leadT1ad

জেন গুডঅল: শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে জীবন কাটালেন যিনি

স্ট্রিম গ্রাফিক

জেন গুডঅল নামটি কানে এলেই যে ছবিটি চোখে সামনে ভেসে ওঠে, তা একজন স্বর্ণকেশী তরুণীর। আলগোছে বসে সামনের দিকে একটি হাত আলতো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর মুখমণ্ডল খুব একটা দৃশ্যমান নয়। তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ছোঁয়ার জন্য একটি আবেগী হাত ইতস্তত বাড়িয়ে দিয়েছে অপরপ্রান্ত থেকে এক শিশু শিম্পাঞ্জি। তার মুখে যাবতীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে সব কিছু ছাপিয়ে শিম্পাঞ্জি শাবকের কৌতূহল আর সেই তরুণীর প্রতি তার বিশ্বাস ফুটে ওঠে চোখের তারা দুটোয়। এটিই সম্ভবত মানুষ আর বুনো প্রাণীর সহাবস্থানের সবচেয়ে বিখ্যাত আলোকচিত্র।

জেন গুডঅলের বিখ্যাত আলোকচিত্র। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে নেওয়া
জেন গুডঅলের বিখ্যাত আলোকচিত্র। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে নেওয়া

সেই সঙ্গে জানা যায়, সারা বিশ্বে বর্তমানে যতজন প্রাইমেটোলজিস্ট (যাঁরা প্রাইমেটদের নিয়ে কাজ করেন) আছেন, তাঁদের শতকরা ৯৫ জনই এ বিষয়ে গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেন গুডঅলের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে। গত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে শিম্পাঞ্জীদের নিয়ে গবেষণা এবং তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে গেছেন এই মহীয়সী। তাঁর যুগান্তকারী গবেষণার পথচলা থেমে গেছে। বয়সজনিত কারণে জেন গুডঅল মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, গুডঅল বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া সফর করছিলেন। সেখানেই তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

গুডঅলের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এক শোকবার্তায় গুডঅলকে ‘প্রিয় বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস।

গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস সদরদপ্তরে জেন গুডঅলের হাতে  ছাত্র-জনতার বিপ্লব চলাকালে এবং এরপরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রের ছবি-সংবলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীর্ষক আর্টবুক উপহার দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান
গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস সদরদপ্তরে জেন গুডঅলের হাতে ছাত্র-জনতার বিপ্লব চলাকালে এবং এরপরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রের ছবি-সংবলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীর্ষক আর্টবুক উপহার দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান

কী করে বিখ্যাত হয়েছিলেন জেন গুডঅল

বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও আদিম মানুষ বিশেষজ্ঞ ড. লুই লিকি ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিন তরুণীকে আমন্ত্রণ জানালেন তিন প্রজাতির এপ নিয়ে গবেষণার জন্য। যাঁদের আদুরে নাম ছিল লুকিপ অ্যাঞ্জেলস (জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক চার্লিস অ্যঞ্জেলসের নামে)। এই তিনজনের মধ্যে ডিয়ান ফসিতো বিখ্যাত হয়ে আছেন পার্বত্য গরিলাদের নিয়ে কাজের জন্য। বিরুতে গালডিকাস হয়ে উঠলেন বিশ্বের সেরা ওরাং ওটান বিশেষজ্ঞ। আর জেন গুডঅল করেন শিম্পাঞ্জিদের পর্যবেক্ষণ।

১৯৭৭ সালে গোমবে ন্যাশনাল পার্কে শিম্পাঞ্জির সঙ্গে তরুণী জেন গুডঅল। ছবি: ইউনেস্কোর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া
১৯৭৭ সালে গোমবে ন্যাশনাল পার্কে শিম্পাঞ্জির সঙ্গে তরুণী জেন গুডঅল। ছবি: ইউনেস্কোর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

কিন্তু জেনের সঙ্গে শিম্পাঞ্জির সখ্যের ইতিহাস আরও অনেক অনেক পুরোনো। দুই বছর বয়সে খেলার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন জুবিলিকে (শিম্পাঞ্জি পুতুল)। আর সেই খেলনাটির জীবিত আত্মীয়দের সঙ্গেই পরে কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন।

জীবনের শেষ সময়ে এসেও এই উদ্দীপ্ত মানুষটি সুযোগ পেলেই চলে যেতেন আফ্রিকার গহীন অরণ্যে। যেখানে মুক্তভাবে বিচরণ করে তাঁর ‘সুহৃদরা’। যে অরণ্যে প্রথমবারের মতো শিম্পাঞ্জিদের আচরণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি গিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে, তাঞ্জানিয়ার গোমবে ন্যাশনাল পার্কে ড. লিকির উৎসাহে।

শিম্পাঞ্জি নিয়ে গুডঅলের দেওয়া চমকপ্রদ কিছু তথ্য

এরপর থেকে জেন গুডঅল অভিভূত হয়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে একের পর এক অজানা ও অবিশ্বাস্য তথ্য জানিয়ে গেছেন। বলা ভালো, এই শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গে মানুষের ডিএনের মিল ৯৯ শতাংশ।

জেন গুডঅলের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ
জেন গুডঅলের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ

যদিও জেনের কিছু গবেষণা পদ্ধতি, বিশেষ করে শিম্পাঞ্জিদের খাবার দেওয়া, তাদের নাম্বার না দিয়ে নাম ধরে রেকর্ড লিপিবদ্ধ করা ইত্যাদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক মনে না করা হলেও তিনিই পরের ৫০ বছরে করেছেন আসল অসাধ্য সাধন, নিচে সাল অনুযায়ী জেন গুডঅলের কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যা জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে:

১৯৬০: প্রথমবারের মতো জানা যায় শিম্পাঞ্জিরা মাংস ভক্ষণ করে। বন্য প্রাণী যে যন্ত্র ব্যবহার করতে পারে, তার প্রথম প্রমাণ মেলে উঁইপোকা ধরার জন্য শিম্পাঞ্জিদের লম্বা ঘাস ব্যবহার করতে দেখে।

১৯৬৪: শিম্পাঞ্জিরা যে পরিকল্পনা করতে এবং তা বাস্তবায়নে সক্ষম, তার প্রমাণ মেলে। তারা মানুষের তৈরি বস্তুও ব্যবহার করে সার্থকতার সঙ্গে।

১৯৬৬: শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও পোলিও রোগ ধরা পড়ে।

১৯৭০: এক বিশাল জলপ্রপাত দেখে কিছু শিম্পাঞ্জির অভূতপূর্ব অনুভূতি বহিঃপ্রকাশ এবং উল্লাস নৃত্য দেখে জেন ধারণা দেন, হয়তো এমনভাবেই আদি মানুষের মনে ঈশ্বর ও ধর্মের ধারণার জন্ম হয়েছে; জেনের মতে, কোনো সময় তারা জলপ্রপাত, নদী, গাছ, প্রস্তরখণ্ড, বিশাল প্রাণি ইত্যাদি দেখে যে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিল, সেখান থেকেই বিশ্বাসের শুরু।

১৯৭৪: শিম্পাঞ্জিরা যে মাঝে মাঝে ভয়াবহ হিংস্র লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ।

১৯৭৫: শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও পাওয়া গেলে স্বজাতি ভক্ষণের অভ্যাস।

আবার দেখা গেল তারা একে অপরকে সহযোগিতা করে নানা ক্ষেত্রে।

সেই সঙ্গে একই বছর দেখা গেল, নারী শিম্পাঞ্জিরা অনেক ক্ষেত্রেই গোত্রত্যাগ করে অন্য দলে চলে যায়। ফলে অনেক সময়ই বেঁধে যায় লড়াই!

১৯৮৭: এতিম শিম্পাঞ্জি শিশুকে দত্তক নেওয়ার নিদর্শন পাওয়া গেল; তাও এক পুরুষ শিম্পাঞ্জির মাধ্যমে।

১৯৯৪: এক শিম্পাঞ্জি গোত্র যে অন্য গোত্রকে তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান দান করে থাকে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

সেই সঙ্গে প্রমাণ মেলে, মাঝেমধ্য শিম্পাঞ্জিরা জুটি বেঁধে এক পরিবারের দম্পতির মতো গোত্রের বাইরে অবস্থান করে এবং সন্তানের জন্ম দেয়।

১৯৯৫: প্রথম শিম্পাঞ্জি জমজের জন্ম ।

এছাড়া, দেখা যায় ওঝা হিসেবেও শিম্পাঞ্জিরা উচ্চমানের, কিছু বিশেষ ঔষধি গাছের পাতা তারা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হলে গিলে ফেলে। কিন্তু চিবায় না। কারণ, চিবানো পাতাটি পাকস্থলির অভ্যন্তরে ক্ষতিকারক পদার্থ নিঃসরণ করতে পারে। তবে গিলে ফেললে পাতা থেকে কিছু উপাদান সামান্য পরিমাণে বের হয়ে তাদের দেহের নানা পরজীবী প্রাণীদের মেরে ফেলতে সাহায্য করে।

এভাবে তালিকাটি অনেক দীর্ঘ করা সম্ভব। জেন গুডঅল লিখে গেছেন একের পর এক মূল্যবান গবেষণাপত্র আর অসাধারণ সব বই।

জেন গুডঅলের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ
জেন গুডঅলের লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ

সারা বিশ্ব চষে মানুষকে ধারণা দিয়েছেন বুনোপ্রাণির সংরক্ষণ, শিম্পাঞ্জিদের অধিকার ও পরিবেশ নিয়ে। হয়েছেন জাতিসংঘের শান্তিদূত। প্রতিষ্ঠা করেছেন জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট।

আজ পর্যন্ত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় জেনের গবেষণা ও জীবন নিয়ে যতবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, আর কাউকে নিয়ে এমনটা হয়নি। একই সঙ্গে পত্রিকাটির প্রচ্ছদেও একাধিকবার এসেছেন তিনি।

ঢাকায় জেন গুডঅল

বছর কয়েক আগে (সম্ভবত ২০০৫ সালে) জেন গুডঅল ঢাকা সফর করেন। সেখানে বক্তৃতার এক ফাঁকে সবাইকে উদ্বেলিত করে তাঁর বহুল পরিচিত ব্যাগ থেকে দুটি বস্ত বের করেন তিনি। বলেন, এই দুটি জিনিস সবসময়ই আমার সঙ্গে থাকে, বিশ্বের যেখানেই আমি যাই, সবাইকে এদের দেখানোর চেষ্টা করি। সেদিন যে দুটি বস্তু তিনি সবাইকে দেখিয়েছিলেন, তার একটি হলো পারমাণবিক বোমায় দগ্ধ হিরোশিমা নগরীর একটি গাছের পাতা। এই পাতা দেখিয়ে জেন বলেছিলেন, প্রকৃতি অসীম শক্তি এবং ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার কথা বলা হলো এই পাতা প্রদর্শনের মাধ্যমে।

আর দ্বিতীয় যে বস্তটি জেন সবাইকে দেখিয়েছিলেন, সেটি হলো বাংলাদেশের একটি পয়সা (সিকি বা আধুলি)। এটি দেখিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অন্যতম হলো গ্রামবাংলার নারীরা। বলতে গেলে তাঁদের জীবনে কোনো আশা-স্বপ্ন ছিল না। তাঁরা এই খুঁচরো পয়সা তিল তিল করে সঞ্চয় করেন, একসঙ্গে কাজ করে নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়েছেন! আমি সারা বিশ্বকে এই পয়সা দেখিয়ে বলি, গ্রামবাংলার নারীরা সারা বিশ্বের কাছে উদাহরণ ।

লন্ডনের জন্ম নেওয়া কিন্তু আফ্রিকায় জীবনের অধিকাংশ সময় কাটানো জেন গুডঅলকে ঈশ্বর বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করা হলে স্মিত হেসে তিনি উত্তর দেন, ‘আমি জানি না ঈশ্বর কী বা কে। তবে প্রতিবার নিসর্গে থাকার সময় আমি এক ধরনের স্পিরিচুয়াল অনুভূতি টের পাই, যেটা আমার বা যে কারো চেয়ে অনেক বড় ও শক্তিশালী। আমি শুধু এই অনুভূতি অনুভব করতে পারি এবং এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।’

গতকাল বৃহস্পতিবার ১ অক্টোবর বয়সজনিত কারণে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন জেন গুডঅল। তবে আমাদের প্রিয় পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তিনি রেখে গেছেন প্রকৃতি সংরক্ষণের স্বপ্ন ও বন্যপ্রাণি নিয়ে জানার আগ্রহ, রেখে গেছেন নিসর্গকে ভালোবাসার শক্তি। ৯১ বছরে প্রয়াত হওয়া এই মহীয়সীকে শ্রদ্ধা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত