ভাষা সংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিক আর নেই। আজ বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কেমন ছিল তাঁর জীবনের শেষদিনগুলো?
ইসমাইল সাদী
আমার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের শেষ দিনগুলো কেমন কেটেছে? এককথায় উত্তর হবে, অসহনীয় কিংবা দুর্বিষহ। নানা দিক থেকে এর বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত, তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা কেবল একজন জীবনসঙ্গীর অভাবে নয়। এই নিঃসঙ্গতা যেকোনো পর্যায়ের স্বজনের অভাবে।
আপনজনের তীব্র অভাবে মানুষ কতটা অসহায় জীবন যাপন করতে পারেন, আহমদ রফিকের জীবনের শেষ সময়গুলো না দেখলে তা অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। এর জন্য তাঁর কোনো হাহাকার ছিল না। তিনি কখনো বলতেন না, কেউ আসুক, বসুক , কথা বলুক। এটা নিতান্তই আমার অনুধাবন। নিয়মিত খোঁজখবর রাখার ফলেই আমার এই অনুধাবন।
দ্বিতীয়ত, তাঁর ভেতরে অনর্গল কথা বলার তেষ্টা ছিল, কথা শোনার আগ্রহ ছিল। আপ্যায়ন করার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন তিনি। এই যে কথা বলা ও শোনার তেষ্টা ছিল, সেটা কেবল তাঁর কাছে গেলেই অনুধাবন করা সম্ভব, অন্যথা নয়।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করতাম, তিনি খুব কম সময়ই রক্ত-সম্পর্কীয় মানুষদের নিয়ে কথা বলেছেন। নিঃসন্তান আহমদ রফিকের কি আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে কোনো অপ্রকাশ্য অভিমান ছিল? তাঁর একধরনের অভিমান ছিল পিতার প্রতি। কোনো এক ঝড়ের রাতে নৌকাডুবিতে সলিল সমাধি হয়েছিল তাঁর। তাঁকে নিয়ে তাঁর কোনো স্মৃতি নেই। অভিমান ছিল এই কারণে যে, পিতা দায়িত্বশীল হলে জীবেনর এমন অপচয় তিনি করতেন না। আর কারও বলেননি তেমন। তিনি বরং বলতেন, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পর্যায়ে নানা সাংঠনিক তৎপরতায় যুক্ত হওয়া বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের কথা। বিশেষত বলতেন রবীন্দ্র চর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং এর সাংগঠিনক নানা উদ্যোগ-আয়োজনের কথা। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং এর নানা কার্যক্রমে তিনি সম্ভবত অপার আনন্দ লাভ করেছিলেন। সুতরাং তাঁর এই আনন্দযাপনকালের বন্ধুদের (আদতে প্রায় সবাই ছিলেন স্নেহধন্য) কথা বলতে গেলে তাঁর চোখ চকচক করে উঠত। তাঁদের কাছে তাঁর কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তবে তিনি চাইতেন, প্রতিনিয়ত না হলেও কালেভদ্রে তাঁরা তাঁর খোঁজ নিন, সশরীরে অথবা টেলিফোনে। তাঁদের অনেকেই আজ খ্যাতিমান অধ্যাপক, গবেষক, লেখক; কেউ কেউ উপাচার্য হয়েছিলেন, কেউ-বা হয়েছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক।
একবার আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁদের কারও নাম উল্লেখ করেছিলেন। পরে অবশ্য ফোন করে নামগুলো মুছে ফেলতে বলেন; তাঁরা কষ্ট পেতে পারেন ভেবে। তাঁদের সম্পর্কে বলেছিলেন, কতটা নিবেদিত ছিলেন তাঁরা কাজে ও আড্ডায়। সময়ের নিরিখে কতটা অমিতব্যয়ী ছিলেন ‘রফিক ভাইয়ের’ সান্নিধ্যপ্রাপ্তির। কিন্তু তাঁরা শেষ জীবনে বছরে তো নয়ই, যুগ পেরিয়ে গেলেও ফোনে বা অন্য কোনোভাবে তাঁর খোঁজ নেননি। যদি কেউ খোঁজ নিতেন, যেতেন তাঁর কাছে, মুহূর্তেই ভুলে যেতেন সমস্ত অনুযোগ। এই ভালো লাগার অনুভূতি তিনি সর্বদা চাইতেন।
ব্যতিক্রমও কেউ কেউ ছিলেন। আমার জানামতে, রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের সেই সময়কার সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে ভীষ্মদেব চৌধুরী নিয়মিত তাঁর খোঁজ নিয়েছেন। যোগাযোগ রেখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ও সৈয়দ আজিজুল হক। কত যে উচ্ছ্বসিত হতেন তাঁদের দেখে, সেটা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে!
২০১১ সালে কবি আহসান হাবীবকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই ভাষাসংগ্রামীর সান্নিধ্য লাভ করি। আমার গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক ভীষ্মদেব চৌধুরীর পরামর্শে এই কিংবদন্তির কাছে যাই। কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে একধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল আহমদ রফিকের। সেই সময় দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এরপর থেকে এই সম্পর্কে কখনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। নিয়মিত খোঁজখবরের সুবাদেই জানি নিঃসঙ্গতা এবং যত্নহীনতা কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তাঁর শেষ জীবনে। সপ্তাহ না যেতে তাঁর ফোন পেতাম ‘জরুরি’ কথা আছে বলে। আদতে তেমন কিছু না। সাধারণ আলাপ দিয়ে শেষ হতো মূলত তাঁর কথা বলার আকুতি। তাঁর দুই সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী কালাম এবং ‘জাহানারা মা’ (এই নামেই ডাকতেন তিনি) বলতেন, ‘আপনারা আইলে স্যার খুব খুশি হয়। যেদিন আসেন, সেদিন খুব ভালা থাকে। সারাক্ষণ কথা বলতে চায়। আমরা এতক্ষণ কী কথা কমু তার লগে। তার সব কথা কি আমরা বুঝি?’
২০২১ সালে এক রাতে একা ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে পড়ে যান। ভেঙে যায় তাঁর ঊরুসন্ধির হাড়। ভরা কোভিডকাল তখন। গভীর রাতে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাই আমার মতো তাঁর দুই অনুরাগী সাইফুজ্জামান শাকন ও রাসেল সরদার। পরের দিন অস্ত্রোপচারের কক্ষে নেওয়া হবে। আনুষ্ঠানিকতার জন্য সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করা নিয়ম। আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনারা রোগীর কে হন?’ বলি, ‘আমরা কেউ নই, কিন্তু তাঁর আমরা ছাড়া কেউ নেই।’
অস্ত্রোপচারের পর অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেবাযত্ন করেছেন আরেক অনুরাগী ইসরাত নাদিয়া। সেই সময় উপলব্ধি করি, পৃথিবীতে স্বজনের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। আমাদের সমাজে স্বজন ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন। সেই ‘কঠিনেরে প্রতিনিয়ত ভালোবেসে’ গেছেন একজন ভাষাসংগ্রামী, একজন নব্বই-ঊর্ধ্ব লেখক। আদৌ কি নেই কেউ তাঁর এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে? শুনেছি, আছে বেশ কজন স্বজন। হয়তো তেমন কোনো স্বার্থ নেই বলে তাঁর কাছে তাঁরা ‘ঘেষেন’ না।
দুই.
আহমদ রফিকের দুই চোখেই ছানি পড়েছিল। তবু চোখের চিকিৎসা করাতে সব সময় ভয় ছিল তাঁর। আশঙ্কা করতেন, ছানি অপারেশন করাতে গেলে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। যুক্তি ছিল, চোখ দুটো কোনো রকম সচল আছে বলেই তিনি লিখতে পারছেন, কিন্তু ক্ষতি হলে তো তাঁর লেখালেখি বন্ধ হয়ে যাবে, উপার্জনও বন্ধ হয়ে পড়বে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ছানি অপারেশনের ফলে তাঁর দুটি চোখ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর আক্রান্ত হয় ক্ষয়রোগে। ফলে ২০২২ সালের পর থেকে আর তেমন একটা লিখতে পারেননি। এ-সময় বয়সের ভারে নানা রোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে ছিল অনীহা। এর প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক। দ্বিতীয় কারণ ছিল স্বজনের অভাব। আমরা যাঁরা তাঁর শুভানুধ্যায়ী, তাঁদের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত যেতেন চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু সাধ্যের প্রায় সবটুকু করেও আজ মনে প্রশ্ন জাগে, সামাজিকতা ও সংসারধর্মকে উপেক্ষা করে আমরা কি আদৌ পারতাম তাঁর প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতে? তাহলে কি আরেকটু সুবিচার করা হতো তাঁর প্রতি? আরও মনে হয়, রাষ্ট্রের কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই এই ধরনের কৃতবিদ্যা মানুষদের প্রতি? কোনো ব্যবস্থা কেন থাকবে না, এত বড় পৃথিবীতে? যে রাষ্ট্রে অপচয় করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার, পাচার হয় কোটি কোটি টাকা?
তিন.
মাস ছয়েক আগেও তিনি বেশ সুস্থ ছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন গত জুলাই মাসে। বাসায় তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। কালাম ভাইয়ের মারফত জেনে আমি যোগাযোগ করি একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার সাথে, যিনি আহমদ রফিককে চাচা ডাকেন; তাঁর খোঁজখবরও রাখেন। তিনি মগবাজারের কমিউনিটি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থার করেন। দিন-দশেক পর হাসপাতাল তাঁকে ছুটি দেয় বটে; কিন্তু অসুস্থতা থেকে খুব একটা মুক্তি ঘটে না।
মাসখানেক পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি শরণাপন্ন হই প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের। তাঁর উদ্যোগে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহমদ রফিকের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। সেখানে সুচিকৎসা পেলেও অবস্থার সামান্যই উন্নতি হয়েছিল। কারণ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা। তাদের ছাড়পত্রের পর আমরা তাঁকে নিয়ে যাই হেল্থ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে। সেখানে ১৩ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর চিকিৎসাব্যয়ের ভার গ্রহণের আশ্বাস দেন। এখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় বারডেম হাসপাতালে।
শেষে বলতে চাই, আমাদের সমাজে ব্যক্তির সৃষ্টিকর্মের চেয়ে ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর স্মৃতি, তাঁর সাথে তোলা ছবি ইত্যাদি নিয়ে চর্চা এবং তার ভিত্তিতে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে উচ্চাসনে নিয়ে নিজেকে মহিমান্বিত করার দৃষ্টিকটু প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ, গভীরতা কখনো সমাজের নানা অনালোকিত বিষয়কে যখন সামনে আনে, তখন সেটা অবশ্যই নানামাত্রিক গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু যে মানুষগুলো একসময় তাঁর সান্নিধ্য পেতে, একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেতে, একটা বইয়ের আলোচনা লেখাতে গিয়ে বসে থাকতেন, সেই মানুষগুলো আজ যখন প্রতিষ্ঠিত, তখন তাঁরা তাঁকে প্রকৃত অর্থে ব্রাত্য জ্ঞান করে যান দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে ‘তব ফেসবুকে যুগল বা সম্মিলিত ছবি পোস্ট’ করা ছাড়া।
এভাবে আহমদ রফিকের প্রতিও একধরনের অবজ্ঞাও দেখানো হয়েছে বৈকি! এই কারণে ব্যক্তি সম্পর্কের আড়ালে তাঁর সৃষ্টি অবমূল্যায়িত হয়েছে, হচ্ছে। অথচ আহমদ রফিক যদি কালের স্রোতে স্মরিত হন, তবে তা হবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্যই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
আমার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের শেষ দিনগুলো কেমন কেটেছে? এককথায় উত্তর হবে, অসহনীয় কিংবা দুর্বিষহ। নানা দিক থেকে এর বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত, তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা কেবল একজন জীবনসঙ্গীর অভাবে নয়। এই নিঃসঙ্গতা যেকোনো পর্যায়ের স্বজনের অভাবে।
আপনজনের তীব্র অভাবে মানুষ কতটা অসহায় জীবন যাপন করতে পারেন, আহমদ রফিকের জীবনের শেষ সময়গুলো না দেখলে তা অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। এর জন্য তাঁর কোনো হাহাকার ছিল না। তিনি কখনো বলতেন না, কেউ আসুক, বসুক , কথা বলুক। এটা নিতান্তই আমার অনুধাবন। নিয়মিত খোঁজখবর রাখার ফলেই আমার এই অনুধাবন।
দ্বিতীয়ত, তাঁর ভেতরে অনর্গল কথা বলার তেষ্টা ছিল, কথা শোনার আগ্রহ ছিল। আপ্যায়ন করার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন তিনি। এই যে কথা বলা ও শোনার তেষ্টা ছিল, সেটা কেবল তাঁর কাছে গেলেই অনুধাবন করা সম্ভব, অন্যথা নয়।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করতাম, তিনি খুব কম সময়ই রক্ত-সম্পর্কীয় মানুষদের নিয়ে কথা বলেছেন। নিঃসন্তান আহমদ রফিকের কি আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে কোনো অপ্রকাশ্য অভিমান ছিল? তাঁর একধরনের অভিমান ছিল পিতার প্রতি। কোনো এক ঝড়ের রাতে নৌকাডুবিতে সলিল সমাধি হয়েছিল তাঁর। তাঁকে নিয়ে তাঁর কোনো স্মৃতি নেই। অভিমান ছিল এই কারণে যে, পিতা দায়িত্বশীল হলে জীবেনর এমন অপচয় তিনি করতেন না। আর কারও বলেননি তেমন। তিনি বরং বলতেন, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পর্যায়ে নানা সাংঠনিক তৎপরতায় যুক্ত হওয়া বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের কথা। বিশেষত বলতেন রবীন্দ্র চর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং এর সাংগঠিনক নানা উদ্যোগ-আয়োজনের কথা। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং এর নানা কার্যক্রমে তিনি সম্ভবত অপার আনন্দ লাভ করেছিলেন। সুতরাং তাঁর এই আনন্দযাপনকালের বন্ধুদের (আদতে প্রায় সবাই ছিলেন স্নেহধন্য) কথা বলতে গেলে তাঁর চোখ চকচক করে উঠত। তাঁদের কাছে তাঁর কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তবে তিনি চাইতেন, প্রতিনিয়ত না হলেও কালেভদ্রে তাঁরা তাঁর খোঁজ নিন, সশরীরে অথবা টেলিফোনে। তাঁদের অনেকেই আজ খ্যাতিমান অধ্যাপক, গবেষক, লেখক; কেউ কেউ উপাচার্য হয়েছিলেন, কেউ-বা হয়েছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক।
একবার আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাঁদের কারও নাম উল্লেখ করেছিলেন। পরে অবশ্য ফোন করে নামগুলো মুছে ফেলতে বলেন; তাঁরা কষ্ট পেতে পারেন ভেবে। তাঁদের সম্পর্কে বলেছিলেন, কতটা নিবেদিত ছিলেন তাঁরা কাজে ও আড্ডায়। সময়ের নিরিখে কতটা অমিতব্যয়ী ছিলেন ‘রফিক ভাইয়ের’ সান্নিধ্যপ্রাপ্তির। কিন্তু তাঁরা শেষ জীবনে বছরে তো নয়ই, যুগ পেরিয়ে গেলেও ফোনে বা অন্য কোনোভাবে তাঁর খোঁজ নেননি। যদি কেউ খোঁজ নিতেন, যেতেন তাঁর কাছে, মুহূর্তেই ভুলে যেতেন সমস্ত অনুযোগ। এই ভালো লাগার অনুভূতি তিনি সর্বদা চাইতেন।
ব্যতিক্রমও কেউ কেউ ছিলেন। আমার জানামতে, রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের সেই সময়কার সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে ভীষ্মদেব চৌধুরী নিয়মিত তাঁর খোঁজ নিয়েছেন। যোগাযোগ রেখেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ও সৈয়দ আজিজুল হক। কত যে উচ্ছ্বসিত হতেন তাঁদের দেখে, সেটা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে!
২০১১ সালে কবি আহসান হাবীবকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই ভাষাসংগ্রামীর সান্নিধ্য লাভ করি। আমার গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক ভীষ্মদেব চৌধুরীর পরামর্শে এই কিংবদন্তির কাছে যাই। কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে একধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল আহমদ রফিকের। সেই সময় দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এরপর থেকে এই সম্পর্কে কখনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। নিয়মিত খোঁজখবরের সুবাদেই জানি নিঃসঙ্গতা এবং যত্নহীনতা কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তাঁর শেষ জীবনে। সপ্তাহ না যেতে তাঁর ফোন পেতাম ‘জরুরি’ কথা আছে বলে। আদতে তেমন কিছু না। সাধারণ আলাপ দিয়ে শেষ হতো মূলত তাঁর কথা বলার আকুতি। তাঁর দুই সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী কালাম এবং ‘জাহানারা মা’ (এই নামেই ডাকতেন তিনি) বলতেন, ‘আপনারা আইলে স্যার খুব খুশি হয়। যেদিন আসেন, সেদিন খুব ভালা থাকে। সারাক্ষণ কথা বলতে চায়। আমরা এতক্ষণ কী কথা কমু তার লগে। তার সব কথা কি আমরা বুঝি?’
২০২১ সালে এক রাতে একা ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে পড়ে যান। ভেঙে যায় তাঁর ঊরুসন্ধির হাড়। ভরা কোভিডকাল তখন। গভীর রাতে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাই আমার মতো তাঁর দুই অনুরাগী সাইফুজ্জামান শাকন ও রাসেল সরদার। পরের দিন অস্ত্রোপচারের কক্ষে নেওয়া হবে। আনুষ্ঠানিকতার জন্য সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করা নিয়ম। আমাদের জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনারা রোগীর কে হন?’ বলি, ‘আমরা কেউ নই, কিন্তু তাঁর আমরা ছাড়া কেউ নেই।’
অস্ত্রোপচারের পর অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেবাযত্ন করেছেন আরেক অনুরাগী ইসরাত নাদিয়া। সেই সময় উপলব্ধি করি, পৃথিবীতে স্বজনের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। আমাদের সমাজে স্বজন ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন। সেই ‘কঠিনেরে প্রতিনিয়ত ভালোবেসে’ গেছেন একজন ভাষাসংগ্রামী, একজন নব্বই-ঊর্ধ্ব লেখক। আদৌ কি নেই কেউ তাঁর এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে? শুনেছি, আছে বেশ কজন স্বজন। হয়তো তেমন কোনো স্বার্থ নেই বলে তাঁর কাছে তাঁরা ‘ঘেষেন’ না।
দুই.
আহমদ রফিকের দুই চোখেই ছানি পড়েছিল। তবু চোখের চিকিৎসা করাতে সব সময় ভয় ছিল তাঁর। আশঙ্কা করতেন, ছানি অপারেশন করাতে গেলে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। যুক্তি ছিল, চোখ দুটো কোনো রকম সচল আছে বলেই তিনি লিখতে পারছেন, কিন্তু ক্ষতি হলে তো তাঁর লেখালেখি বন্ধ হয়ে যাবে, উপার্জনও বন্ধ হয়ে পড়বে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ছানি অপারেশনের ফলে তাঁর দুটি চোখ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর আক্রান্ত হয় ক্ষয়রোগে। ফলে ২০২২ সালের পর থেকে আর তেমন একটা লিখতে পারেননি। এ-সময় বয়সের ভারে নানা রোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে ছিল অনীহা। এর প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক। দ্বিতীয় কারণ ছিল স্বজনের অভাব। আমরা যাঁরা তাঁর শুভানুধ্যায়ী, তাঁদের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত যেতেন চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু সাধ্যের প্রায় সবটুকু করেও আজ মনে প্রশ্ন জাগে, সামাজিকতা ও সংসারধর্মকে উপেক্ষা করে আমরা কি আদৌ পারতাম তাঁর প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতে? তাহলে কি আরেকটু সুবিচার করা হতো তাঁর প্রতি? আরও মনে হয়, রাষ্ট্রের কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই এই ধরনের কৃতবিদ্যা মানুষদের প্রতি? কোনো ব্যবস্থা কেন থাকবে না, এত বড় পৃথিবীতে? যে রাষ্ট্রে অপচয় করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার, পাচার হয় কোটি কোটি টাকা?
তিন.
মাস ছয়েক আগেও তিনি বেশ সুস্থ ছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন গত জুলাই মাসে। বাসায় তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। কালাম ভাইয়ের মারফত জেনে আমি যোগাযোগ করি একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার সাথে, যিনি আহমদ রফিককে চাচা ডাকেন; তাঁর খোঁজখবরও রাখেন। তিনি মগবাজারের কমিউনিটি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থার করেন। দিন-দশেক পর হাসপাতাল তাঁকে ছুটি দেয় বটে; কিন্তু অসুস্থতা থেকে খুব একটা মুক্তি ঘটে না।
মাসখানেক পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি শরণাপন্ন হই প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের। তাঁর উদ্যোগে ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহমদ রফিকের চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। সেখানে সুচিকৎসা পেলেও অবস্থার সামান্যই উন্নতি হয়েছিল। কারণ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা। তাদের ছাড়পত্রের পর আমরা তাঁকে নিয়ে যাই হেল্থ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে। সেখানে ১৩ সেপ্টেম্বর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁর চিকিৎসাব্যয়ের ভার গ্রহণের আশ্বাস দেন। এখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় বারডেম হাসপাতালে।
শেষে বলতে চাই, আমাদের সমাজে ব্যক্তির সৃষ্টিকর্মের চেয়ে ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর স্মৃতি, তাঁর সাথে তোলা ছবি ইত্যাদি নিয়ে চর্চা এবং তার ভিত্তিতে নিজের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে উচ্চাসনে নিয়ে নিজেকে মহিমান্বিত করার দৃষ্টিকটু প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ, গভীরতা কখনো সমাজের নানা অনালোকিত বিষয়কে যখন সামনে আনে, তখন সেটা অবশ্যই নানামাত্রিক গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু যে মানুষগুলো একসময় তাঁর সান্নিধ্য পেতে, একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেতে, একটা বইয়ের আলোচনা লেখাতে গিয়ে বসে থাকতেন, সেই মানুষগুলো আজ যখন প্রতিষ্ঠিত, তখন তাঁরা তাঁকে প্রকৃত অর্থে ব্রাত্য জ্ঞান করে যান দিনের পর দিন। মাঝে মাঝে ‘তব ফেসবুকে যুগল বা সম্মিলিত ছবি পোস্ট’ করা ছাড়া।
এভাবে আহমদ রফিকের প্রতিও একধরনের অবজ্ঞাও দেখানো হয়েছে বৈকি! এই কারণে ব্যক্তি সম্পর্কের আড়ালে তাঁর সৃষ্টি অবমূল্যায়িত হয়েছে, হচ্ছে। অথচ আহমদ রফিক যদি কালের স্রোতে স্মরিত হন, তবে তা হবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্যই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
রাস্তায় নেমে যখন কেউ দীপ্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, তখন সেই গানের গহিনে তাকালে দেখা যায়, এক প্রবীণ পুরুণ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে আলো নেই, বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে গেছে পিঠ, কিন্তু কণ্ঠে ঠিকই ধ্বনিত হচ্ছে তেজদীপ্ত হুঙ্কার—‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। তিনি আহমদ রফিক, আমাদ
১ ঘণ্টা আগেসেই অর্থে আহমদ রফিক সামাজিকভাবে কোনো সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। তাতে খুব-একটা ক্ষতি যে হয়েছে, সেটি আমরা অন্তত মনেও করি না। জার্মান লেখক গেয়র্গ ক্রিস্টফ লিশটেনব্যর্গ বলতেন যে, ‘সম্মানজনক পদের তুলনায় ব্যক্তির সম্মানের গুণ অনেক বেশি মূল্যবান।’
২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের রংপুর বিভাগে অ্যানথ্রাক্সের (তড়কা রোগ) প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষভাবে পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। মানবদেহে নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।
৪ ঘণ্টা আগে