পাকিস্তানি অভিজাতরাও তাদের ক্ষমতার দখল কতটা নিরাপদ তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেছেন। কারণ, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের জনগণ তাদের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেও প্রায় একই রকম অভিযোগ রয়েছে। এই দেশগুলোর জনগণের অভিযোগ তাদের সরকার নিজেদের স্বার্থ ছাড়া জনগণের প্রতি উদাসীন এবং একনায়কতান্ত্রিক।
স্ট্রিম ডেস্ক
নেপালের সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা অলি গত রবিবার দেশটির তরুণ বিক্ষোভকারীদের নিয়ে উপহাস করেছিলেন। কারণ তারা দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের নামে গড়ে ওঠা ক্ষমতার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বড় বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছিল। অলি বলেছিলেন, তারা ভেবেছে নিজেদের ‘জেন জি’ নাম দিয়ে তারা যেকোনো দাবি করতে পারবে।
ওই মন্তব্যের পর ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে অলি পদত্যাগে বাধ্য হন। এই নাটকীয় ঘটনা নেপালকে ফের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। এর আগে শ্রীলঙ্কা (২০২২) এবং বাংলাদেশেও (২০২৪) তরুণদের আন্দোলন সরকার পতন ঘটায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল ৩ কোটি মানুষের দেশটিকে নয়, বরং পুরো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকেও প্রভাবিত করতে পারে।
নেপালে তরুণদের আন্দোলন এবারই প্রথম ঘটেনি। দেশটির আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাস ছাত্র আন্দোলন, রাজপ্রাসাদের হস্তক্ষেপ এবং সহিংসতার চক্রে ভরা। রয়েছে একটি দশ বছরের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধও।
রানা শাসন থেকে পঞ্চায়েত যুগ
আধুনিক শিক্ষিত নেপালিরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় তারা নেপালের রানা রাজতন্ত্রের সরাসরি শাসন অবসানের দাবিও তোলেন। এর মধ্য দিয়েই ১৯৫১ সালে নেপালে প্রথম আধুনিক বিপ্লব ঘটে। এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে রানাদের ক্ষমতা সীমিত করা হয়।
চুক্তির পর বিক্ষোভের সময় ভারতের পালিয়ে যাওয়া নেপালের রাজা ত্রিভুবন দেশে ফিরে আসেন। রানা বংশের সদস্য এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল নেপালি কংগ্রেসের (এনসি) সমন্বয়ে একটি সরকার গঠিত হয়।
১৯৫৯ সালে দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। নেপালি কংগ্রেসের নেতা বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু এক বছর পর রাজা মাহেন্দ্র বীর বিক্রম কৈরালা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কৈরালা সরকারের জনপ্রিয় ভূমি সংস্কারের কারণে দেশের অভিজাত শাসক শ্রেণির একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
এর পরিবর্তে রাজা ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরবর্তী তিন দশক রাজতন্ত্রসহ সেই ব্যবস্থাই বহাল থাকে। এই সময়ে গণ-রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত থাকায়, ছাত্র আন্দোলনই বিরোধ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত সংস্কারের জন্য আন্দোলন হয়।
বছরের পর বছর ধরে চলা এই ধারাবাহিক আন্দোলন ১৯৯০ সালে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পতন ঘটায়। এর ফলে সংসদীয় রাজনীতির দরজা পুনরায় খুলে যায়।
সশস্ত্র বিদ্রোহ ও প্রজাতন্ত্রের উত্থান
১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) রাজতন্ত্র উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালায়। এই সংঘাতে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
২০০৬ সালে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও ছাত্রদের অংশগ্রহণে এক আন্দোলন রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। অবসান ঘটে রাজতন্ত্রের। ২০০৮ সালে নেপালকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।
এরপর থেকে তিন প্রধান দল— সিপিএন-ইউএমএল, সিপিএন-এমসি এবং নেপালি কংগ্রেস— এর নেতারা পালাক্রমে দেশ শাসন করেছেন। গত ১৭ বছরে এই তিন দলের আটজন নেতা মিলে ১৪ বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সম্প্রতি পদত্যাগ করা কে পি শর্মা অলি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর অলি সরকারের নিষেধাজ্ঞা এই আন্দোলনের তাৎক্ষণিক কারণ হলেও এর পেছনে বহুদিনের জমা ক্ষোভও ছিল।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক রাজনীশ ভান্ডারি বলেন, এই আন্দোলন শাসকদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে মানুষের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। তার মতে, নেপালি তরুণরা ক্ষুব্ধ ছিল কারণ শাসকরা তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি, সংলাপে আসেনি এবং উদ্ধতভাবে আচরণ করেছে।
কাঠমান্ডুর নাগরিক ও ডিজিটাল অধিকারকর্মী আশীর্বাদ ত্রিপাঠীও বলেন, এই বিক্ষোভ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। তার মতে, রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিই এ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। তিনটি প্রধান দলের প্রবীণ নেতারা বারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু জনগণের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেননি।
ভূগোল, প্রতিবেশী ও শক্তির রাজনীতি
ঐতিহাসিকভাবে নেপাল ভারতের ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে ঘরোয়া রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্র নীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী অলিকে অনেকেই চীনপন্থী মনে করতেন। তার পদত্যাগের পর কূটনৈতিক ভারসাম্য নতুন করে নির্ধারণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক বিচারপতি সুশিলা কার্কিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট নয়।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, নতুন নেতা যেই হোন না কেন, ভারত ও চীন উভয়েই নেপালে স্থিতিশীল সরকার চাইবে। কারণ, কোনো প্রতিবেশীই চাইবে না যে অপর প্রতিবেশী নেপালে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করুক।
অধিকারকর্মী আশীর্বাদ ত্রিপাঠীর মতে, নেপাল সবসময় দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তিনি বলেন, দক্ষিণে ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা এবং উত্তরে চীনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক মিল থাকলেও নেপালের মূলনীতি হলো দুদেশের সঙ্গে সমান ভারসাম্য বজায় রাখা। আগামীতেও এই নীতি বহাল থাকবে।
আঞ্চলিক হিসাব-নিকাশ
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কোম্পানি হিলিক্স-এর দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ আলি হাসান মনে করেন, অলির পতন কাঠমান্ডুতে বেইজিংয়ের জন্য একটি ধাক্কা হতে পারে। একই সঙ্গে এটি নয়াদিল্লির জন্য সুযোগও তৈরি করতে পারে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির কিছু অংশ নেপালের রাজতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে সমর্থন দেয়। এই আন্দোলনের দাবির মূল কথা—হিমালয়ের দেশে রানাদের আবার ক্ষমতায় ফেরাতে হবে।
সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র এ বছরের শুরুর দিকে কাঠমান্ডুতে বিশাল জনসংবর্ধনা পান। এতে বোঝা যায়, নেপালি সমাজের একাংশ এখনো রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানায়।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে যদি রাজতন্ত্রপন্থীরা লাভবান হয়, তাহলে ভারতের বিজেপিও রাজনৈতিক সুবিধা পেতে পারে। তবে হাসানের মতে, তরুণরা রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ফেরানোর পক্ষপাতী নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানও নেপালের ঘটনাবলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে ভারত ও চীনের তুলনায় পাকিস্তানের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও কৌশলগত দিক থেকে তা সীমিত।
তবুও নেপালের শাসকরা মাঝে মাঝে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখিয়ে ভারতকে নিজেদের বিকল্প আঞ্চলিক অবস্থান স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
১৯৬০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কৈরালা সরকারকে বরখাস্ত করার জন্য নেপালের রাজা মাহেন্দ্রর সমালোচনা করেছিলেন। এর এক বছর পর নেপালি রাজা পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকেও নেপালে আমন্ত্রণ জানান।
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময়, গত মে মাসে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের হাতে ২৬ জন নিহত হওয়ার পর, নেপাল পাকিস্তানের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির একটি প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায়। এতে নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ দেখা দেয়। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরে অলিকে বেইজিং-ঘনিষ্ঠ মনে করে আসছে। আর বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলো ইসলামাবাদ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান নিজেও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখেছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে সংসদীয় অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে ক্ষমতা সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে। বিশ্লেষকদের মতে, নেপালের এই সংকট পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির মধ্যেও দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারে।
বিশ্লেষক হাসান বলেন, পাকিস্তানি অভিজাতরাও হয়তো তাদের ক্ষমতার দখল কতটা নিরাপদ তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেছেন। কারণ, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের জনগণ তাদের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেও প্রায় একই রকম অভিযোগ রয়েছে। এই দেশগুলোর জনগণের অভিযোগ তাদের সরকার নিজেদের স্বার্থ ছাড়া জনগণের প্রতি উদাসীন এবং একনায়কতান্ত্রিক।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাঠমান্ডুভিত্তিক এক মানবাধিকারকর্মী বলেন, নেপালের নতুন নেতা পাকিস্তানকে বেশি গুরুত্ব দেবেন না।
তিনি বলেন, নেপালের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। কিন্তু ভারত বা চীনের মতো পাকিস্তানকে নেপালি রাজনীতির মূল ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা হয় না। নেপালের সরকারগুলোও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে আলাদা কোনো নীতি অনুসরণ করে না।
সূত্র: আল-জাজিরা
নেপালের সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা অলি গত রবিবার দেশটির তরুণ বিক্ষোভকারীদের নিয়ে উপহাস করেছিলেন। কারণ তারা দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের নামে গড়ে ওঠা ক্ষমতার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বড় বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছিল। অলি বলেছিলেন, তারা ভেবেছে নিজেদের ‘জেন জি’ নাম দিয়ে তারা যেকোনো দাবি করতে পারবে।
ওই মন্তব্যের পর ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে অলি পদত্যাগে বাধ্য হন। এই নাটকীয় ঘটনা নেপালকে ফের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। এর আগে শ্রীলঙ্কা (২০২২) এবং বাংলাদেশেও (২০২৪) তরুণদের আন্দোলন সরকার পতন ঘটায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল ৩ কোটি মানুষের দেশটিকে নয়, বরং পুরো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকেও প্রভাবিত করতে পারে।
নেপালে তরুণদের আন্দোলন এবারই প্রথম ঘটেনি। দেশটির আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাস ছাত্র আন্দোলন, রাজপ্রাসাদের হস্তক্ষেপ এবং সহিংসতার চক্রে ভরা। রয়েছে একটি দশ বছরের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধও।
রানা শাসন থেকে পঞ্চায়েত যুগ
আধুনিক শিক্ষিত নেপালিরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় তারা নেপালের রানা রাজতন্ত্রের সরাসরি শাসন অবসানের দাবিও তোলেন। এর মধ্য দিয়েই ১৯৫১ সালে নেপালে প্রথম আধুনিক বিপ্লব ঘটে। এক ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে রানাদের ক্ষমতা সীমিত করা হয়।
চুক্তির পর বিক্ষোভের সময় ভারতের পালিয়ে যাওয়া নেপালের রাজা ত্রিভুবন দেশে ফিরে আসেন। রানা বংশের সদস্য এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল নেপালি কংগ্রেসের (এনসি) সমন্বয়ে একটি সরকার গঠিত হয়।
১৯৫৯ সালে দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। নেপালি কংগ্রেসের নেতা বিশ্বেশ্বর প্রসাদ কৈরালা প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু এক বছর পর রাজা মাহেন্দ্র বীর বিক্রম কৈরালা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কৈরালা সরকারের জনপ্রিয় ভূমি সংস্কারের কারণে দেশের অভিজাত শাসক শ্রেণির একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়েছিল।
এর পরিবর্তে রাজা ‘পঞ্চায়েত’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরবর্তী তিন দশক রাজতন্ত্রসহ সেই ব্যবস্থাই বহাল থাকে। এই সময়ে গণ-রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত থাকায়, ছাত্র আন্দোলনই বিরোধ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত সংস্কারের জন্য আন্দোলন হয়।
বছরের পর বছর ধরে চলা এই ধারাবাহিক আন্দোলন ১৯৯০ সালে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পতন ঘটায়। এর ফলে সংসদীয় রাজনীতির দরজা পুনরায় খুলে যায়।
সশস্ত্র বিদ্রোহ ও প্রজাতন্ত্রের উত্থান
১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) রাজতন্ত্র উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালায়। এই সংঘাতে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
২০০৬ সালে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও ছাত্রদের অংশগ্রহণে এক আন্দোলন রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে। অবসান ঘটে রাজতন্ত্রের। ২০০৮ সালে নেপালকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।
এরপর থেকে তিন প্রধান দল— সিপিএন-ইউএমএল, সিপিএন-এমসি এবং নেপালি কংগ্রেস— এর নেতারা পালাক্রমে দেশ শাসন করেছেন। গত ১৭ বছরে এই তিন দলের আটজন নেতা মিলে ১৪ বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সম্প্রতি পদত্যাগ করা কে পি শর্মা অলি চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর অলি সরকারের নিষেধাজ্ঞা এই আন্দোলনের তাৎক্ষণিক কারণ হলেও এর পেছনে বহুদিনের জমা ক্ষোভও ছিল।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক রাজনীশ ভান্ডারি বলেন, এই আন্দোলন শাসকদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে মানুষের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। তার মতে, নেপালি তরুণরা ক্ষুব্ধ ছিল কারণ শাসকরা তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি, সংলাপে আসেনি এবং উদ্ধতভাবে আচরণ করেছে।
কাঠমান্ডুর নাগরিক ও ডিজিটাল অধিকারকর্মী আশীর্বাদ ত্রিপাঠীও বলেন, এই বিক্ষোভ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। তার মতে, রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিই এ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। তিনটি প্রধান দলের প্রবীণ নেতারা বারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু জনগণের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেননি।
ভূগোল, প্রতিবেশী ও শক্তির রাজনীতি
ঐতিহাসিকভাবে নেপাল ভারতের ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে ঘরোয়া রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্র নীতিতেও পরিবর্তন এসেছে। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী অলিকে অনেকেই চীনপন্থী মনে করতেন। তার পদত্যাগের পর কূটনৈতিক ভারসাম্য নতুন করে নির্ধারণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক বিচারপতি সুশিলা কার্কিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট নয়।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, নতুন নেতা যেই হোন না কেন, ভারত ও চীন উভয়েই নেপালে স্থিতিশীল সরকার চাইবে। কারণ, কোনো প্রতিবেশীই চাইবে না যে অপর প্রতিবেশী নেপালে অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করুক।
অধিকারকর্মী আশীর্বাদ ত্রিপাঠীর মতে, নেপাল সবসময় দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তিনি বলেন, দক্ষিণে ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা এবং উত্তরে চীনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক মিল থাকলেও নেপালের মূলনীতি হলো দুদেশের সঙ্গে সমান ভারসাম্য বজায় রাখা। আগামীতেও এই নীতি বহাল থাকবে।
আঞ্চলিক হিসাব-নিকাশ
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কোম্পানি হিলিক্স-এর দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ আলি হাসান মনে করেন, অলির পতন কাঠমান্ডুতে বেইজিংয়ের জন্য একটি ধাক্কা হতে পারে। একই সঙ্গে এটি নয়াদিল্লির জন্য সুযোগও তৈরি করতে পারে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির কিছু অংশ নেপালের রাজতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে সমর্থন দেয়। এই আন্দোলনের দাবির মূল কথা—হিমালয়ের দেশে রানাদের আবার ক্ষমতায় ফেরাতে হবে।
সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র এ বছরের শুরুর দিকে কাঠমান্ডুতে বিশাল জনসংবর্ধনা পান। এতে বোঝা যায়, নেপালি সমাজের একাংশ এখনো রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানায়।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকটে যদি রাজতন্ত্রপন্থীরা লাভবান হয়, তাহলে ভারতের বিজেপিও রাজনৈতিক সুবিধা পেতে পারে। তবে হাসানের মতে, তরুণরা রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে ফেরানোর পক্ষপাতী নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানও নেপালের ঘটনাবলি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে ভারত ও চীনের তুলনায় পাকিস্তানের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও কৌশলগত দিক থেকে তা সীমিত।
তবুও নেপালের শাসকরা মাঝে মাঝে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখিয়ে ভারতকে নিজেদের বিকল্প আঞ্চলিক অবস্থান স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
১৯৬০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কৈরালা সরকারকে বরখাস্ত করার জন্য নেপালের রাজা মাহেন্দ্রর সমালোচনা করেছিলেন। এর এক বছর পর নেপালি রাজা পাকিস্তান সফর করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকেও নেপালে আমন্ত্রণ জানান।
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময়, গত মে মাসে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বন্দুকধারীদের হাতে ২৬ জন নিহত হওয়ার পর, নেপাল পাকিস্তানের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির একটি প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানায়। এতে নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ দেখা দেয়। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরে অলিকে বেইজিং-ঘনিষ্ঠ মনে করে আসছে। আর বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলো ইসলামাবাদ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান নিজেও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখেছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে সংসদীয় অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে ক্ষমতা সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে। বিশ্লেষকদের মতে, নেপালের এই সংকট পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির মধ্যেও দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারে।
বিশ্লেষক হাসান বলেন, পাকিস্তানি অভিজাতরাও হয়তো তাদের ক্ষমতার দখল কতটা নিরাপদ তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেছেন। কারণ, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের জনগণ তাদের রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেও প্রায় একই রকম অভিযোগ রয়েছে। এই দেশগুলোর জনগণের অভিযোগ তাদের সরকার নিজেদের স্বার্থ ছাড়া জনগণের প্রতি উদাসীন এবং একনায়কতান্ত্রিক।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাঠমান্ডুভিত্তিক এক মানবাধিকারকর্মী বলেন, নেপালের নতুন নেতা পাকিস্তানকে বেশি গুরুত্ব দেবেন না।
তিনি বলেন, নেপালের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। কিন্তু ভারত বা চীনের মতো পাকিস্তানকে নেপালি রাজনীতির মূল ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা হয় না। নেপালের সরকারগুলোও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে আলাদা কোনো নীতি অনুসরণ করে না।
সূত্র: আল-জাজিরা
বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন ঘটছে। একমেরুকেন্দ্রিক যুগ শেষের পথে। উদীয়মান এক বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা সামনে আসছে। এখানে একটি বা দুটি শক্তি নয়, বরং কয়েকটি শক্তির কেন্দ্র বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে প্রভাব বিস্তার করছে।
১ দিন আগে১৯৭২ সালে জাকসু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮ বার নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯২ সালে সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
২ দিন আগেজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে আজ। ১৯৯২ সালের পর এটাই প্রথম জাকসু নির্বাচন। গত ৩৩ বছর এই নির্বাচন হয়নি। তাই আজ মনে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সেই লাইন— তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি।
২ দিন আগেইতিহাস বলছে, বিপ্লবের নেপথ্যে থাকে কোনো মহৎ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অভীপ্সা। আর সেই লড়াইয়ে পুরোভাগে নেতৃত্ব দেন বিদ্রোহী স্পার্টাকাস। একুশ শতকের অভ্যুত্থানের কোনো একক নায়ক নেই। কোনো একটি পক্ষ নেই, এমনকি কোনো সুপরিকল্পনাও হয়তো থাকে না।
৩ দিন আগে