবহার কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের সঙ্গে শুধু কি তাঁর সংযুক্তির ফল? ভাসা ভাসা পর্যবেক্ষণ তাই-ই বলে। নজরুল তা করেছেনও, অবলীলায়। যেন স্বভাবগতভাবেই। কবির জন্মস্থান চুরুলিয়ার মাতৃভাষা বাংলার রূপটি ছিল এমনই ফারসি-উর্দু মিশ্রিত। তাই নজরুলের পক্ষে এমন সব ফারসি শব্দের ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে ঘটানো সম্ভব হয়েছে, যা সে সময়ের সাধারণ লোকজন নিজেদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ব্যবহার করত।

১৮৩৮ সালে এক রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে ইংরেজিকে সরকারিভাষা করা হয়। তবুও বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত ফারসির চর্চা শিক্ষিত সমাজে—হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে—নিজস্ব মর্যাদায় টিকে ছিল।

ভৌগোলিকভাবে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের কিছুটা উত্তরে শুরু হয়েছে উর্দুভাষী বিহারী অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ড রাজ্য। এ কারণেই চুরুলিয়া অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও তাদের ভাষায় উর্দুর প্রভাব ছিল প্রবল। তবে কীভাবে তিনি ফারসি ভাষা শিখলেন?

উর্দু ভাষায় যেহেতু ফারসি শব্দভান্ডারের ব্যবহার বেশি, তাই ভৌগোলিক পরিস্থিতির কারণে ছোটবেলা থেকেই নজরুল উর্দুর মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠেন ফারসি শব্দরাজির সঙ্গে।

নজরুলের জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, ফারসি ভাষার সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক পরিচয় ঘটে চুরুলিয়া গ্রামের মক্তবে শিক্ষা নেওয়ার সময়। তখন মক্তবগুলোয় কিংবদন্তি ফারসি কবি শেখ সাদির ‘গুলিস্তান’, ‘বুস্তান’ ও ‘পান্দনামা’, ফরিদুদ্দিন আত্তারের ‘পান্দনামা’ ও ‘মানতেকুত্তাইর’, এবং মৌলানা রুমির ‘মসনভি শরিফ’ পাঠ করা হতো। ফলে শৈশবেই নজরুল ফারসির ওপর প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। শৈশবে তিনি তাঁর চাচা বজলে করিমের কাছ থেকেও ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রাথমিক তালিম নিয়েছিলেন।

নজরুলের ফারসিজ্ঞান পাকা হয় ১৯১৭ সালে, যখন তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে বর্তমান পাকিস্তানের করাচি শহরে যান। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনূদিত ‘রুবাইয়াত-ই-হাফিজ’ গ্রন্থের মুখবন্ধে নজরুল নিজেই লিখেছেন, ‘আমি যখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি, সে… ইংরেজি ১৯১৭ সালের কথা, সেখানেই প্রথম হাফিজের সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন মৌলভি সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি “দীওয়ান-ই-হাফিজ” থেকে কতগুলি কবিতা আবৃতি করে শোনান। শুনে আমি এমনি মুগ্ধ হয়ে যাই যে সেদিন থেকেই তাঁর কাছে ফারসি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি। তাঁর কাছেই ক্রমে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি।’

ফারসি আর বাংলা ভাষার সংযোগ

বাংলাদেশ মুসলিম শাসনে আসার পর থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৬৩৪ বছর বাংলার সরকারি ভাষা তথা রাজভাষা ছিল ফারসি। চাকরি পাওয়ার জন্য এখন যেমন ইংরেজি জানা অপরিহার্য, তখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে হলে—হিন্দু, মুসলমান বা অন্য যে-ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন—ফারসি ভাষা জানা ছিল আবশ্যক। সংগত কারণে এই ছয় শতাধিক বছরে হাজারো ফারসি ও ফারসিনির্ভর আরবি শব্দ ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে।

কাজী নজরুল ইসলাম। সংগৃহীত ছবি
কাজী নজরুল ইসলাম। সংগৃহীত ছবি

ফারসি ভাষার প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা দেশ দখল করলেও প্রায় ৮১ বছর তারা নিজেদের মাতৃভাষা ইংরেজির মাধ্যমে শাসনকাজ চালাতে পারেনি। ১৮৩৮ সালে এক রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে ইংরেজিকে সরকারিভাষা করা হয়। তবুও বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত ফারসির চর্চা শিক্ষিত সমাজে—হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে—নিজস্ব মর্যাদায় টিকে ছিল। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে গেলেও এর ব্যবহার ও চর্চা কিছুটা রয়ে গিয়েছিল।

আর বাংলা অঞ্চলে ফারসির চর্চা ছিল দীর্ঘ সময়। স্বাভাবিকভাবেই এই সময়ের মধ্যে যে বাংলা গড়ে উঠেছিল, তার যেটুকু গদ্য ছিল, তা আজকের গদ্যের মতো ছিল না। সেই সময়ের মুখের কথার মধ্যেও বেশ ভালো রকমভাবে ছিল ফারসির ছাপ। ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যে বাংলা তৈরি করল, সেখানে ইংরেজ আসার আগে এখানে যে বাংলা প্রচলিত ছিল, তা ঝাটিয়ে বিদায় করা হয়। কিন্তু হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সেই পুরোনো বাংলার ছাপ কি মরে যাবে? তা সবচেয়ে বেশি থেকে গেল পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের মুখের কথায়, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ অধ্যুষিত কলকাতা নগর থেকে দূরে। নতুন শোষকের সঙ্গে বৈরিতা কৃষক যেন টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল তার মুখের কথায়! নজরুলের লেখায় ফারসি ভাষার প্রতি আগ্রহ হয়তো বিস্মৃত যুগের সঙ্গে জীবিত কৃষকের মুখের কথার সংযোগের একটা প্রচেষ্টা। যেমন ‘মসনভি’র একেবারে শুরুতে মওলানা রুমি বলেছিলেন:

‘বেশনো আয্ ন্যায় চূন্ হেকা’ইয়াত্ মী কোনাদ্

আয্ জোদা’ঈহা’ শেকা’ইয়াত্ মী কোনাদ্’

নজরুল এর অনুবাদ করেছেন তাঁর ‘বাঁশির ব্যথা’ কবিতায়। এবার সেটাই পড়া যাক:

‘শোন দেখি মন বাঁশের বাঁশির বুক জেগে কী উঠবে সুর,

সুর তো নয় ও কাঁদবে যে রে বাঁশরি বিচ্ছেদ বিধুর।’

ফারসিপ্রেমী নজরুলকে কারা গ্রহণ করল

নজরুলের কবিতায় এই ফারসি প্রভাব আসলে কৃষক শ্রেণী থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হওয়ার দিকে ধাবিত মুসলিম তরূণদের পথেয় হয়ে উঠেছিল। এর সঙ্গে আছে পাটের হাত ধরে পূর্ব বাংলার কৃষকের নতুন অর্থনৈতিক দুনিয়ায় প্রবেশের বাস্তবতা।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। ঔপনিবেশিক যুগে পূর্ব বাংলার মুসলিম কৃষকদের শিক্ষার হার ছিল খুব কম। তবে পাট থেকে আসা অর্থ তাদের শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ধীরে ধীরে ১৯৩১ সালে ৭ শতাংশে পৌঁছে। পাট চাষের ফলে কৃষক পরিবারগুলোতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসার পর নতুন প্রজন্মকে তারা শিক্ষিত করতে আগ্রহী হয়। 

পূর্ব বাংলায় যাঁরা উর্দুচর্চা করতেন, তাঁদের মনোজগতে এই বাংলার গরিব কৃষকদের আকাঙ্ক্ষার কোনো স্থান ছিল না। বলা ভালো, এই উর্দুভাষী অভিজাতরাই মূলত মুসলিম লীগ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু নজরুল সেদিকে যাননি। তিনি গিয়েছেন সাম্যবাদী রাজনীতির দিকে।

নজরুল হয়ে উঠলেন এই কৃষকের শিক্ষিত সন্তানদের আশ্রয়। ইংরেজ শাসনের প্রশাসনিক কলকব্জায় এ উদীয়মান শ্রেণীর জায়গা পাওয়া কঠিন ছিল। ‘চাষার ছেলে’ হিসেবে কৌলিন্যের দাবিও তারা করতে পারত না। এই জনগোষ্ঠীর অবলম্বন হয়ে উঠেছিলেন নজরুল। তাই পূর্ব বাংলার এই মানুষদের কাছেই বারবার ফিরে এসেছেনে, ভালোবাসা পেয়েছেন নজরুল।

কৃষক সত্ত্বা বিদ্রেহী কবির মধ্যে সরাসরি নেই। তিনি যে চুরুলিয়ায় জন্মেছেন, ওই অঞ্চলে কৃষি থাকলেও তা প্রবল ছিল না। বাংলা তাঁর কবিতায় এসেছে শ্যামলিমার সুষমায়। খেটে খাওয়া মানুষ মূলত তাঁর জগতে এসেছে শ্রমিক হয়ে। জল-কাদার পূর্ব বঙ্গের জীবন তিনি তেমন জানার সুযোগ পাননি। পাটের হাত ধরে বাংলার উঠতি কৃষকের সন্তানেরা এগিয়ে গিয়ে তাঁকে গ্রহণ করেছে।

তাঁর সঙ্গে উর্দুর সম্পর্ক এত কম কেন  

নজরুল অনুবাদ করেছেন ফারসি ভাষার বিখ্যাত কবি হাফিজ আর ওমর খৈয়াম। কিছুটা শেখ সাদিও। কিন্তু উর্দু কবিতার সঙ্গে তাঁর সংযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁর কবিতায় ফারসি ব্যবহৃত হয়েছে প্রবলভাবে। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হলো, উর্দুর উল্লেখ তেমন নেই, নেই ব্যবহারও। এর সঙ্গে একটা ঐতিহাসিক আর সামাজিক বাস্তবের যোগ আছে। ব্রিটিশ শাসনের আগপর্যন্ত হিন্দুস্তানের প্রশাসনে ফারসি ভাষা ছিল দাপ্তরিক কাজের প্রধান মাধ্যম। তবে ১৮৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময়ে ফারসির জায়গায় প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার শুরু হয় স্থানীয় ভাষা ও ইংরেজির। আর উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও আউধ অঞ্চলে উর্দুকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

সাবেক যে অভিজাত মুসলমান শ্রেণী পশ্চিম ও পূর্ব বাংলায় বসবাস করতেন, তাঁরা নিজেদের এ মাটির সন্তান মনে করতেন না। নিজস্ব আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে উর্দু ভাষাই চর্চা করতেন। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রাখতেন উত্তর ভারতের সঙ্গে। ঢাকায় হাকিম হাবিবুর রহমানের তিবিবয়া হাবিবিয়া কলেজে উর্দু কবিতা পাঠের আসর মুশায়রা জমে উঠত। হাকিম সাহেবের মুশায়েরায় নজরুলও একবার উপস্থিত ছিলেন।

ফারসি তো প্রায় হাজার বছরে বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। উর্দুর সেই ইতিহাস ছিল না। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ক্ষীণ সম্পর্ক থাকা কৃষকের কাছে উর্দুর ছিল না সেই আবেদন। পূর্ব বাংলায় যাঁরা উর্দুচর্চা করতেন, তাঁদের মনোজগতে এই বাংলার গরিব কৃষকদের আকাঙ্ক্ষার কোনো স্থান ছিল না। বলা ভালো, এই উর্দুভাষী অভিজাতরাই মূলত মুসলিম লীগ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু নজরুল সেদিকে যাননি। তিনি গিয়েছেন সাম্যবাদী রাজনীতির দিকে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত