leadT1ad

হারুকি মুরাকামি কেন নোবেল পুরস্কার পান না

আজ ঘোষণা করা হবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। কে পাবেন সাহিত্যের এই সম্মানজনক শিরোপা? বিগত বছরগুলোর মতো অতটা না হলেও এবারও আলোচনায় আছে জাপানে জন্ম নেওয়া বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির নাম। প্রতিবছর নাম আর বাজিতে এগিয়ে থাকার পরও কেন তাঁকে ‘বেল’ দেয় না সুইডেনের নোবেল কমিটি?

উপল বড়ুয়া
উপল বড়ুয়া
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ২৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

গত কয়েক বছর ধরে হারুকি মুরাকামি কেন নোবেল পান না, তা নিয়ে সাহিত্যপাড়া থেকে সংবাদপত্রের অফিসে যে পরিমাণ আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তা দিয়ে সাত খণ্ড রামায়ণ লেখা যাবে মনে হয়। এ এক আশ্চর্যেরও বিষয় বটে। বছরের পর বছর ধরে নোবেলের শর্ট লিস্টে থাকে এ লেখকের নাম। বাজিতেও অনেকের চেয়েও এগিয়ে থাকেন তিনি। কিন্তু পুরস্কার হাতে ওঠে না মুরাকামির। হা কপাল!

সাহিত্যের নোবেলকে আমরা যথেষ্টই ‘বেল’ দিই। আমাদের দেশের মানুষজন প্রতিবছরই আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করেন, এবার নোবেল পুরস্কার কে পাচ্ছেন, তা দেখার জন্য। নোবেল তো অনেক ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয়। তবে আমাদের দেশে সাহিত্য ও শান্তিতে কে নোবেল পাচ্ছেন, তা নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনা চলে, এটি বোধহয় আর কোনো ক্যাটাগরি নিয়ে হয় না।

এই যে সাহিত্য আর শান্তিতে নোবেল নিয়ে আমাদের দেশে এত হইচই, এর কারণ কী?

কারণটি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। এই দুই ক্যাটাগরিতেই তো বাঙালির গর্ব করার মতো ‘মানিক-ধন’ আছেন। নোবেল নিয়ে এই তল্লাটে পক্ষে-বিপক্ষে বলার লোকের অভাব নেই। বছর কয়েক আগে বব ডিলান নোবেল পাওয়ার পর তো এমন বিতর্ক বাঁধল, সুইডিশ একাডেমির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছেড়েছিলেন কবি-লেখকেরা।

বব ডিলান ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সংগৃহীত ছবি
বব ডিলান ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সংগৃহীত ছবি

আর করবেনই না বা কেন! দুনিয়াতে এত এত সিরিয়াস কবি-সাহিত্যিক থাকতে কী না ২০১৬ সালে নোবেল পেলেন ‘গায়ক’ বব ডিলান! কী এমন করেছেন তিনি! গিটার বাজিয়ে কিছু গানই তো গেয়েছেন! সে তো কতজনই করেন! তা বলে সাহিত্যে নোবেলের মতো ‘প্রেস্টিজিয়াস’ পুরস্কার!

তবে ডিলানেরই বা দোষ কী! তিনি তো যেচে পড়ে নোবেল চাননি। সুইডিশ একাডেমির মনে হয়েছে, ডিলানের গানের কথায় সাহিত্যের রস-ভাব রয়েছে, তাই তাঁকে নোবেল দিয়েছে তারা!

কিন্তু প্রতিবছর নোবেলের সময় ঘনিয়ে আসে, আর দারুণভাবে আশাহত হন হারুকি মুরাকামির পাঠকেরা। না, বছরের পর বছর যায়, শর্ট লিস্টে নাম থাকার পরও নোবেলের সিঁকে ছেড়ে না জাপানি এই বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিকের।

অথচ কত অপরিচিতজন কবি-কথাসাহিত্যিক নোবেল জিতে নিলেন! মো ইয়ান, প্যাট্রিক মোদিয়ানো, সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ, আবদুলরাজ্জাক গুরনাহ, অ্যানি আর্নো বা হ্যান ক্যাং—গত কয়েক বছরে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া এই সাহিত্যিকদের নাম কি আপনি আগে শুনেছিলেন?

সুইডিশ একাডেমিও মজার কাণ্ড করে ফি বছর। আলোচনায় থাকাদের বুক ভেঙে দিয়ে নোবেলের জন্য ঘোষণা করে আমাদের এই অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত কোনো সাহিত্যিকের নাম। এ যেন ‘প্রেম তোমার সঙ্গে আর বিয়ে বিসিএস ক্যাডারের সঙ্গে’ মতো ব্যাপার। এবারও কি তেমন কিছু ঘটবে?

সুইডিশ একাডেমিও মজার কাণ্ড করে ফি বছর। আলোচনায় থাকাদের বুক ভেঙে দিয়ে নোবেলের জন্য ঘোষণা করে আমাদের এই অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত কোনো সাহিত্যিকের নাম। এ যেন ‘প্রেম তোমার সঙ্গে আর বিয়ে বিসিএস ক্যাডারের সঙ্গে’ মতো ব্যাপার। এবারও কি তেমন কিছু ঘটবে?

আজই তো সাহিত্যিকদের হার্টবিট বাড়িয়ে দেওয়া সেই দিন। বলুন তো কার হাতে উঠছে নোবেল? কেউ বলছে জেরাল্ড মারনেইন, কেউ বলছে, অ্যান কার্সনের নাম। মির্সা কার্টারেস্কু ও সিরিয়ার অ্যাদোনিস ও ফিলিস্তিনের কবি মোসাব আবু তোহার হাতেও অনেকে দেখতে চাইছেন নোবেল। কিন্তু সবার আশা তো আর একসঙ্গে পূরণ হবে না।

বলা ভালো, অতীত ইতিহাসের কারণে হারুকি মুরাকামি এবার তেমন আলোচনায় নেই। তারপরও বাজির দরে ওপরের দিকেই আছেন তিনি। লিটেরারি হাবের যে শর্ট লিস্ট, সেখানে মুরাকামি ছাড়াও আছেন সালমান রুশদি ও স্টিফেন কিং। মুরাকামির মতো তাঁরাও শর্ট লিস্টে থাকতে থাকতে বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু নোবেল কমিটির পাষাণ মন গলেনি। এবারও রুশদি ও কিংয়ের পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিতর্কিত উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর জন্য শারীরিকভাবেও মারাত্মক লাঞ্চিত হতে হয়েছে সালমান রুশদিকে। তাই তাঁর নোবেল পাওয়া মানে হয়তো বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালা। স্বাভাবিকভাবে সে পথে বোধ করি হাঁটবে না সুইডিশ একাডেমি।

২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং। সংগৃহীত ছবি
২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং। সংগৃহীত ছবি

আর বব ডিলানকে নোবেল দেওয়ার পরে সমালোচকদের দাঁতের ধার কেমন, তা কি হাড়েহাড়ে বোঝেনি তারা! অন্যদিকে স্টিফেন কিং বাদ পড়তে পারেন এই কারণে যে হরর ঘরানার লেখাজোখা কোনো সিরিয়াস সাহিত্য নয়। সে কারণে কখনো থ্রিলারের রাজা ড্যান ব্রাউনও নোবেলের তালিকায় থাকবেন না। আবার ‘জনপ্রিয়তার’ দোষে পাওলো কোয়েলহোকে তো নোবেলের চিন্তাতেও রাখা হয় না। অথচ মুরাকামি থেকে কোয়েলহো—বিশ্বজুড়ে সবারই বিশাল পাঠক সমাজ রয়েছে। এমনকি পিটার হান্ডকে, মো ইয়ান বা আবদুলরাজ্জাক গুরনাহর চেয়ে তাঁদের বই কয়েক গুণ বেশি বিক্রি হয়। কিন্তু শুধু জনপ্রিয়তা ও বই বিক্রি কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের মাপকাঠি নয়!

খুব আলোচনা না হলেও বরাবরের মতো মুরাকামি ভক্তরা এবারও আশাবাদী। তাঁর নোবেল না পাওয়ার পেছনে অবশ্য কারণ অনেক। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বা ওরহান পামুকের উপন্যাসের যে বিশাল ক্যানভাস, সে তুলনায় মুরাকামির আখ্যানের পরিসর বেশ ছোট। এটি শুধু চরিত্রগত, প্লট বা উপন্যাসের আয়তনের বিষয় নয়।

ফ্রানৎস কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ বা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ কি খু্ব বড়? অনেক চরিত্রে ভরা? মোটেও নয়। তারপরও এই দুই নভেলায় জীবন ও সভ্যতার যে রুক্ষ-বাস্তব ধারণা বা বিশালত্ব, তা অনুপস্থিত মুরাকামির উপন্যাসে। এমনকি তাঁর দুই খণ্ডের ‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসেও জীবনের গভীরতা খুব বেশি দেখা যায়নি।

লিটেরারি হাবের যে শর্ট লিস্ট, সেখানে মুরাকামি ছাড়াও আছেন সালমান রুশদি ও স্টিফেন কিং। মুরাকামির মতো তাঁরাও শর্ট লিস্টে থাকতে থাকতে বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু নোবেল কমিটির পাষাণ মন গলেনি। এবারও রুশদি ও কিংয়ের পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিতর্কিত উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর জন্য শারীরিকভাবেও মারাত্মক লাঞ্চিত হতে হয়েছে সালমান রুশদিকে। তাই তাঁর নোবেল পাওয়া মানে হয়তো বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালা।

তবে মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ বেশ চমৎকার। আধুনিক সাহিত্যে তারুণ্যের এমন প্রেমকাহিনি আর কয়টি আছে! তবে নোবেল পাওয়ার জন্য শুধু ‘নরওয়েজিয়ান উড’ বা ‘সুপার-ফ্রগ সেভস টোকিও’র মতো গল্পই যথেষ্ট নয়। নোবেল পাওয়া মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ বা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড’ পড়লেই বোঝা যায়, একটি উপন্যাসের শুরু থেকে শেষের ভেতর কত ডিটেইলিং থাকে। থাকে জীবনের কথা আর চরিত্রের দ্বান্দ্বিকতা। মার্কেসের নভেলা ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখা না’ আয়তনে ছোট। তবে জীবন নিয়ে যে সুক্ষ্ণ বর্ণনা, শ্লেষ, অপেক্ষা দেখি, তা কি প্রতিটি মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি নয়? অথবা নোবেল পুরস্কার পাওয়া তুরস্কের ওরহান পামুকের ‘মাই নেম ইজ রেড’ ও ‘দ্য রেড হেয়ার্ড ওম্যান’ও জীবন-সভ্যতার একখণ্ড দলিল হয়ে আছে।

হারুকি মুরাকামির বই। সংগৃহীত ছবি
হারুকি মুরাকামির বই। সংগৃহীত ছবি

বাস্তবতা হলো, হারুকি মুরাকামি জনপ্রিয় ঘরানার লেখক। অনেকে তাঁকে ‘পার্ল ফিকশন রাইটার’ হিসেবেও চিহ্নিত করতে চান। এটাও কি এ লেখকের নোবেল না পাওয়ার পেছনে একটি কারণ হতে পারে?

নোবেল না পেলেও মুরাকামির ভক্তের সংখ্যা কমবে বলে মনে হয় না। কালজয়ী সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিও থাকবেন। থাকবেন সালমান রুশদি ও স্টিফেন কিংও। শেষ বিচারে মানুষের ভালোবাসা, পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ায় তো আসল পুরস্কার। সেসব তাঁরা পেয়েছেন। আগে যাঁরা নোবেল পেয়েছেন, তাঁদের কতজনই তো কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছেন!

ধারণা করি, মুরাকামি-কিংদের সাহিত্যে বেঁচে থাকবে। তবে এটা ঠিক, হরর, থ্রিলার, শিশু সাহিত্যকে এখনো সিরিয়াস সাহিত্য বলতে নারাজ নোবেল কমিটি। ‘জীবনবাদী’, ‘দার্শনিক সাহিত্য’ ধারা থেকে নোবেল যে বেরোতে পারেনি, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। অথচ অস্কারে দেখুন, তারা ‘শেপ অব ওয়াটার’কে পুরস্কার দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, সিরিয়াস সিরিয়াস বিষয়ের বাইরেও জীবনের অনেক কিছু থাকে।

কে জানে এবার কোন কবি-সাহিত্যিক নোবেল পান! যাঁর হাতেই নোবেলের শিরোপা উঠুক না কেন, বাঙালি অনুবাদকেরা কী-বোর্ড হাতে প্রস্তুত তো!

Ad 300x250

সম্পর্কিত