মাহবুবুল আলম তারেক
দক্ষিণ এশিয়ায়— বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। এর পেছনে রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় মিশ্রণ, ঔপনিবেশিক শাসকদের কৌশল, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং উপনিবেশ-পরবর্তী আত্মপরিচয়ের সংকট। ১৯০৬ সালে অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত হয়, যা মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথে নেতৃত্ব দেয়। আর ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য’ নিয়ে।
এসব সংগঠন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার দাবিতে ধর্ম ও রাজনীতিকে একীভূত করে জনগনকে সংগঠিত করার পথে হাঁটে। তাদের উত্থানের পেছনে ছিল ঔপনিবেশিক বিভাজননীতি, সংস্কারবাদী আন্দোলন এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন। ঔপনিবেশিক আমলের আগে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বলে কিছু ছিল না। কিন্তু মুসলিমরা ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা হারানোর পর ১৯ ও ২০শ শতকে ঔপনিবেশিক দমন-পীড়নের মুখে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে, যা হয়ে ওঠে মুসলমানদের সম্প্রদায়গত ক্ষমতায়ন ও টিকে থাকার হাতিয়ার।
আগমন ও মিশ্রণের শেকড়: উপনিবেশ-পূর্ব ভিত্তি (অষ্টম-আঠার শ শতক)
ইসলামের প্রবেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ধীরে ধীরে ও নানা মাধ্যমে ঘটে। অষ্টম শতকে প্রথম আরব বণিকরা মালাবার উপকূলে আসেন। কালিকুটের মতো বন্দরনগরে তারা ছোট ছোট বহুজাতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। এসময় স্থানীয় রাজারা মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধ দখল করলে সেখানে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অমুসলিমদের জিম্মি হিসেবে সুরক্ষা দেওয়া হয়, যা মূলত স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ইসলাম গ্রহণকে উৎসাহিত করে।
১১৮৬-১১৯২ সালে মুহাম্মদ ঘুরির ভারত বিজয়ের পর তার প্রধান সেনাপতি কুতুব উদ্দিন আইবেকের হাতে ১২০৬ সালে দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর তুর্কি-আফগান শাসন ও সুফিবাদের মিশেলে হিন্দুস্তানে ইসলামকে আরও সম্প্রসারিত করেন তার উত্তরসূরি সুলতানরা। সুফি সংগীত (সামা) ও আধ্যাত্মিকতা ইসলামের ‘শরিয়তি’ রূপের কঠোর কাঠামোকে নরম করে বহু ভারতীয়দের মন জয় করে।
পরবর্তীতে মোগল সাম্রাজ্য (১৫২৬–১৮৫৭) ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান আরও শক্ত করে। আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ধর্মীয় সহনশীলতার প্রতীক ছিল। অন্যদিকে আওরঙ্গজেব ইসলামি আইনের সংকলন গ্রন্থ ফাতওয়ায়ে আলমগিরি প্রণয়ন করেন। মুসলমানরা তখনো জনসংখ্যার মাত্র ১৫–২০ শতাংশ হলেও শাসনব্যবস্থায় ইসলামই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চিশতিদের মতো সুফি তরিকা শাসক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলে। তারা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। তবে এই সময় থেকেই বিভাজনের বীজও বপন হয়। আঞ্চলিক রাজ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ তৈরি হয়। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (মৃত্যু ১৭৬২) আকবরের সমন্বয়বাদের সমালোচনা করে বিশুদ্ধ ইসলামে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তার ভাবধারা পরবর্তীতে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানে প্রভাব ফেলে। শাহ ওয়ালিউল্লাহর এই চিন্তাও মূলত ইউরোপীয় আগ্রাসনের মুখে ইসলামের অস্তিত্বের সংকটের আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেই আসে।
সেই সময়ে ইসলাম ছিল মূলত সংস্কৃতি ও প্রশাসনের অংশ। রাজনীতি ছিল অভিজাত শ্রেণির দখলে। পশ্চিমের মতো আধুনিক গণভিত্তিক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল তখন ছিল না। তবে ধর্ম ও শাসনের মেলবন্ধন ভবিষ্যতে ইসলামকে সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
ঔপনিবেশিক চাপ ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি: মুসলিম লীগের জন্ম
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের (১৭৫৭–১৯৪৭) দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মুসলিমরা ইসলামকে রাজনৈতিক আত্মপরিচয় তৈরিতে ব্যবহার শুরু করে। এর ফলে গড়ে ওঠে শুরুর দিকের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলদারত্বে মুসলিম অভিজাত সমাজ বিপর্যস্ত হয়। ব্রিটিশদের ভূমি সংস্কারের সুবিধা পায় হিন্দু মধ্যস্বত্বভোগীরা। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সৈনিকরা শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ‘জিহাদ’-এর আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে মুসলমানদের ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। হাজারো মুসলমানকে ফাঁসি দেওয়া হয়, বহু মুসলিম রাজ্য বিলুপ্ত হয়।
ব্রিটিশদের এই ‘মুসলমান-বিদ্বেষ’ থেকে জন্ম নেয় গভীর ক্ষোভ। ব্রিটিশনীতি মুসলমানদের আরও কোণঠাসা করে। উর্দু-ফার্সিকে সরকারি ভাষা থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর প্রবর্তন (১৯০৯ সালের মরলে–মিন্টো সংস্কার) ধর্মীয় বিভাজনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। এ ছিল ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ কৌশলের ফল।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় তৃতীয় আগা খান ও নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। এর জন্ম ছিল প্রতিরক্ষামূলক। কারণ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে (আইএনসি) মুসলমানরা দেখছিল হিন্দু সংস্কারবাদীদের দখলে থাকা একটি দল হিসেবে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এই গণতন্ত্রে মুসলমানদের প্রান্তিক করে রাখা হতো। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের নতুনভাবে সংগঠিত করে। তারা মনে করেছিল, পূর্ববাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য এই বিভাজন প্রয়োজন।
প্রথম দিকে মুসলিম লীগ ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিল। তারা সংরক্ষিত আসন ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা চেয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলটি রূপান্তরিত হয়। খেলাফত আন্দোলন (১৯১৯–১৯২৪) এবং গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ ধর্মীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
মুসলিম লীগের উত্থানের পেছনে ছিল কয়েকটি মূল কারণ— ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর মুসলিম জমিদার ও কারিগর শ্রেণির সামাজিক-অর্থনৈতিক পতন, স্বাধীন ভারতে ভবিষ্যতে ‘হিন্দু রাজ’-এর আশঙ্কা, দেওবন্দ (১৮৬৬) ও আলিগড় (১৮৭৫) আন্দোলনের পুনর্জাগরণ চেতনা। এই চেতনায় স্যার স্যৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় আগ্রহী হতে উৎসাহিত করেন, কিন্তু নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় অটুট রাখার কথাও বলেন।
উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে তারা পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি জানায়। তারা দাবি করে, যেখানে মুসলিম সংস্কৃতি নিরাপদ থাকবে। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ এই দাবির বাস্তব রূপ দেয়। তবে এর পরিণাম ছিল ভয়াবহ—সাম্প্রদায়িক (হিন্দু-মুসলিম) দাঙ্গায় প্রাণ হারায় ১০ লাখের বেশি মানুষ। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, ঔপনিবেশিক বিভাজননীতি কীভাবে ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছিল।
পুনর্জাগরণ ও অভিভাবকত্ববাদী চিন্তা: জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থী মতবাদ
মুসলিম লীগের জাতীয়তাবাদী ধারার পাশাপাশি আরেকটি ইসলামপন্থী মতাদর্শিক ধারা গড়ে ওঠে—জামায়াতে ইসলামী। ১৯৪১ সালে লাহোরে আবুল আলা মওদূদী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মওদূদী বিশ্ব ইসলামি চিন্তাবিদদের—রাশিদ রিদা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের হাসান আল-বান্নার—চিন্তা-ভাবনা দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদকে জাহেলিয়াত (ইসলামপূর্ব অন্ধকার যুগ) বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, ইসলাম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার লক্ষ্য শারিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম।
মওদূদী প্রথমে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি মনে করতেন, এটি মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করবে। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর তিনি পাকিস্তানকে ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর প্রভাবেই পাকিস্তানের সংবিধানে ইসলামি ধারার উপাদান সংযোজিত হয়।
জামায়াতে ইসলামীর উত্থানের মূলে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম নেতৃত্বের প্রতি হতাশা। মুসলিম লীগের ‘মুসলমানদের মাতৃভূমি’ বাস্তবে নৈতিক বা ধর্মীয় সমাজ গঠন করতে পারেনি। দুর্নীতি ও প্রাদেশিক বিভাজন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
এর আগেও বিভিন্ন পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন—যেমন ফরায়েজি আন্দোলন (১৮২০-র দশকে বঙ্গদেশে) ও আহলে-হাদিস আন্দোলন—ইসলামি সংস্কার ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতার মিশ্রণ ঘটিয়েছিল। একই সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও ওয়াহাবি প্রভাব মুসলিম সমাজে খেলাফত পুনরুদ্ধারের আহ্বান জাগায়।
ব্রিটিশ ভারতের নগরবাসী মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এই আদর্শ প্রচার করে। তারা মাদরাসা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করে ‘পাশ্চাত্য-মনস্ক’ এবং ‘ঔপনিবেশিক মনোগঠন’ এর মুসলমানদের মোকাবিলা করতে চেয়েছিল।
উত্তর-ঔপনিবেশিক গতিপথ: রাষ্ট্রগঠন, সামরিক অভ্যুত্থান ও বৈশ্বিক প্রভাব
ভারত ভাগের পর ইসলামপন্থী রাজনীতি ভেঙে যায় ও নতুন রূপ নেয়। পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী সামরিক শাসক জিয়াউল হকের (১৯৭৭–১৯৮৮) সঙ্গে জোট বাঁধে। তাঁর ইসলামিকরণ কর্মসূচি—যেমন হুদুদ অধ্যাদেশ ও ধর্মদ্রোহ আইন (ব্লাসফেমি ল)—যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সহায়তায় শক্তিশালী হয়। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় এসব তহবিল হাজার হাজার মাদরাসার বিস্তার ঘটায়, যা পরবর্তীতে ‘চরমপন্থা’র কেন্দ্র হয়ে ওঠে। জমিয়াতে উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই)-এর মতো দলগুলো কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে প্রভাব বাড়ায়।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। তবে ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ইসলাম ধীরে ধীরে রাজনীতিতে ফিরে আসে। ১৯৭৭ সালে সংবিধানে যোগ হয় ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস’। আর ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। এই সংগঠনগুলো পাকিস্তান ভাঙার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশেও সংগঠিত শক্তিতে পরিণত হয়।
স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক দল থাকলেও তারা দীর্ঘদিন কংগ্রেসের ছায়ায় ছিল। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান—বিশেষত বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি—তাদের নতুনভাবে সংগঠিত হতে বাধ্য করে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর মতো দলগুলো গড়ে ওঠে। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা মুসলিম রাজনৈতিক চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে।
রাজনীতিকরণের মূল কারণসমূহ: বিভিন্ন শক্তির মিলনবিন্দু
ইসলামপন্থী রাজনীতির বিকাশ বুঝতে কয়েকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—
ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার: ১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশদের দমনমূলক নীতি ও পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী মুসলমানদের একটি পৃথক রাজনৈতিক শ্রেণিতে পরিণত করে। এতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে ‘মুসলিম পরিচয়’ রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব পায়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপে যেন মুসলিমদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় বিলীন না হয়ে যায় সেজন্যই মুসলিমদের একটা বড় অংশ ইসলাপন্থার আশ্রয় নেয়।
পুনর্জাগরণ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা: খেলাফত আন্দোলনের মতো উদ্যোগ ধর্মকে প্রতিরোধের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। আবুল আলা মওদূদীর মতো চিন্তাবিদ সাম্রাজ্যবাদ-উত্তর যুগে ইসলামভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা দেন।
সামাজিক-অর্থনৈতিক অসন্তোষ: মুসলিম অভিজাতদের পতন, কৃষকদের শোষণ (যেমন বাংলার নীল বিদ্রোহ) ও হিন্দু-প্রধান রাজনৈতিক কাঠামোয় সংখ্যালঘু হওয়ার আশঙ্কা মুসলমানদের ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে।
বৈশ্বিক প্রভাব: অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, সৌদি ওয়াহাবিবাদ ও স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী আফগান জিহাদ ইসলামি রাজনীতিকে ত্বরান্বিত করে।
উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ব্যর্থতা: অভ্যুত্থান, দুর্নীতি ও সেক্যুলারিজমের বিশ্বাসঘাতকতা (যেমন পাকিস্তানে) ইসলামপন্থী দলগুলোর বিকল্প জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করে।
ঐতিহ্য ও প্রতিফলন
ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে আমূল পরিবর্তন করেছে। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক উত্তেজনা—যেমন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধকরণ (২০১৩, পুনর্বহাল ২০২৪) ও পাকিস্তানের ধর্মদ্রোহ আইন নিয়ে বিতর্ক—সবকিছুতেই তাদের প্রভাব স্পষ্ট।
এই দলগুলোর স্থায়িত্ব প্রমাণ করে, ইসলাম রাজনৈতিক অভিযোজনে সক্ষম একটি ধর্ম। একসময় এটি ছিল বহুত্ববাদ ও ন্যায়বিচারের সেতুবন্ধন; পরবর্তীতে এটি ঔপনিবেশিক বঞ্চনার প্রতিরোধে এক প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
উত্তর উপনিবেশিক সময়ে আজ যখন জলবায়ু সঙ্কট ও তরুণ জনগোষ্ঠীর বিস্তার নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, তখন এই ইসলামপন্থী দলগুলো হয় নতুনভাবে বিকশিত হবে, নয়তো ভেতর থেকে ভেঙে পড়বে। ইতিহাস দেখায়— যেখানে বৈষম্য ও অবিচার থাকে, সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও আবারও মাথা তোলে। বিশেষ করে ইসলামের ইনসাফ বা আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণা একে বারেবারে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলে।
এই ইতিহাস বোঝা শুধু একাডেমিক প্রয়াস নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর গণতন্ত্রগুলোকে বোঝারও চাবিকাঠি।
দক্ষিণ এশিয়ায়— বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। এর পেছনে রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মীয় মিশ্রণ, ঔপনিবেশিক শাসকদের কৌশল, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন এবং উপনিবেশ-পরবর্তী আত্মপরিচয়ের সংকট। ১৯০৬ সালে অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত হয়, যা মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথে নেতৃত্ব দেয়। আর ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য’ নিয়ে।
এসব সংগঠন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার দাবিতে ধর্ম ও রাজনীতিকে একীভূত করে জনগনকে সংগঠিত করার পথে হাঁটে। তাদের উত্থানের পেছনে ছিল ঔপনিবেশিক বিভাজননীতি, সংস্কারবাদী আন্দোলন এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন। ঔপনিবেশিক আমলের আগে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল বলে কিছু ছিল না। কিন্তু মুসলিমরা ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা হারানোর পর ১৯ ও ২০শ শতকে ঔপনিবেশিক দমন-পীড়নের মুখে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে, যা হয়ে ওঠে মুসলমানদের সম্প্রদায়গত ক্ষমতায়ন ও টিকে থাকার হাতিয়ার।
আগমন ও মিশ্রণের শেকড়: উপনিবেশ-পূর্ব ভিত্তি (অষ্টম-আঠার শ শতক)
ইসলামের প্রবেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ধীরে ধীরে ও নানা মাধ্যমে ঘটে। অষ্টম শতকে প্রথম আরব বণিকরা মালাবার উপকূলে আসেন। কালিকুটের মতো বন্দরনগরে তারা ছোট ছোট বহুজাতিক সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। এসময় স্থানীয় রাজারা মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধ দখল করলে সেখানে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অমুসলিমদের জিম্মি হিসেবে সুরক্ষা দেওয়া হয়, যা মূলত স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ইসলাম গ্রহণকে উৎসাহিত করে।
১১৮৬-১১৯২ সালে মুহাম্মদ ঘুরির ভারত বিজয়ের পর তার প্রধান সেনাপতি কুতুব উদ্দিন আইবেকের হাতে ১২০৬ সালে দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর তুর্কি-আফগান শাসন ও সুফিবাদের মিশেলে হিন্দুস্তানে ইসলামকে আরও সম্প্রসারিত করেন তার উত্তরসূরি সুলতানরা। সুফি সংগীত (সামা) ও আধ্যাত্মিকতা ইসলামের ‘শরিয়তি’ রূপের কঠোর কাঠামোকে নরম করে বহু ভারতীয়দের মন জয় করে।
পরবর্তীতে মোগল সাম্রাজ্য (১৫২৬–১৮৫৭) ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান আরও শক্ত করে। আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ধর্মীয় সহনশীলতার প্রতীক ছিল। অন্যদিকে আওরঙ্গজেব ইসলামি আইনের সংকলন গ্রন্থ ফাতওয়ায়ে আলমগিরি প্রণয়ন করেন। মুসলমানরা তখনো জনসংখ্যার মাত্র ১৫–২০ শতাংশ হলেও শাসনব্যবস্থায় ইসলামই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চিশতিদের মতো সুফি তরিকা শাসক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলে। তারা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। তবে এই সময় থেকেই বিভাজনের বীজও বপন হয়। আঞ্চলিক রাজ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ তৈরি হয়। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (মৃত্যু ১৭৬২) আকবরের সমন্বয়বাদের সমালোচনা করে বিশুদ্ধ ইসলামে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তার ভাবধারা পরবর্তীতে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানে প্রভাব ফেলে। শাহ ওয়ালিউল্লাহর এই চিন্তাও মূলত ইউরোপীয় আগ্রাসনের মুখে ইসলামের অস্তিত্বের সংকটের আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতেই আসে।
সেই সময়ে ইসলাম ছিল মূলত সংস্কৃতি ও প্রশাসনের অংশ। রাজনীতি ছিল অভিজাত শ্রেণির দখলে। পশ্চিমের মতো আধুনিক গণভিত্তিক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল তখন ছিল না। তবে ধর্ম ও শাসনের মেলবন্ধন ভবিষ্যতে ইসলামকে সার্বভৌমত্বের ভিত্তি হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
ঔপনিবেশিক চাপ ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি: মুসলিম লীগের জন্ম
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের (১৭৫৭–১৯৪৭) দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মুসলিমরা ইসলামকে রাজনৈতিক আত্মপরিচয় তৈরিতে ব্যবহার শুরু করে। এর ফলে গড়ে ওঠে শুরুর দিকের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলদারত্বে মুসলিম অভিজাত সমাজ বিপর্যস্ত হয়। ব্রিটিশদের ভূমি সংস্কারের সুবিধা পায় হিন্দু মধ্যস্বত্বভোগীরা। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সৈনিকরা শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ‘জিহাদ’-এর আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে মুসলমানদের ‘উগ্রপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। হাজারো মুসলমানকে ফাঁসি দেওয়া হয়, বহু মুসলিম রাজ্য বিলুপ্ত হয়।
ব্রিটিশদের এই ‘মুসলমান-বিদ্বেষ’ থেকে জন্ম নেয় গভীর ক্ষোভ। ব্রিটিশনীতি মুসলমানদের আরও কোণঠাসা করে। উর্দু-ফার্সিকে সরকারি ভাষা থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর প্রবর্তন (১৯০৯ সালের মরলে–মিন্টো সংস্কার) ধর্মীয় বিভাজনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। এ ছিল ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ কৌশলের ফল।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় তৃতীয় আগা খান ও নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। এর জন্ম ছিল প্রতিরক্ষামূলক। কারণ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে (আইএনসি) মুসলমানরা দেখছিল হিন্দু সংস্কারবাদীদের দখলে থাকা একটি দল হিসেবে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এই গণতন্ত্রে মুসলমানদের প্রান্তিক করে রাখা হতো। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের নতুনভাবে সংগঠিত করে। তারা মনে করেছিল, পূর্ববাংলার মুসলমানদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য এই বিভাজন প্রয়োজন।
প্রথম দিকে মুসলিম লীগ ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত ছিল। তারা সংরক্ষিত আসন ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা চেয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দলটি রূপান্তরিত হয়। খেলাফত আন্দোলন (১৯১৯–১৯২৪) এবং গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ ধর্মীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
মুসলিম লীগের উত্থানের পেছনে ছিল কয়েকটি মূল কারণ— ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর মুসলিম জমিদার ও কারিগর শ্রেণির সামাজিক-অর্থনৈতিক পতন, স্বাধীন ভারতে ভবিষ্যতে ‘হিন্দু রাজ’-এর আশঙ্কা, দেওবন্দ (১৮৬৬) ও আলিগড় (১৮৭৫) আন্দোলনের পুনর্জাগরণ চেতনা। এই চেতনায় স্যার স্যৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় আগ্রহী হতে উৎসাহিত করেন, কিন্তু নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় অটুট রাখার কথাও বলেন।
উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তোলে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে তারা পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি জানায়। তারা দাবি করে, যেখানে মুসলিম সংস্কৃতি নিরাপদ থাকবে। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ এই দাবির বাস্তব রূপ দেয়। তবে এর পরিণাম ছিল ভয়াবহ—সাম্প্রদায়িক (হিন্দু-মুসলিম) দাঙ্গায় প্রাণ হারায় ১০ লাখের বেশি মানুষ। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, ঔপনিবেশিক বিভাজননীতি কীভাবে ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেছিল।
পুনর্জাগরণ ও অভিভাবকত্ববাদী চিন্তা: জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থী মতবাদ
মুসলিম লীগের জাতীয়তাবাদী ধারার পাশাপাশি আরেকটি ইসলামপন্থী মতাদর্শিক ধারা গড়ে ওঠে—জামায়াতে ইসলামী। ১৯৪১ সালে লাহোরে আবুল আলা মওদূদী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। মওদূদী বিশ্ব ইসলামি চিন্তাবিদদের—রাশিদ রিদা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের হাসান আল-বান্নার—চিন্তা-ভাবনা দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদকে জাহেলিয়াত (ইসলামপূর্ব অন্ধকার যুগ) বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে, ইসলাম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার লক্ষ্য শারিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েম।
মওদূদী প্রথমে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেন। কারণ তিনি মনে করতেন, এটি মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করবে। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর তিনি পাকিস্তানকে ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর প্রভাবেই পাকিস্তানের সংবিধানে ইসলামি ধারার উপাদান সংযোজিত হয়।
জামায়াতে ইসলামীর উত্থানের মূলে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম নেতৃত্বের প্রতি হতাশা। মুসলিম লীগের ‘মুসলমানদের মাতৃভূমি’ বাস্তবে নৈতিক বা ধর্মীয় সমাজ গঠন করতে পারেনি। দুর্নীতি ও প্রাদেশিক বিভাজন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
এর আগেও বিভিন্ন পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন—যেমন ফরায়েজি আন্দোলন (১৮২০-র দশকে বঙ্গদেশে) ও আহলে-হাদিস আন্দোলন—ইসলামি সংস্কার ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতার মিশ্রণ ঘটিয়েছিল। একই সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও ওয়াহাবি প্রভাব মুসলিম সমাজে খেলাফত পুনরুদ্ধারের আহ্বান জাগায়।
ব্রিটিশ ভারতের নগরবাসী মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এই আদর্শ প্রচার করে। তারা মাদরাসা ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করে ‘পাশ্চাত্য-মনস্ক’ এবং ‘ঔপনিবেশিক মনোগঠন’ এর মুসলমানদের মোকাবিলা করতে চেয়েছিল।
উত্তর-ঔপনিবেশিক গতিপথ: রাষ্ট্রগঠন, সামরিক অভ্যুত্থান ও বৈশ্বিক প্রভাব
ভারত ভাগের পর ইসলামপন্থী রাজনীতি ভেঙে যায় ও নতুন রূপ নেয়। পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী সামরিক শাসক জিয়াউল হকের (১৯৭৭–১৯৮৮) সঙ্গে জোট বাঁধে। তাঁর ইসলামিকরণ কর্মসূচি—যেমন হুদুদ অধ্যাদেশ ও ধর্মদ্রোহ আইন (ব্লাসফেমি ল)—যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সহায়তায় শক্তিশালী হয়। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় এসব তহবিল হাজার হাজার মাদরাসার বিস্তার ঘটায়, যা পরবর্তীতে ‘চরমপন্থা’র কেন্দ্র হয়ে ওঠে। জমিয়াতে উলেমা-ই-ইসলাম (জেইউআই)-এর মতো দলগুলো কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে প্রভাব বাড়ায়।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। তবে ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ইসলাম ধীরে ধীরে রাজনীতিতে ফিরে আসে। ১৯৭৭ সালে সংবিধানে যোগ হয় ‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস’। আর ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। এই সংগঠনগুলো পাকিস্তান ভাঙার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশেও সংগঠিত শক্তিতে পরিণত হয়।
স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক দল থাকলেও তারা দীর্ঘদিন কংগ্রেসের ছায়ায় ছিল। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান—বিশেষত বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি—তাদের নতুনভাবে সংগঠিত হতে বাধ্য করে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর মতো দলগুলো গড়ে ওঠে। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা মুসলিম রাজনৈতিক চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে।
রাজনীতিকরণের মূল কারণসমূহ: বিভিন্ন শক্তির মিলনবিন্দু
ইসলামপন্থী রাজনীতির বিকাশ বুঝতে কয়েকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—
ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার: ১৮৫৭ সালের পর ব্রিটিশদের দমনমূলক নীতি ও পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী মুসলমানদের একটি পৃথক রাজনৈতিক শ্রেণিতে পরিণত করে। এতে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে ‘মুসলিম পরিচয়’ রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব পায়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপে যেন মুসলিমদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় বিলীন না হয়ে যায় সেজন্যই মুসলিমদের একটা বড় অংশ ইসলাপন্থার আশ্রয় নেয়।
পুনর্জাগরণ ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা: খেলাফত আন্দোলনের মতো উদ্যোগ ধর্মকে প্রতিরোধের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। আবুল আলা মওদূদীর মতো চিন্তাবিদ সাম্রাজ্যবাদ-উত্তর যুগে ইসলামভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা দেন।
সামাজিক-অর্থনৈতিক অসন্তোষ: মুসলিম অভিজাতদের পতন, কৃষকদের শোষণ (যেমন বাংলার নীল বিদ্রোহ) ও হিন্দু-প্রধান রাজনৈতিক কাঠামোয় সংখ্যালঘু হওয়ার আশঙ্কা মুসলমানদের ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে।
বৈশ্বিক প্রভাব: অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, সৌদি ওয়াহাবিবাদ ও স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী আফগান জিহাদ ইসলামি রাজনীতিকে ত্বরান্বিত করে।
উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ব্যর্থতা: অভ্যুত্থান, দুর্নীতি ও সেক্যুলারিজমের বিশ্বাসঘাতকতা (যেমন পাকিস্তানে) ইসলামপন্থী দলগুলোর বিকল্প জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করে।
ঐতিহ্য ও প্রতিফলন
ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে আমূল পরিবর্তন করেছে। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক উত্তেজনা—যেমন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধকরণ (২০১৩, পুনর্বহাল ২০২৪) ও পাকিস্তানের ধর্মদ্রোহ আইন নিয়ে বিতর্ক—সবকিছুতেই তাদের প্রভাব স্পষ্ট।
এই দলগুলোর স্থায়িত্ব প্রমাণ করে, ইসলাম রাজনৈতিক অভিযোজনে সক্ষম একটি ধর্ম। একসময় এটি ছিল বহুত্ববাদ ও ন্যায়বিচারের সেতুবন্ধন; পরবর্তীতে এটি ঔপনিবেশিক বঞ্চনার প্রতিরোধে এক প্রতিরক্ষা প্রাচীর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
উত্তর উপনিবেশিক সময়ে আজ যখন জলবায়ু সঙ্কট ও তরুণ জনগোষ্ঠীর বিস্তার নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, তখন এই ইসলামপন্থী দলগুলো হয় নতুনভাবে বিকশিত হবে, নয়তো ভেতর থেকে ভেঙে পড়বে। ইতিহাস দেখায়— যেখানে বৈষম্য ও অবিচার থাকে, সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও আবারও মাথা তোলে। বিশেষ করে ইসলামের ইনসাফ বা আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণা একে বারেবারে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলে।
এই ইতিহাস বোঝা শুধু একাডেমিক প্রয়াস নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর গণতন্ত্রগুলোকে বোঝারও চাবিকাঠি।
এআই প্রযুক্তির উন্নতির অর্থ হল এখন অতি-বাস্তবসম্মত ভয়েসওভার ও সাউন্ডবাইট তৈরি করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, আসল মানুষের কণ্ঠ থেকে আলাদা করা যায় না এআই-জেনারেটেড ভয়েস। এই এক্সপ্লেইনারে আমরা এআইয়ের সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করব।
১৭ ঘণ্টা আগেড্রোন বা মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) এখন আধুনিক যুদ্ধের অপরিহার্য অস্ত্র। একসময় এগুলো সীমিত পর্যবেক্ষণযন্ত্র ছিল, এখন তা নির্ভুল আঘাত, কম খরচ এবং নিরাপদ পরিচালনার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ক্ষুদ্রাকৃতির প্রযুক্তি ও সমন্বিত আক্রমণ ক্ষমতার অগ্রগতির ফলে ড্রোন এখন গুপ্তহত্য
১ দিন আগেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ধাপে ধাপে যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন। ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা ১০ অক্টোবর প্রথম ধাপের শান্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এতে ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এই সাফল্য গাজা যুদ্ধের প্রথম বড় ধরনের উত্তেজনা প্রশমনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
১ দিন আগেজুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। শিগগিরই হয়তো ভোটের আয়োজনও করা হবে। গণভোট হলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট, যা কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইন বা রাজনৈতিক বিষয়ে নেওয়া হয়।
২ দিন আগে