leadT1ad

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাংস্কৃতিক কর্মী

ভাষা সংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিক আর নেই। আজ বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কীভাবে একজন ভাষাসৈনিক থেকে সংস্কৃতীকর্মী হয়ে উঠেছিলেন আহমদ রফিক, তা ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।

সৌভিক রেজা
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ১৪
আহমদ রফিক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

কবি-প্রাবন্ধিক থেকে শুরু করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আহমদ রফিকের সুনাম রয়েছে। আবার তাঁর সমস্ত কর্মকে ছাড়িয়ে গিয়েছে মাত্র একটি পরিচয়ের কারণে—তিনি ছিলেন বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় সংগঠক। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নয়, বরং তিনি তাঁর কাজের সীমানাকে চারদিকে নানাভাবে প্রসারিত করেছিলেন। আহমদ রফিকের কাজের সব থেকে বড় নমুনা দেখতে পাব, যদি খেয়াল করি, তিনি আমাদের ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসকে দেশের সর্বজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন আজীবন। সেই ইতিহাসের বিবরণ থেকেই জানা যায়, ‘১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তের কারণে একুশের ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। পুলিশের গুলিতে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা ছাত্রসমাজসহ জনমনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করে শহরাঞ্চলে শিক্ষায়তনকেন্দ্রিক আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। এ পর্যায়ে শিক্ষিত শ্রেণির অধিকাংশ এবং শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষও তাতে যোগ দেন। আন্দোলন ছড়িয়ে যায় গ্রামের শিক্ষায়তন পর্যন্ত।’

২.

আবার এ-কথাও ঠিক যে ‘ভাষাসৈনিক’ পরিচয়ের ছায়ায় আহমদ রফিকের অন্যান্য পরিচয়গুলো ম্লান হয়ে পড়েছিল। লিখেছেন কবিতা। কবিতার পাশাপাশি মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। তাঁর আরেকটি বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন একজন রবীন্দ্র-গবেষক। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকৃতিসহ তাঁর বিবিধ কর্মের ওপর আলোচনা-পর্যালোচনা করেছিলেন আহমদ রফিক। সেই গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—‘ছোটগল্প: পদ্মাপর্বের রবীন্দ্র-গল্প’ ( ১৯৮৭), ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ’ (১৯৮৭), ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প’ (১৯৯৬), ‘রবীন্দ্রভুবনে পতিসর’ (১৯৯৮), ‘প্রসঙ্গ: বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ’ (২০০২), ‘রবীন্দ্রনাথ এই বাংলায়’ (২০১১), ‘নানা আলোয় রবীন্দ্রনাথ: ১ম খন্ড’ (২০১১), ‘নানা আলোয় রবীন্দ্রনাথ: ২য় খন্ড’ (২০১১), ‘রবীন্দ্রনাথ : দেশপ্রেম’ (২০১১), নির্বাচিত রবীন্দ্রনাথ (২০১৬) প্রভৃতি।

অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আহমদ রফিকের সামাজিক অঙ্গীকার তাঁকে সাংস্কৃতিক জগতে সর্বদাই কর্মব্যস্ত রেখেছে। ছাত্রজীবনে তিনি ভাষা আন্দোলনে জরুরি ভূমিকা পালন করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আহমদ রফিকের সামগ্রিক মূল্যায়নের ধরন অনেকটাই এ-রকম—‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ নানা দিক থেকে আলোচিত, যেমন তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে তেমনই সমাজ ও রাজনীতির চিন্তা নিয়ে। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক তাঁর সজীব অস্তিত্বই প্রমাণ করে, বুঝিয়ে দেয় কাল থেকে তাঁর কালান্তর যাত্রা। রবীন্দ্রসংগীতের কথা বাদ দিলেও দেখা যায়, রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে অনুশীলন ও গবেষণা, রবীন্দ্রনাটকের অভিনয় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এদেশের সংস্কৃতিমনস্ক মহলে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত রয়েছেন।’ আহমদ রফিকের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথের একক হাতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নানা কৌণিক মৌলিক সমৃদ্ধি, তাঁর রচনার শিল্পমূল্য এবং বিষয়গত দিকের সর্বজনীন ও মানবিক গুণ নিয়ে আধুনিকতায় সংশ্লিষ্টতা, তাঁর স্বচ্ছ জীবনদৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে যে ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে, তাতে রবীন্দ্রসাহিত্যের তথা রবীন্দ্রনাথের ক্ল্যাসিক মর্যাদা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থাকে না।’ সর্বোপরি আহমদ রফিকের মনে হয়েছে যে, রবীন্দ্র-সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর অবদান এসবই ‘পূর্ণতা পাবে এদেশে যথার্থ আধুনিক সমাজ গড়ে ওঠার পর। তখন জনস্তরে প্রয়োজনের সূত্রটি অপসারিত হওয়ার পরও রবীন্দ্র-সংস্কৃতি তার সার্বিক গুণগ্রাম নিয়ে সর্ব-বাংলাদেশি সমাজে প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে।’

৩.

আমরা আগেই বলেছি, আহমদ রফিক অনিয়মিতভাবে হলেও কাব্যচর্চা করেছেন। পরবর্তী সময়ে কাব্যচর্চার সেই শুকনো ধারাটাকে তিনি কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে খানিকটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কাব্যবিষয়ক তাঁর প্রবন্ধ-সংকলনের মধ্যে প্রথমেই ‘কবিতা আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা’ (২০০১) গ্রন্থটির কথা বলতেই হয়। এই বইটিতে তিনি কবিতার সৃষ্টি থেকে সংজ্ঞা, তাঁর আধুনিকতার ইতিহাস, বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার স্বরূপ, বাংলাদেশের কবিতার বাঁকফেরা, এদেশের আধুনিক কবিতার ভবিষ্যৎ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আহমদ রফিক তাঁর আলোচনার উপসংহার টেনেছেন এইভাবে—‘এ কালের আধুনিক কবিকে এ সত্য অনুধাবন করতে হবে: ব্যক্তি ও সমষ্টিকে অবশ্যই মেলাতে হবে, যেমন মেলাতে হবে মন ও মননকে, সেই সঙ্গে মেলাতে হবে নগর-গ্রামের বিচ্ছিন্নতা। সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ এদিক থেকে ভূমিকা রাখে বলেই সে সম্পর্কে সচেতনতা ও স্বচ্ছদৃষ্টি কবির জন্য অভিপ্রেত। অন্তত এটুকু দায় কবির জন্য অপরিহার্য। এর জন্য কবিকে রাজনৈতিক কর্মী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।’

বাংলাদেশের প্রগতিশীল বামধারা রাজনীতির প্রতি আহমদ রফিকের সহানূভূতি ও সমর্থন ছিল। তাঁর লেখালেখির মধ্যেও সেই ধারার প্রতি লেখকের মনোভাব গোপন থাকেনি।

তিনি তাঁর এ-বক্তব্যের পাশাপাশি এটিও দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন—‘‘সৃষ্টির বিষের বিন্দু” মুখে নিয়েও যেমন জীবনানন্দ “সূর্যে সূর্যে চলার” স্বপ্ন দেখেছিলেন, তেমন কিছু ভাবনা বর্তমান সামাজিক বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক কবির জন্যও অপরিহার্য মনে হয়। একুশ শতকের জন্য কবিতা তেমন সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে তৎপর হবে তেমনটাই কবিতা পাঠকের প্রত্যাশা। প্রত্যাশা আধুনিক-চেতনার কবির কাছ থেকে।’

৪.

বাংলাদেশের প্রগতিশীল বামধারা রাজনীতির প্রতি আহমদ রফিকের সহানূভূতি ও সমর্থন ছিল। তাঁর লেখালেখির মধ্যেও সেই ধারার প্রতি লেখকের মনোভাব গোপন থাকেনি। তাঁর ‘রুশ বিপ্লব: বাংলা সাহিত্যে প্রভাবে ও প্রতিফলন’ শীর্ষক প্রবন্ধে আত্মসমালোচনার সুরে আহমদ রফিক দৃঢ়ভাবেই জানিয়েছিলেন, ‘শেষ কথা হিসেবে একটি সত্য অনুধাবন না করলেই নয় যে, ১৯১৭-র শেষ দিক থেকে বঙ্গীয় সাহিত্যজগতে রুশ বিপ্লবের যে পরিমাণ ছায়াপাত দেখা গেল, রাজনীতিতে তার প্রভাব তুল্যমূল্য নয়।’ এ-সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য হচ্ছে—‘এ দায় সাহিত্যের নয়, বলাবাহুল্য দায় একান্তভাবেই রাজনীতির। সাহিত্য তার আপন আদর্শিক চেতনার প্রভাবে উজ্জ্বল। তার দায় সে মিটিয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে, নির্দ্বিধায় বলা যায়।’ এবং তাঁর সেই মন্তব্যের সূত্র ধরেই তিনি এ-সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ‘তিরিশের দশকের শেষার্ধ থেকে, বিশেষ করে চল্লিশের দশকে পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্য, বাংলাদেশি সাহিত্যের অংশবিশেষ এ ধারায় সমর্পিত।’

৫.

অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আহমদ রফিকের সামাজিক অঙ্গীকার তাঁকে সাংস্কৃতিক জগতে সর্বদাই কর্মব্যস্ত রেখেছে। ছাত্রজীবনে তিনি ভাষা আন্দোলনে জরুরি ভূমিকা পালন করেছেন। ওই আন্দোলনের কথা তাঁর বহু লেখায় পাওয়া যাবে। ভাষা আন্দোলনের ভেতরে ছিল প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা।’ এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই আহমদ রফিকের সার্বিক পরিচয় ও তাঁর অবদান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়।

সেই অর্থে আহমদ রফিক সামাজিকভাবে কোনো সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। তাতে খুব-একটা ক্ষতি যে হয়েছে, সেটি আমরা অন্তত মনেও করি না। জার্মান লেখক গেয়র্গ ক্রিস্টফ লিশটেনব্যর্গ বলতেন যে, ‘সম্মানজনক পদের তুলনায় ব্যক্তির সম্মানের গুণ অনেক বেশি মূল্যবান।’ আহমদ রফিকের বেলায়ও কথাটি চূড়ান্তভাবে সত্যি। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রইল।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত