leadT1ad

পাক-আফগান সম্পর্কে টানাপোড়েন কেন?

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক আবারও উত্তপ্ত। সীমান্ত বরাবর হামলা, অভিযোগ-প্রত্যঅভিযোগ ও টিটিপির পুনরুত্থান দুই প্রতিবেশীকে সংঘাতের কিনারায় নিয়ে গেছে। তালেবান বলছে, পাকিস্তান আগ্রাসী আচরণ করছে; পাকিস্তান বলছে, কাবুল সরকার সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাস আসলে দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত ইতিহাসের ধারাবাহিকতা, যার শুরু ঔপনিবেশিক যুগের ডুরান্ড সীমান্ত থেকে।

তুফায়েল আহমদ
তুফায়েল আহমদ
ঢাকা
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ২১
পাক-আফগান সম্পর্কে টানাপোড়েন কেন। ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাবুলের ‘সার্বভৌম ভূখণ্ড’ লঙ্ঘন করার অভিযোগ তুলেছে আফগানিস্তান। গত শুক্রবার (১০ অক্টোবর) তালেবানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তানের এসব কর্মকাণ্ড ‘নজিরবিহীন, হিংসাত্মক ও উসকানিমূলক’। এই অভিযোগ আসার আগের রাতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে দুটি বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। পাশাপাশি আফগানিস্তানের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, দেশটির সীমান্তবর্তী পাকতিকা প্রদেশে একটি বেসামরিক বাজারে পাকিস্তানি বোমা আঘাত হেনেছে।

কাবুলে বিস্ফোরণের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই হামলার পেছনে সরাসরি পাকিস্তান জড়িত। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে দাবি করা হয়, হামলার মূল লক্ষ্য ছিল আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) প্রধান নুর ওয়ালি মেহসুদসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা।

পাকিস্তান যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে হামলার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি। কিন্তু দেশটির সেনাবাহিনীর বার্তা ছিল স্পষ্ট। গত শুক্রবারই (১০ অক্টোবর) পেশোয়ারে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশটির আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী দাবি করেন, আফগানিস্তানকে ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ ঘাঁটি’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আহমেদ শরিফ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানিদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তাই নেওয়া হবে।’

এদিকে আজ শনিবার (১১ অক্টোবর) পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের একটি পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আত্মঘাতী হামলা ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ছয়জন পুলিশকর্মী নিহত হয়েছেন। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)।

এসব কথিত গোপন হামলা, প্রকাশ্য হুমকি ও রক্তাক্ত প্রতিশোধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পাক-আফগান সম্পর্কের গভীর সংকটকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এই উত্তেজনা সাম্প্রতিক নয়, এর শেকড় প্রোথিত রয়েছে ঔপনিবেশিক যুগের সীমান্ত বিরোধ, শীতল যুদ্ধকালীন ছায়া সংঘাত এবং ৯/১১-পরবর্তী বিশ্বের উত্তাল ভূ-রাজনীতির মধ্যে।

বিতর্কিত সীমান্ত

বিশ্লেষকেরা দাবি করেন, ১৮৯৩ সালের ডুরান্ড লাইন চুক্তিই পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংঘাতের মূল শিকড়। ব্রিটিশ কূটনীতিক স্যার মর্টিমার ডুরান্ডের টানা সীমারেখা কার্যত পশতুন জনগোষ্ঠীর মাতৃভূমিকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। এক অংশ চলে যায় ব্রিটিশ ভারতের অধীনে, আরেক অংশ আফগানিস্তানে।

ব্রিটিশ ভারতের উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ডুরান্ড লাইনকে বৈধ আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে দেখলেও, আফগানিস্তান কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে স্বীকৃতি দেয়নি।

এই সীমান্ত-বিরোধ আফগান জাতীয়তাবাদের মধ্যে ‘পশতুনিস্তান’ ধারণাকে উসকে দিয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের বিশাল অংশ দখল করে পশতু জনগণকে একত্রে নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই ডুরাল্ড লাইন নিয়ে মতবিরোধ আফগান-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছিল। এর ফলে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করে, তখন আফগানিস্তান একমাত্র দেশ হিসেবে এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল।

হস্তক্ষেপের ভূ-রাজনীতি

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণ পুরো আঞ্চলিক ভারসাম্য বদলে দেয়। তখন পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সহায়তায় আফগান মুজাহিদিনদের (বিভিন্ন ইসলামপন্থী গেরিলা গোষ্ঠী) প্রধান মিত্র ও সহায়ক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

পাকিস্তানের এই নীতির পেছনে ছিল সোভিয়েত প্রভাব মোকাবেলা করা এবং কাবুলে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ, পাকিস্তানপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করার আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সংস্থা মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে। আফগানিস্তান পরিণত হয় ইসলামপন্থী যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণাগারে।

পাকিস্তানের এই সহায়তা আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের বিতাড়িত করতে অবদান রাখলেও এর জন্য পাকিস্তানকে এক চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ১৯৭৯-পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের চরমপন্থার উত্থান, অস্ত্রের বিস্তার এবং পাকিস্তান সীমান্তে শরণার্থীদের ঢল আজও পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে।

তালেবান প্যারাডক্স

আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের চলে যাওয়ার পরই দেশটিতে শুরু হয় ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই পাকিস্তান ‘তালেবান’ নামের নতুন এক শক্তিকে সমর্থন দিতে শুরু করে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই তালেবানকে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। এর ফলে ১৯৯০-এর দশকে তালেবান দ্রুত কাবুল দখল করে আফগানিস্তানের বড় অংশে আধিপত্য স্থাপন করে। পাকিস্তানসহ মাত্র তিনটি দেশ তালেবানের ইসলামিক এমিরেটকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

তালেবানকে এমন সমর্থন পাকিস্তানের ‘কৌশলগত সুরক্ষা’ নীতির (স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ) শীর্ষ অর্জন বলে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর সবকিছু বদলে যায়। অভিযোগ ওঠে, আল-কায়েদা তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান থেকে এই হামলা পরিচালনা করেছিল। এর জবাবে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে হামলা চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে পাকিস্তান বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়ার অন টেরর’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জোটে যোগ দিতে।

এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের নীতিতে গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি করে। একদিকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, অন্যদিকে তাদের গোয়েন্দা সংস্থার কিছু অংশ গোপনে তালেবান বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে থাকে।

পাকিস্তানের এই ‘দ্বৈত খেলা’ (ডাবল গেইম) ওয়াশিংটন ও কাবুল উভয়ের সঙ্গে দেশটির প্রচণ্ড অবিশ্বাস তৈরি করে।

দীর্ঘ ২০ বছরের সংঘাতের পর ২০২১ সালের ৩০ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণরূপে সেনা প্রত্যাহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দ্বিতীয় দফায় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তালেবান। প্রাথমিকভাবে তালেবানের ফিরে আসাকে ইসলামাবাদের কেউ কেউ কৌশলগত বিজয় হিসেবে দেখেছিল। তবে গবেষক আব্দুল রহমান এবং ওয়াং মিংজিনের মতে, পাকিস্তানের জন্য এটি আসলে পাইরিক বিজয়, অর্থাৎ এমন সাফল্য যা শেষ পর্যন্ত ক্ষতিই ডেকে এনেছে। কাবুলের ওপর প্রত্যাশিত প্রভাব খাটানোর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি; তার পরিবর্তে সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে তিক্ত হয়েছে।

বর্তমান সংঘাত: টিটিপি ও দোষারোপের খেলা

সাম্প্রতিক সংঘাতের প্রাথমিক চালক হলো তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর পুনরুত্থান। আদর্শগতভাবে আফগান তালেবানের সঙ্গে মিল থাকলেও টিটিপি একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী, যাদের লক্ষ্য পাকিস্তান রাষ্ট্রকে উৎখাত করে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর থেকে পাকিস্তানের ওপর টিটিপির হামলার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পাকিস্তান অভিযোগ করছে, এই হামলাগুলো আফগানিস্তানের মাটি থেকে পরিকল্পনা ও পরিচালনা করা হচ্ছে।

পাকিস্তানি কর্মকর্তারা দাবি করেন, আফগান তালেবান সক্রিয়ভাবে টিটিপিকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে এবং ইসলামাবাদের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য তাদের ছায়াশক্তি হিসেবে ব্যবহার করছে। এই উত্তেজনার ফলে পাকিস্তান ২০২২ ও ২০২৪-এ আফগানিস্তানে আন্তঃসীমান্ত বিমান হামলাও চালিয়েছে।

আফগান তালেবান তীব্রভাবে টিটিপিকে আশ্রয় দেওয়ার কথা অস্বীকার করে এবং পাকিস্তানি বিমান হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে নিন্দা জানায়। তালেবানের দাবি, টিটিপি পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা।

এই অচলাবস্থা একসময়ের কৌশলগত অংশীদার দুটি দেশকে প্রকাশ্য সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

এরিমধ্যে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানের স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী তালাল চৌধরী দেশটিতে বসবাসরত আফগান শরণার্থীদের মধ্যে যাদের শরণার্থী সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথি নেই, তাদেরকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পাকিস্তান ত্যাগের আল্টিমেটাম দেন।

পাক-আফগান উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলেছে শরণার্থীদের গণ নির্বাসন এই হুমকি। তালেবান যাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছে। অনেক পর্যবেক্ষক পাকিস্তানের এই পদক্ষেপকে আফগান সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছেন।

বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছক

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্ক শুধু এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই সম্পর্ক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর স্বার্থ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। আফগানিস্তানে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের উদ্বেগের কারণ। পাকিস্তানের দাবি, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো টিটিপি-কে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার জন্য আফগানিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করেছে।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কৌশলগত প্রতিযোগিতাও এই অঞ্চলের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীরতর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) মাধ্যমে ভূ-রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

আজকের পাকিস্তান–আফগান উত্তেজনা কোনো হঠাৎ জন্ম নেওয়া সংকট নয়। দশকের পর দশক ধরে উভয় দেশ রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন বিদ্রোহী/জঙ্গি গোষ্ঠীকে ব্যবহার করেছে, যার ফল এখন নিজেরাই ভোগ করছে। টিটিপি–সংঘাত এই ব্যর্থ নীতির সবচেয়ে দৃশ্যমান ফলাফল।

একদিকে আফগান তালেবান পাকিস্তানকে আগ্রাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে, অন্যদিকে পাকিস্তান মনে করছে তালেবান সরকার সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাস, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও সীমান্ত-রাজনীতির ফাঁদ এখন দুই প্রতিবেশী দেশকে এমন এক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে সমাধানের পথ সংকীর্ণ ও বিপদসঙ্কুল।

তথ্যসূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, ডন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, অ্যামনেস্টি কানাডা, ভিওএ নিউজ, দ্য ন্যাশনাল ব্যুরো অব এশিয়ান রিসার্চ, দ্য ডিপ্লোম্যাট, দ্য গার্ডিয়ান ও বিবিসি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত