leadT1ad

রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি, কিন্তু ফিলিস্তিনের অর্জন কতটুকু

ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপে-আমেরিকার আরও বড় পাঁচটি দেশ। এই স্বীকৃতি জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্য পদ অর্জনে সহায়ক হতে পারে। তবে তা ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশ্লেষকদের। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইসরায়েলের পাশে রয়েছে।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্বীকৃতিদাতা রাষ্ট্রগুলো গাজা বা পশ্চিম তীর ইস্যুতে আরও কঠোর প্রস্তাব সমর্থন দিতে পারে। স্ট্রিম গ্রাফিক

এবারের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে (৯ সেপ্টেম্বর-২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা গেল। গত ২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং পর্তুগাল ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এর পরদিন ২২ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সও একই ঘোষণা করে। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশগুলো ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। তাই এ সিদ্ধান্ত পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।

সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গাজা যুদ্ধ নিয়ে একটি বিশেষ সম্মেলন করে। এটি ফ্রান্স ও সৌদি আরবের উদ্যোগে গড়ে ওঠা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। তাদের লক্ষ্য হলো দুই রাষ্ট্র সমাধানকে পুনরুজ্জীবিত করা। এই সম্মেলনের সময় এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চলমান অধিবেশনের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের (২৩-২৮ সেপ্টেম্বর) আগে এই স্বীকৃতি আসল।

আরও পাঁচটি দেশ— অ্যান্ডোরা, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা এবং মোনাকোও জানিয়েছে তারাও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এতে বোঝা যায় যে, আন্তর্জাতিক সমাজের ধৈর্য ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কারণ শান্তি আলোচনা স্থবির হয়ে আছে এবং গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত বছর স্পেন, নরওয়ে এবং আয়ারল্যান্ডও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়।

ইউরোপীয় দেশগুলোর স্বীকৃতির এই ঘোষণা এসেছে গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যার প্রেক্ষাপটে। গত সোমবার জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কমিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সেখানে ৬৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে প্রায় ১৫৩ থেকে ১৫৬টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ তালিকায় চীন, রাশিয়া এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের বেশিরভাগ দেশও রয়েছে। প্রশ্ন হলো, এই স্বীকৃতি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কী অর্থ বহন করবে? এই স্বীকৃতিগুলো মূলত প্রতীকী। তবে এগুলো কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সংঘাতে ভাবমূর্তি ও জোট যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অস্ত্র এবং চুক্তিও সমানভাবে প্রভাব ফেলে।

এই স্বীকৃতিতে সরাসরি নিরাপত্তা পরিষদের নিয়ম বদলায়নি। তবে এর কার্যক্রমে নানা প্রভাব পড়তে পারে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এখন আর ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়ার প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র একা হয়ে পড়বে।

জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের অবস্থান শক্তিশালী হবে

২০১২ সাল থেকে ফিলিস্তিন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র। এতে তারা বক্তব্য দিতে পারে, প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে এবং ইউনেস্কোসহ কিছু সংস্থায় যোগ দিতে পারে। তবে তাদের পূর্ণ ভোটাধিকার নেই। নিরাপত্তা পরিষদেও তারা অংশ নিতে পারে না।

ফিলিস্তিন পূর্ণ সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল ২০১১ সালে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রয়োগে প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। ২০২৩ ও ২০২৪ সালেও একই কারণে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। যদিও সাধারণ পরিষদে ব্যাপক সমর্থন ছিল।

জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্য হওয়ার দুটি ধাপ রয়েছে। এক. নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশ পেতে হবে। এর জন্য ১৫ সদস্যের মধ্যে কমপক্ষে ৯ জনের সমর্থন লাগবে। তবে স্থায়ী পাঁচ সদস্যের (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন) কারও ভেটো থাকা চলবে না। দুই. এরপর সাধারণ পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন লাগবে। সেই সমর্থন অবশ্য ফিলিস্তিন পেয়ে গেছে।

যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ায় সরাসরি নিরাপত্তা পরিষদের নিয়ম বদলায়নি। তবে এর কার্যক্রমে নানা প্রভাব পড়তে পারে। রাশিয়া ও চীন আগেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখন একা হয়ে পড়েছে। এতে ইসরায়েলপন্থী ভেটো ব্লকও ভেঙে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার ব্যবহার আরও একতরফা বলে মনে হবে। বৈশ্বিকভাবে এটি মার্কিন আধিপত্য থেকে সরে বহুমেরুকেন্দ্রিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ারও ইঙ্গিত দেয়।

২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ছবি: সংগৃহীত।
২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগাল ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। ছবি: সংগৃহীত।

যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এখন আর ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্য পদ দেওয়ার প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। আগে তারা প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত থাকত। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদে নেই, তবে তারা নিয়মিত প্রার্থী ও পশ্চিমা ব্লকের প্রভাবশালী রাষ্ট্র। এতে করে ১০ অস্থায়ী সদস্যের মধ্যে (যেমন আলজেরিয়া, গায়ানা, দক্ষিণ কোরিয়া), যারা প্রায়ই ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে, তাদের সমর্থন পাওয়াও সহজ হতে পারে।

ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাব আসন্ন সাধারণ পরিষদের মূল অধিবেশনে (২৩-২৮ সেপ্টেম্বর) উত্থাপিত হতে পারে। যদি প্রস্তাবটি পাস হয়, ফিলিস্তিন পূর্ণ সদস্যপদ পাবে। ফলে সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের ভোটাধিকার মিলবে এবং ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিষদেও অস্থায়ী আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো এখনো সবচেয়ে বড় বাধা।

সংঘাত-সংক্রান্ত প্রস্তাবেও ভোটের ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। নতুন স্বীকৃতিদাতা রাষ্ট্রগুলো গাজা বা পশ্চিম তীর ইস্যুতে আরও কঠোর প্রস্তাব সমর্থন বা সহ-প্রস্তাব দিতে পারে। যেমন— বসতি স্থাপন বা সামরিক অভিযানের নিন্দা। নিরাপত্তা পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় আছে। ১৯৪৮ থেকে এ পর্যন্ত ৫০ বারের বেশি ভেটো হয়েছে। এবার কিছুটা ভারসাম্য আসতে পারে।

শুধুই কি রাজনৈতিক প্রদর্শনী?

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শুধু স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়। এটি বাস্তব পদক্ষেপের সঙ্গে না মিললে তেমন ফল দেবে না। মাঠপর্যায়ে এর ফলে তাৎক্ষণিক কোনো পরিবর্তনও আসবে না।

আল জাজিরার বিশ্লেষক ক্রিস ওসিয়েক ও মোহাম্মদ এলমাসরি এই স্বীকৃতিকে ‘প্রদর্শনমূলক’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, এটি পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলি বসতকারীদের সহিংসতা থামাতে পারবে না। গাজার পাশাপাশি সেখানেও এখন পর্যন্ত সেখানে ১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। একইভাবে প্রয়োগযোগ্য ব্যবস্থা, যেমন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছাড়া মানবিক সহায়তাও পৌঁছানো সম্ভব নয়।

আইন বিশেষজ্ঞরাও মনে করিয়ে দেন, বিষয় দুটি আলাদা। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাক বা না পাক, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সব দেশই সম্ভাব্য গণহত্যা রোধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।

এদিকে হামাস এই স্বীকৃতিকে ইতিমধ্যেই তাদের ‘কূটনৈতিক বিজয়’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে সংগঠনটির যুদ্ধবিরতি নিয়ে অনমনীয় অবস্থান আরও শক্ত হতে পারে।

এ স্বীকৃতিগুলো প্রায়ই শর্তসাপেক্ষ। যেমন যুক্তরাজ্য তার সিদ্ধান্তকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। অস্ট্রেলিয়া আবার একে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার সঙ্গে সম্পর্কিত করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েলি দখলদারিত্ব অবসান না ঘটালে এসব পদক্ষেপ কেবল পশ্চিমা নেতাদের জন্য ‘মান বাঁচানোর’ প্রতীকী উদ্যোগ হয়ে দাঁড়াবে। গাজা নিয়ে তাঁরা নিজ নিজ দেশে প্রবল সমালোচনার মুখে এই স্বীকৃতি দিয়েছেন।

প্যালেস্টাইন ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির অ্যাডভোকেসি পরিচালক ইনেস আবদেল রাজেক বলেন, ‘পশ্চিমা দেশগুলো প্রতীকী উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা ন্যায়বিচার বা রাষ্ট্র কোনোটিই পায় না। বরং বাস্তবতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের ফাঁক আরও বেড়ে যায়।’ আল শাবাকা নামের ফিলিস্তিনি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রকাশিত এক লেখায় তিনি এ কথা বলেন।

দ্য গার্ডিয়ান-এর কলামিস্ট ওয়েন জোন্স বলেন, ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপই আসলে লোক দেখানো। এর উদ্দেশ্য জনমতের চাপ কমানো, বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া নয়।’

এ নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে যে নতুন স্বীকৃতিগুলোর প্রতি ইসরায়েল কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জাতিসংঘ পরিচালক রিচার্ড গাওয়ান সম্প্রতি মার্কিন নীতি বিষয়ক জার্নাল জাস্ট সিকিউরিটি-তে প্রকাশিত এক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেন।

গাওয়ান লেখেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘের বেশিরভাগ সদস্য দেশের বিরোধিতা করে আসছেন। কূটনীতিকদের আশঙ্কা হলো, নেতানিয়াহু হয়তো এই স্বীকৃতির জবাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের আরও কিছু অংশ সংযুক্ত করার পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতে পারেন। কারণ তিনি গত সপ্তাহে ঘোষণা দেন যে ‘কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র হবে না’।

সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গাজা যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ সম্মেলনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয় ফ্রান্স। ছবি: সংগৃহীত।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গাজা যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ সম্মেলনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয় ফ্রান্স। ছবি: সংগৃহীত।

স্বীকৃতি কি শান্তি আনতে পারে?

শুধু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিলেই গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ থেমে যাবে না। ইসরায়েলি সংবাদপত্র ‘হারেত্জ’-এ প্রকাশিত এক কলামে গিদেওন লেভি লেখেন, ‘শুধু স্বীকৃতি দিলে হবে না। গণহত্যা চালিয়ে যাওয়া একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বর্জন ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ তাঁর মতে, স্বীকৃতি আসলে ফাঁকা কথার মতো। এটি গণহত্যা থামাতে পারবে না। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।’

আইন বিশেষজ্ঞরাও মনে করিয়ে দেন, বিষয় দুটি আলাদা। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাক বা না পাক, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সব দেশই সম্ভাব্য গণহত্যা রোধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য।

অবশ্য ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামোর ভেতরে যুদ্ধবিরতির দাবি আরও শক্তিশালী হতে পারে। ১৯৮৯ সালে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জেনেভা কনভেনশনে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সুইজারল্যান্ড তা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের যুক্তি ছিল, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

দ্বিপাক্ষিক স্বীকৃতিকে এক ধরনের কূটনৈতিক উন্নতি বলা যেতে পারে। স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলো ফিলিস্তিনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নতুন করে পর্যালোচনা করবে।

ডয়চে ভেলে-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেনেভা সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির শান্তি আলোচক নোমি বার-ইয়াকভ বলেন, ‘স্বীকৃতি সঙ্গে সঙ্গে কিছু বদলায় না। তবে এটি ফিলিস্তিনিদের আলোচনায় অনেক বেশি গুরুত্ব এনে দেয়। কারণ রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের আলোচনার অবস্থান, রাষ্ট্র বনাম অস্বীকৃত সত্তার আলোচনার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।’

দ্বিপাক্ষিক স্বীকৃতিকে এক ধরনের কূটনৈতিক উন্নতি বলা যেতে পারে। স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলো ফিলিস্তিনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নতুন করে পর্যালোচনা করবে। একই সঙ্গে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতাও মূল্যায়ন করতে হবে। এ কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কও পুনর্বিবেচনার প্রশ্ন উঠতে পারে।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু স্বীকৃতি নয়, এর সঙ্গে বাস্তব পদক্ষেপও জরুরি। ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের (ইসিএফআর) মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ নীতি গবেষক হিউ লোভাট ডয়চে ভেলে-কে বলেন, ‘স্বীকৃতি নিজে কোনো নীতি নয়, বরং এটি একটি সূচনা।’

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ক প্রভাষক আনাস ইকতাইত আকফার-এ প্রকাশিত এক লেখায় বলেন, ‘আসল কাজ শুরু হয় স্বীকৃতির পরের দিন থেকেই।’

হিউ লোভাট স্বীকার করেন যে স্বীকৃতি মূলত প্রতীকী। তবে তার মতে, প্রতীক সবসময় খারাপ নয়। বিশেষ করে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশের স্বীকৃতি ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ পুনঃনিশ্চয়তা। এটি দখলমুক্ত জীবনযাপনের অধিকার ও রাষ্ট্রের অধিকারের স্বীকৃতি বহন করে।

তবুও তিনি বলেন, ‘প্রতীকী পদক্ষেপের পাশাপাশি বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে।’

ফিলিস্তিন প্রথমবারের মতো পশ্চিমা শক্তির নজিরবিহীন স্বীকৃতি পেয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।
ফিলিস্তিন প্রথমবারের মতো পশ্চিমা শক্তির নজিরবিহীন স্বীকৃতি পেয়েছে। ছবি: সংগৃহীত।

গত বুধবার ব্রাসেলসে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কাল্লাস সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানান কিছু ইসরায়েলি পণ্যে শুল্ক বাড়াতে এবং পশ্চিম তরে বসতি স্থাপনকারীদের সঙ্গে দুজন জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি নেতার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে। এসব পদক্ষেপ আগেও ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এর বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেছিলেন। ব্রাসেলসের একটি সূত্র ডয়চে ভেলে-কে জানায়, ইতালি—যারা এতদিন ইসরায়েলের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ইউরোপীয় অর্থায়ন বন্ধের বিরোধিতা করছিল—তারাও হয়তো অবস্থান বদলাতে পারে।

লোভাট বলেন, কয়েক বছর আগেও স্বীকৃতিই হয়তো আলোচনার শেষ কথা হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। জনমত ও রাজনৈতিক মতামতের নাটকীয় পরিবর্তনে বিষয়টি আর শুধু ‘স্বীকৃতি দেবেন কি দেবেন না’ এই প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়।

তিনি উল্লেখ করেন, এখন একাধিক পদক্ষেপ একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এটি দেখায় ২০২৩ সালের পর থেকে জনমতের চাপে রাজনৈতিক পরিসর জুড়ে বড় পরিবর্তন এসেছে।

লোভাটের মতে, স্বীকৃতিকে একটি যাত্রাপথ হিসেবে দেখা উচিত। তিনি বলেন, আমরা হয়তো আগামীকাল লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না, তবে পথটি এখন পরিষ্কার।

এই স্বীকৃতিগুলো রাতারাতি সীমান্ত পরিবর্তন করবে না বা রক্তপাত থামাবে না। তবে এগুলো অসলো চুক্তির (১৯৯৩) পর থেকে চলমান স্থবিরতা ভেঙে দিয়েছে। ফিলিস্তিন প্রথমবারের মতো পশ্চিমা শক্তির নজিরবিহীন স্বীকৃতি পেয়েছে, আর ইসরায়েল কূটনৈতিকভাবে চাপে পড়েছে। এর ফলে দুই-রাষ্ট্র সমাধান আবার নতুন করে গুরুত্ব পেতে পারে— তবে কেবল তখনই, যখন নিষেধাজ্ঞা বা বাণিজ্যিক অবরোধের মতো কার্যকর পদক্ষেপও যুক্ত হবে।

আল জাজিরার বিশ্লেষক আবু রাস-এর ভাষায়, ‘এটি হতে পারে বাস্তব পরিবর্তনের দিকে “প্রথম ধাপ”। তবে এর সাফল্য নির্ভর করছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ধারাবাহিক পদক্ষেপের ওপর।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত