leadT1ad

আজ আন্তর্জাতিক কফি দিবস

কফিশপ কি এক ধরনের ‘ইলিউশনারি স্পেস’

কফিশপ। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

নাটক-সিনেমার সংলাপে এক সময় শোনা যেত, ‘ঠান্ডা, না গরম?’ বড়লোক নায়ক অথবা নায়িকার বাবারা বলতেন। অথবা বলতেন গরিব নায়কের বড়লোক বন্ধু। এরপর এলো নতুন সংলাপ, ‘চা, না কফি?’—এও শোনা গেছে বড়লোকদের মুখেই। অর্থাৎ বাঙালির সংস্কৃতিতে ঢুকে গেছে কফির পোড়া পোড়া চকলেটি স্বাদ। কিন্তু সিনেমার সংলাপে ঢোকার আগে কফি তো ঢুকে যাওয়ার কথা বাঙালির জীবন-সংলাপে। তা না হলে মান্না দে কেন এত কষ্ট করে গাইবেন—‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা…।’ আড্ডাটা নেই, তাতে কী, কফি হাউজ আছে, কফি তো আছেই।

ভারতীয় উপমহাদেশে কফি এসেছে আরব বণিকদের হাত ধরে। ‘বাঙালির খাদ্যকোষ’ বইয়ে মিলন দত্ত লিখেছেন, রাজকর্মচারীদের জন্যে আরব বণিকেরা বয়ে এনেছিলেন কফি বীজ। তবে কলকাতায় কফি এসেছে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। ১৮৪৮ সালে কফি পানের তৎপরতা চালিয়েছিলেন হেনরি পিডিংটন। উদ্দেশ্য ব্রিটিশ তরুণদের মদ্যপান কমানো। অতএব বোঝাই যাচ্ছে, উনিশ শতকের কফি বাঙালির তরে নহে।

কলকাতা তখন ঔপনিবেশিক শহর। টেরিকেটে ধুতি পরে বাবুরা হেঁটে বেড়াচ্ছেন। গড়ে উঠছে নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। একই সঙ্গে গড়ে উঠছে নতুন নতুন খাবার দোকান, হোটেল, ক্যাফে। যদিও কফি হাউজ তৈরি হয়েছে অনেক পরে। উনিশ শতকের বিখ্যাত রম্যবই ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সা’য় পাওয়া যাচ্ছে কফির খবর, ‘প্রাতরাশের জন্য টী ও কফি প্রস্তুত হয়।’

১৩১২ সালে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে অবস্থাপন্ন লোকের ভিতরে… উগ্রমদিরার পরিবর্ত্তে চা ও কফি’র প্রচলন হয়। ‘বঙ্গে অকালমৃত্যু’র কথা বলতে গিয়ে জানানো হয়েছে ইউরোপের প্রেক্ষাপটে উগ্র মদের পরিবর্তে চা-কফির প্রচলন শুরু হয়েছিল। আম-বাঙালি তখন হয়তো প্রাতরাশ হিসেবে খেত বাসি ভাত আর তারকারি।

আমরা দেখতে পাই খাদ্যবস্তু হিসেবে ‘কফি’র পরিগ্রহণ ঘটেছে। বাঙালি স্বাদ না পাক, গন্ধ না পাক, নাম তো অন্তত শুনেছে। কফি চেখে দেখার সুযোগ এলো ১৯৪১ সাল নাগাদ। এ বছর কলকাতায় তৈরি হলো বিখ্যাত ‘কফি হাউস’।

সে যাই হোক, উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে বাঙালির শব্দভান্ডারে জমা পড়ল ‘কফি’, ‘কফিখানা’, ‘কফিঘর’। ভারতী (১৯১১) পত্রিকায় সৌরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে কফির উল্লেখ, ‘জ্যাক মাতার পার্শ্বে থাকিয়া, কফি, চা, প্রভৃতি প্রস্তুত করিতেছিল।’

ভারতবর্ষ (১৯২৯) পত্রিকায় কায়রো নগরীর বর্ণনা দিতে গিয়ে ভারতকুমার বসু লিখেছেন, ‘এই কফি-খানাগুলি হচ্ছে কফি-ভক্তদের সামাজিক ব্যবহারের আদান-প্রদান করবার এক-একটী কেন্দ্র। কিন্তু উক্ত ব্যবহারের আদান-প্রদান অন্যান্য দেশবাসীদের মতো সাধারণ নিয়মানুসারে হয় না। সেখানকার লোকরা কফি-খানায় গিয়ে বসে খুব নিঃশব্দে, এবং তেমনি নিঃশব্দে ঠায় অনেক ঘণ্টা পর্য্যন্ত ব'সে থাকে… তারা কফির এত ভক্ত যে, সমস্ত দিনই, দোকানেই হোক বা বাড়ীতেই হোক,--ছোট ছোট ‘কাপে’ ক’রে গাঢ় কালো রঙের কফি খায়।’ ভারতবর্ষের (১৯৩০) সংখ্যায় ডেনমার্কের বর্ণনায় ভারতকুমার বসু লিখেছেন, ‘আহারের মধ্যে ‘কফি’ থেকে আরম্ভ ক’রে ৫:৬ রকমের রুটি, মাখন, মাছ, মাংস এবং মুরগী কিছুই বাদ যায় না।’

আমরা দেখতে পাই খাদ্যবস্তু হিসেবে ‘কফি’র পরিগ্রহণ ঘটেছে। বাঙালি স্বাদ না পাক, গন্ধ না পাক, নাম তো অন্তত শুনেছে। কফি চেখে দেখার সুযোগ এলো ১৯৪১ সাল নাগাদ। এ বছর কলকাতায় তৈরি হলো বিখ্যাত ‘কফি হাউস’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯৪৩) লেখায় এসেছে ‘কফিখানা’র বিবরণ, ‘কফিখানায় সেও একদিন তাকে কফি খাওয়াবে।’

ধীরে ধীরে কফির এই আদান-প্রদানের ভেতর দিয়ে ভিত্তি গড়ে উঠল আড্ডার নতুন সংস্কৃতি—‘কফি কালচার’। বাঙালির ‘পাবলিক’ জীবনের একটি প্রকাশ হয়ে উঠল কফি। আড্ডা, রাজনীতি, সংগীত, সাংবাদিকতা, তত্ত্বচর্চা, সিনেমা—অর্থাৎ সংস্কৃতির অপরাপর বহুমাত্রিক অংশও জায়গা পেয়েছে চা-কফিকেন্দ্রিক আড্ডাখানায়। কফি হাউজে আড্ডা দিতেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের মতো চলচ্চিত্রকাররা।

পঞ্চাশের দশকের ঢাকায় গড়ে উঠেছিল বিউটি বোর্ডিং। এখানেও সরগরম ছিল চা-কফির আড্ডা। সে সময় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আধুনিকতাসন্ধানী উৎসুক কবি আর শিল্পীর দল। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরীরা তখন জড়ো হতেন বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায়। অবশ্য এ সময়ের কবি-লেখকদের লেখায় চায়ের উল্লেখ যত পাওয়া যায়, কফির উল্লেখ ততো মেলে না।

অন্য দিকে ইউরো-আমেরিকান সংস্কৃতিতে কফি আর ক্যাফের প্রভাব প্রবল। আর এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়ে আছেন ফরাসি ঔপন্যাসিক বালজাক। তাঁকে ঘিরে প্রচলিত গল্প এই—হিউম্যান কমেডি লিখতে গিয়ে তিনি দিনে পান করতেন ৫০ কাপ কফি। বালজাকের অতি-পানের গল্প সত্যি হোক আর মিথ্যেই হোক, কফির মগে যে তিনি নিয়মিত চুমুক দিতেন, তাতে কোনো মিথ্যে নেই।

ইউরোপে শিল্প-সাহিত্যকেন্দ্রিক অনেক আন্দোলনই গড়ে উঠেছিল এ ধরনের ক্যাফে বা কফি কর্নারকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসের নথিপত্র সাক্ষ্য দেয়, দাদাবাদ ও পরাবাস্তববাদী কবিরা জড়ো হতেন ক্যাফে দে ফ্লোর, লেস ডেয়ুস ম্যাগোত, ক্যাফে ভলটেয়ারের মতো ক্যাফেতে। লক্ষ্য আলাপ, আড্ডা আর সাহিত্যের ইস্তেহারকে পরিস্ফূট করা।

ক্যাফে দে ফ্লোরেতে জাঁ পল সার্ত্রে ও সিমোন দ্য বুভুয়ের মগ্ন হতেন দার্শনিক আলাপে। তাঁদের সঙ্গী ছিল ‘কাবাব মে হাড্ডি নয়’, ধোঁয়া ওঠা গরম কফি। জানা যায়, জেমস জয়েস সময় কাটাতেন লিভারপুলের এক ক্যাফেতে। কফিশপে বসেই খুঁজে ফিরতেন নতুন লেখার নতুন ভাবনা। এই ধারণাও প্রচলিত যে, নিঃসঙ্গ লেখক ফ্রানজ কাফকা ক্যাফেকেই মনে করেছিলেন তাঁর আশ্রয়। কফিও কি খেতেন? কে জানে। অন্য দিকে, মর্মান্তিক এক প্রেমগাঁথায় কবি টিএস এলিয়ট লিখেছিলেন, ‘Have known the evenings, mornings, afternoons, /I have measured out my life with coffee spoons;’ অভিজ্ঞতার কী এক অসহনীয় স্তর, যেখানে জীবনকে মাপতে হচ্ছে কফির চামচে।

শুধু শিল্পকলা নয়, কফি আর ক্যাফের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ইতিহাস। জনমত তৈরির কেন্দ্র হিসেবে ক্যাফের সুনাম ও দুর্নাম দুই আছে। রাজনৈতিক কারণেই আমেরিকানরা চা বর্জন করে কফি ধরেছিল। কেন না ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৭৭৩ সালে চা আইন পাস করার মাধ্যমে ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আমেরিকার বাজারে কম ট্যাক্স দিয়ে চা বিক্রি করার সুবিধা দিয়েছিল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল উপনিবেশিত আমেরিকানরা। আর তখনই এসেছিল চা বর্জনের ধারণা।

বোস্টনের প্রতিবাদী জনতা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তিনটি জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল রাশি রাশি চায়ের বাকশো। আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডাম মনে করতেন চা পানের মানে হলো ‘কম দেশপ্রেমী’ হওয়া। এ কারণে বিকল্প পানীয় হিসেবে স্থান পেয়েছিল কফি। আর তাই বলা যায়, আমেরিকার সংস্কৃতিতে কফি স্বয়ং একটি প্রতিবাদী পানীয়।

শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরীরা তখন জড়ো হতেন বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডায়। অবশ্য এ সময়ের কবি-লেখকদের লেখায় চায়ের উল্লেখ যত পাওয়া যায়, কফির উল্লেখ ততো মেলে না।

নব্বইয়ের দশকের ঢাকায় জমে উঠেছে কফিশপ। ধীরে ধীরে বেড়েছে এ সবের আয়তন ও ধরন-ধারণ। মহানগরীর সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বলে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ‘টি-স্টল’ বলে যেরকম চায়ের দোকানগুলো গড়ে উঠেছিল, তেমন মাত্রায় না হলেও গত দুই-তিন দশকে শহরের আনাচেকানাচে গড়ে উঠেছে কফিশপ। সামাজিক শ্রেণি, অবস্থান ও ক্ষমতার দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে কফিশপের বিচিত্রসব বৈশিষ্ট্য। এমন অনেক চায়ের দোকান আছে, যেখানে কফি বিক্রি হয়।

প্রশ্ন হলো, কেন এত কফিশপ? এর একটি জবাব হতে পারে এরকম—নতুন পণ্য হিসেবে কফি চায়ের চেয়ে বেশি ‘আভিজাত্য’ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ভোক্তারা কফির আভিজাত্যকে বরণ করে নিয়েছে। এক সময় বাঙালির জন্য চা ছিল এই বনেদিপনার প্রতীক। আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে কফিকেন্দ্রিক আভিজাত্যের ‘সাধারণীকরণ’ ও ‘জনপ্রিয়করণ’ ঘটেছে। তার প্রমাণ এই যে, বাজারে কফির ছোট্ট প্যাকেট পাওয়া যায়। অনেক কফিপ্রেমী সে ধরনের ছোট ছোট প্যাকেট পকেটে করে বহন করেন। সেই ছোট প্যাকেটকে চায়ের দোকানে রেখে কফিভোক্তার কাছে সহজে বিক্রিও করা যায়। অনেকে আবার চা আর কফির মিশ্রণে প্রস্তুত ‘চাফি’ খেতেও পরম আগ্রহী। অতএব চায়ের দোকানজুড়ে মালার মতো ঝুলিয়ে রাখা হয় কফি।

মানুষের নিঃসঙ্গতা আর বিচ্ছিন্নতাও যেন বসিয়েছে কফিশপ। মানুষ বাড়ছে, দালান উঠছে; মাঠ নেই, পার্ক নেই; প্রকৃতির থেকে দূরে সরে গেছে অগণিত বিচ্ছিন্ন মানুষ। গাছের নিচে গোল হয়ে বসার হুল্লোড় নেই; কোথায় পাবে তারা আনন্দময় নিভৃতি? আর তাই, দেরি না করে, কাফকার মতো ঢুকে যাও আলো ঝলমলে কুঠুরিতে। একা থাকো। অথবা গুঞ্জন করো। অথবা বসে থাকো অন্য কারো সঙ্গে। পাশে রাখো প্রিয়তম সঙ্গীকে।

কফিশপে কেউ কেউ একাকিত্বকেও যাপন আর উদযাপন করেন। এখানে নেই চায়ের দোকানের মতো গভীর ঘন হয়ে আসা ভিড়। চাইলেই একা একটি কফির মগ হাতে নিয়ে চুপচাপ ডুবে থাকা যায়। নিবিড়ভাবে দেখা যায় অচেনা মানুষের মুখ, ভঙ্গি, হাসি। নস্টালজিয়াকে মুঠোবন্দি করে নিজের মতো দেখার একটি জায়গাও তৈরি করে দেয় কফিশপ। কফিশপ হয়ে উঠতে পারে স্মৃতির আধার। স্মৃতির সঙ্গে নিজের টুকিটাকি কথোপকথনও সেরে নেয় কেউ কেউ।

কফিশপ হয়ে উঠতে পারে জমজমাট কনাসার্ট। হয়তো একজন শিল্পী গান গাইছেন কিংবা সুর তুলছেন বেহালায়। সেই সুর আর গান শুনতে শুনতে বসানো যায় সমবেত আড্ডার আসর। একসময় উগড়ে দেওয়া যায় মনের ভেতর জমে থাকা সব মেঘরৌদ্র। সময়ের রূপরেখায় কফিশপ হয়ে উঠেছে নতুন এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে শহুরে, আধুনিক, টেকনোকালচারাল মানুষ খুঁজে পায় সঙ্গ ও নৈঃসঙ্গ্যের নিদান। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ এই নিদান খোঁজে না সত্য; কিন্তু যারা সংবেদনশীল, সমাজের উঁচু ও মাঝারি তলায় যাদের বসবাস, ভাবগতভাবে যারা পশ্চিমী আধুনিকতার সন্তান তাদের জন্য কফিশপ ঐতিহাসিকভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ স্থান।

আদতে বুর্জোয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য কফিশপ এক ধরনের ‘ইলিউশনারি স্পেস’; আলো, শব্দ, রঙ – এই তিনের যুগলবন্দিত্ব ভোক্তাকে দেয় রঙচঙে দুনিয়ার আবহ; যে দুনিয়া সে প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে যাপন করে, সেই দুনিয়ার ভেতর ছোট একটি মায়ার পৃথিবী, যেখানে হারিয়ে যাওয়া আমিকে নতুন করে চেনা যায়, তর্ক করা যায় স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে।

লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত