leadT1ad

আজ মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

পাবনা মানসিক হাসপাতাল: টাকা দিলেই অবাধ প্রবেশ, ‘পাগলদের’ নিয়ে ভিডিও বানাচ্ছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটরেরা

সরকারিভাবে তৈরি দেশের প্রথম মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র পাবনা মানসিক হাসপাতাল। সাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত হাসপাতালটিতে বিনোদনকেন্দ্রের মতো অবাধে ঢুকছেন দর্শনার্থীরা, স্পর্শকাতর রোগীদের উত্যক্ত করে অপমানজনক ভিডিও ছাড়ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে সংবেদনশীল রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাও। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের আগে বিষয়টি নিয়ে ঢাকা স্ট্রিম-এর কাছে উদ্বেগ জানিয়েছেন রোগীর স্বজন, সচেতন নাগরিক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

স্ট্রিম সংবাদদাতা
স্ট্রিম সংবাদদাতা
পাবনা
স্ট্রিম গ্রাফিক

পাবনা মানসিক হাসপাতালের প্রবেশপথেই চোখে পড়ে বড় সাইনবোর্ড। তাতে লেখা সতর্কবাণী, ‘মানসিক রোগীদের সংবেদনশীল চিকিৎসা ও গোপনীয়তার স্বার্থে হাসপাতালে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।’ তারপরও হাসপাতালে অভ্যন্তরীণ আবাসিক ওয়ার্ডে ধারণ করা বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে, রোগীদের সঙ্গে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অদ্ভূত অঙ্গভঙ্গি, সিগারেট আদান-প্রদান আর রোগীদের উত্যক্ত করার দৃশ্য।

এতে রোগীর ব্যক্তিগত চিকিৎসার গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানান, সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার আশঙ্কা আছে এই রোগীদের।

এসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় বিব্রত হচ্ছেন রোগীর স্বজনেরাও। কয়েকজন স্বজন জানিয়েছেন, মানসিক রোগীদের হাসপাতালেই যদি এমন অমর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা হয়, তাহলে স্বস্তি মিলবে কোথায়?

প্রশ্ন উঠছে, নিষেধাজ্ঞার পরও কীভাবে রোগীদের সংস্পর্শে আসেন বহিরাগতরা? হাসপাতালের প্রবেশ পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপত্তা পেরিয়ে কীভাবে দিনের পর দিন ঘটছে এমন কাণ্ড?

সম্প্রতি এমন কিছু ভিডিও চিত্র নজরে আসার পর বিষয়টি অনুসন্ধান করেছে ঢাকা স্ট্রিম। বেরিয়ে এসেছে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নিরপত্তাকর্মীদের ‘দর্শনার্থী বাণিজ্যের’ চিত্র।

আনসার সদস্যদের ‘দর্শনার্থী প্রবেশ বাণিজ্য’

গত ২৮ সেপ্টেম্বর দর্শনার্থী সেজে পাবনা মানসিক হাসপাতালে উপস্থিত হন স্ট্রিম সংবাদদাতা। প্রবেশপথে পাহারায় থাকা আনসার সদস্যদের কাছে ভেতরে ঢোকার অনুরোধ জানাতেই, কোনো রাখঢাক ছাড়াই শুরু করে দেন-দরবার। এক পর্যায়ে ‍১০০ টাকার বিনিময়ে আবাসিক রোগীদের ওয়ার্ডে ঘুরে দেখার সুযোগ মেলে। প্রবেশ নির্বিঘ্ন করতে আনসার সদস্য এনামুল নিজেই দেখিয়ে দেন পথ।

ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, একইভাবে আনসার সদস্যদের টাকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছেন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। ‘চিড়িয়াখানার বন্দি প্রাণী’ দেখার মতো রোগীদের কক্ষের সামনের বারান্দাজুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন দর্শনার্থীরা। কেউ রোগীদের উচ্চস্বরে ডাকছেন, টিটকারি করছেন, কেউবা ঘরে বন্দি রোগীদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় মেতেছেন। উৎসুক দর্শনার্থীদের হাঁকডাকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন কিছু রোগী। দর্শনার্থীদের পাশাপাশি এসেছেন ইউটিউবার, টিকটকার, কনটেন্ট ক্রিয়েটররাও। রোগীদের গায়ে হাত দিয়ে, আপত্তিকর প্রশ্ন করে তৈরি করছেন ভিডিও।

পাবনা মানসিক হাসপাতালে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী। স্ট্রিম ছবি
পাবনা মানসিক হাসপাতালে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী। স্ট্রিম ছবি

এসব প্রমাণসহ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পেশাগত পরিচয়ে গত ৬ অক্টোবর মানসিক হাসপাতালে উপস্থিত হন এই প্রতিবেদক। এবারও ভেতরে ঢুকেই দেখা মেলে কয়েকটি দলে আসা অন্তত শতাধিক দর্শনার্থীর। সাংবাদিক দেখে ছুটে আসেন আনসার সদস্যরাও। কীভাবে এত দর্শনার্থী ভেতরে ঢুকলেন– এমন প্রশ্নে এলোমেলো উত্তর দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেন তাঁরা। পাওয়া গেল আগেরবার টাকা নেওয়া আনসার সদস্য এনামুলকেই। টাকা নিয়ে দর্শনার্থীদের প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বেমালুম অস্বীকার করলেন তিনি। ঘটনার ভিডিও প্রমাণ আছে জানানোর পরও অস্বীকার করে দ্রুত সটকে পড়লেন।

এ সময় কথা হয় বিশেষায়িত হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৫০ সদস্যের প্লাটুন কমান্ডার আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনিও অভিযুক্ত আনসার সদস্যদের পক্ষ নিয়ে প্রবেশপথে টাকা নেওয়ার কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে আমরা প্রতিদিন প্রবেশপথে নাম তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ভেতরে ঢুকতে দিই। টাকা নিয়ে লোক ঢোকানোর কোনো সুযোগ নেই। ওয়ার্ডে টহল দেওয়া হয়। অনুমতি ছাড়া বহিরাগত কেউ ঢুকলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ তবে ভেতরে অসংখ্য দর্শনার্থী কীভাবে এলো– জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ঢুকেছে বলে দাবি করেন তিনি।

দায় নিতে রাজি নয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও

বিনোদনের উদ্দেশ্যে মানসিক রোগী দেখতে আসা অমানবিক ও অরুচিকর মানসিকতার পরিচয় বলে মন্তব্য করেন পাবনা মানসিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এহিয়া কামাল। বহিরাগত প্রবেশের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি দোহাই দিলেন জনবল সংকটের। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাবনা মানসিক হাসপাতালটি ৫০০ শয্যার হলেও তা চলছে ২৫০ শয্যার জনবল কাঠামো দিয়ে। এর মধ্যেও হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদ সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি শূন্য।

পাবনা মানসিক হাসপাতালে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড়। স্ট্রিম ছবি
পাবনা মানসিক হাসপাতালে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিড়। স্ট্রিম ছবি

এহিয়া কামাল বলেন, ‘আমাদের বাইরের নিরাপত্তার বিষয়টি আনসার সদস্যরা দেখেন। তাঁদের এমন (টাকা নিয়ে প্রবেশ) কাজে আমরা শোকজ নোটিশও করেছি। কিন্তু স্থানীয় চাপ ও অসাধু কর্মীরা এসব কাজে জড়িত। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’ পাশাপাশি, বিনোদনের উদ্দেশ্যে মানসিক রোগীদের দেখতে না আসার অনুরোধও জানান তিনি।

দীর্ঘায়িত হতে পারে অসুস্থতা

হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, দর্শনীয় বিবেচনায় বহিরাগতদের উপহাস মানসিক রোগীদের উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদের আনন্দিত হতে দেখে বাড়ে তাদের বিষন্নতা; স্নায়বিক চাপে অসুস্থতা বেড়ে যায়।

হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক নাইম আক্তার আব্বাসী বলেন, ‘মানসিক হাসপাতালে দর্শনার্থীদের প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। দর্শনার্থীরা রোগীদের সঙ্গে দুষ্টামি করেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের লুকিয়ে তাদের বিড়ি-সিগারেট দেন, গান গাওয়ান, লাইভ ভিডিও করেন। এসব চরম অমানবিক আচরণ। পাশাপাশি রোগীদের জন্যও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এতে তাদের অসুস্থতা দীর্ঘায়িত হতে পারে।’

বিব্রত রোগীর স্বজনেরা

মানসিক হাসপাতালে ভর্তির জন্য কুয়াকাটা থেকে ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন আবুল কালাম হাওলাদার। দর্শনার্থীরা রোগীদের উত্যক্ত করছে দেখে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘যে পরিবারে একজন মানসিক রোগী আছে, তারাই বুঝতে পারে এর কষ্ট কতটা। সবাই চায় তাঁর সন্তান সুস্থ হয়ে উঠুক।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে কালাম হাওলাদার বলেন, ‘এলাকায় লোকজনের বিদ্রুপের কারণে ছেলেকে নিয়ে শান্তিতে থাকার উপায় নাই। এখন এই হাসপাতালের ভেতরেও দেখছি বাইরের লোকদের আয়োজন করে রোগীদের নিয়ে তামাশার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা কি কখনো ভাবে না, এমন অবস্থা তাদেরও হতে পারে!’

পাবনা মানসিক হাসপাতালে অসুস্থ ছেলেকে দেখেতে এসেছেন একজন বাবা। স্ট্রিম ছবি
পাবনা মানসিক হাসপাতালে অসুস্থ ছেলেকে দেখেতে এসেছেন একজন বাবা। স্ট্রিম ছবি

বগুড়া থেকে পাবনায় ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছিলেন রাসেল হাসান। খেলার ফাঁকে মানসিক হাসপাতাল ঘুরতে আসেন বন্ধুদের নিয়ে। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন থেকে মানসিক হাসপাতালে ঢোকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ভেতরে এসে রোগীদের সঙ্গে কথা বললাম। অনেকেই দেখি বাদাম, বিড়ি-সিগারেট দিচ্ছে, হাসি ঠাট্টা করছে। এটা ঠিক না। ভেতরে এসে বুঝতে পারছি, এভাবে অসহায় মানুষদের দেখতে আসা অন্যায় হয়েছে।’

হাসপাতালে আসা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জানা-অজানা কারণে মন ও আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন রোগীরা। অথচ তাদের অসুস্থতাকেই দিনের পর দিন বিনোদন হিসেবে উপভোগ করে চলেছেন তথাকথিত সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষেরা। সুরক্ষিত হাসপাতালে মানসিক রোগীদের সঙ্গে এমন অমর্যাদাপূর্ণ আচরণ হলে, কোথায় গেলে স্বস্তি মিলবে তাদের?’

নীতিমালা ও কমিটি থাকলেও কার্যক্রম নেই

মানসিক রোগীদের সুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তায় ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য আইনে নীতিমালা করা হয়েছে। এ ছাড়া মানসিক রোগীদের চিকিৎসা ও অবহেলা সংক্রান্ত অভিযোগ প্রতিকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা মানসিক স্বাস্থ্য রিভিউ ও মনিটরিং কমিটিকে। তবে এর প্রয়োগ কার্যক্রম নেই কোথাও।

এসব বিষয় জানিয়ে পাবনা জজ কোর্টের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর ও মানবাধিকার-আইনজীবী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মানসিক রোগীদের সুরক্ষা নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে প্রয়োগ নেই। রোগীদের অবহেলা ও অবমাননা করে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, উপহাসের জন্যও শাস্তির বিধান সুস্পষ্টভাবে নেই। এতে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের অপরাধের প্রতিকার মিলছে না। আর আমার জানা মতে, দেশের কোথাও জেলা মানসিক স্বাস্থ্য রিভিউ ও মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম নেই।’

ভিডিও করছেন একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
ভিডিও করছেন একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

প্রচলিত মানসিক স্বাস্থ্য আইনের ৫ এর ১ ধারায় জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও জেলা সিভিল সার্জনকে সদস্যসচিব করে জেলা মানসিক স্বাস্থ্য রিভিউ ও মনিটরিং কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। মানসিক রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত অবহেলা ও অভিযোগের বিষয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এ কমিটিকে অভিযোগ দিলে তারা ব্যবস্থা নেবেন। অথচ স্বয়ং সদস্যসচিবই জানেন না এমন কমিটির অস্তিত্বের কথা।

স্বাস্থ্য রিভিউ কমিটির বিষয়ে পাবনা জেলা সিভিল সার্জন আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এ ধরনের কমিটির কথা আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। যেহেতু আইনে আছে, আমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে দ্রুতই এর কার্যক্রম শুরু করতে পদক্ষেপ নেব।’

মানবাধিকার ও আইনের লঙ্ঘন

যেকোনো রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রকাশ মানবাধিকার লঙ্ঘন জানিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন যুগোপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

মানসিক হাসপাতালকে চিড়িয়াখানার মতো বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার অমানবিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেন পাবনার সাবেক পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও সমাজকর্মী ডা. রামদুলাল ভৌমিক। তিনি বলেন, ‘মানসিক রোগীরা আমাদের মতোই মানুষ। কিন্তু তথাকথিত সুস্থ সমাজের যেসব মানুষ মানসিক রোগীদের দেখে আনন্দ খোঁজেন, তাঁদের মানসিকতাই তো বিকৃত। যারা এই অসহায় মানুষদের নিয়ে বাণিজ্য করছেন, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা উচিত।’

রোগীদের ভিডিও করছেন একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
রোগীদের ভিডিও করছেন একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

ডা. রামদুলাল ভৌমিক বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া ভিডিও রোগীর পরিবারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। মানসিক রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর এসব ভিডিওর কারণে সামাজিকভাবে হেয় হতে পারেন। এমনকি তাদের পুনরায় আরও জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। এর দায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য হচ্ছে তার ব্যক্তিগত তথ্য, যেটি আইনগতভাবে গোপন রাখা প্রত্যেকের দায়িত্ব। যদি কেউ সেই গোপনীয়তা ভঙ্গ করে, আদালত ছাড়া তিনি যে-ই হোন না কেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনা যায়। ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে যখন রোগীর চিকিৎসা হয়, রোগী ও তাঁর লোকেরা রোগ সংক্রান্ত সব তথ্য দিয়ে থাকে এবং তা ফাইলে লেখা থাকে। ফলে বাইরের লোক যদি সেখানে যায় এবং তা দেখার সুযোগ পায়, তাহলে সেটি আইনতভাবে গ্রহণযোগ্য না।’

যেভাবে চলছে মানসিক হাসপাতাল

১৯৫৭ সালে পাবনা শহর থেকে তিন মাইল দূরে হিমায়েতপুর ইউনিয়নে তৎকালীন শীতলাই জমিদারবাড়িতে উদ্যোগ নেওয়া হয় বিশেষায়িত এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার। তখনকার পাবনা জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ হোসেন গাঙ্গুলী পাবনার মানসিক হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করেন। ১১১ দশমিক ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়; শেষ হয় ১৯৫৯ সালে। প্রথমে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ছিল ৬০। ১৯৬৬ সালে পরে ১৫০ ও পরে ২০০ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত করে সরকার। শয্যা অনুযায়ী শুধু ভর্তি ৫০০ রোগীই নয়, প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় হাসপাতালের বহির্বিভাগে।

এদিকে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে বর্তমানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন মাত্র চারজন। পদ না থাকায় তাঁদের মধ্যে দুজন আবার সংযুক্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু চিকিৎসক নন, হাসপাতালে পুরুষ নার্সের সংকট রয়েছে। সাইকোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অনেক পদও ফাঁকা। চিকিৎসক, নার্স ছাড়াও হাসপাতালের উচ্চতর পদের অনেকগুলো শূন্য। এতে বিদ্যমান সেবার মানও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

মোবাইলে রোগীর কথা রেকর্ড করছেন একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
মোবাইলে রোগীর কথা রেকর্ড করছেন একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

হাসপাতালের চিকিৎসক ও ভর্তি রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনবল সংকটের কারণে যেসব মানসিক রোগী নিজেদের প্রাথমিক যত্ন নিতেও অক্ষম, তাঁদের ভর্তি করা সম্ভব হয় না। এখানে কোনো কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি দেওয়া হয় না। নেই শিশুদের চিকিৎসার জন্য ইনডোর সুবিধা। আবার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম সমস্যা নিয়ে আসা শিশুদের জন্য নেই অকুপেশনাল থেরাপি বা স্পিচ থেরাপির ব্যবস্থা।

জনবলের অভাবে চালু হচ্ছে না হাসপাতালের বৃত্তিমূলক বিভাগ (পুনর্বাসন, থেরাপি, এবং অন্যান্য সহায়ক পরিষেবা দানকারী বিভাগ)। বন্ধ রয়েছে রেডিওলজি সেবা। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট না থাকায় ছোটখাটো পরীক্ষার জন্যও রোগীদের বাইরে ছুটতে হচ্ছে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালকে ১০০০ শয্যার আন্তর্জাতিক মানের ‘মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এহিয়া কামাল বলেন, ‘সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কয়েক বছর লাগবে। এর আগে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মানোন্নয়নে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রথমেই আসবে বাজেট বরাদ্দ ও জনবল বাড়ানোর বিষয়টি। অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য এর জনবল কাঠামো পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তবে সংযুক্তির মাধ্যমে উচ্চতর পদ বাড়ানো সম্ভব। নিম্নতর পদ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বাড়ানো যায়।’ বিষয়টি সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

সমাধানের পথ কী

মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় দেশের প্রথম সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালটি এক সময় পরিচিতি ছিল ‘পাগলা গারদ’ নামে। চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতির ফলে সেখানে রোগীদের আগের মতো হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় না বটে। তবে এখনও বন্ধ হয়নি মানসিক রোগীদের অবহেলা, অবজ্ঞা ও উপহাস। পরিত্যক্ত ভবন, প্রয়োজনীয় জনবল, ওষুধ সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই নতুন উপদ্রব হয়ে দেখা দিয়েছে বিনোদনকেন্দ্রের মতো হাসপাতালটিতে দর্শনার্থী ও ভিডিও কনটেন্ট নির্মাতাদের অবাধ যাতায়াত।

সম্প্রতি ফেসবুকে মিজান অফিসিয়াল (Mizan Official 2.0) নামে একটি পেজে থেকে পাবনা মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের ভেতরে রোগীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে তৈরি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। পেজের তথ্য অনুযায়ী এর পরিচালক পাবনার বাসিন্দা। হাসপাতালের ভেতরে ভিডিও করা ও গোপনীতা লঙ্ঘনের বিষযে জানতে আজ শুক্রবার (১০ অক্টোবর) দুপুরে ওই পেজের মেসেঞ্জারে একাধিক মেসেজ দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

হাসপাতালের ভেতরে একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি মানসিক হাসপাতালটি ঘুরে আসা এক কনটেন্ট ক্রিয়েটর বলেন, ‘ভিউ এবং ট্রেন্ড ফলো করতে গিয়ে আসলে মানসিক রোগীদের যে অবমূল্যায়ন হচ্ছে সেটা বুঝতে পারিনি। মানসিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ বিষয়গুলো সাধারণ মানুষকে বোঝানোর দায় আছে। বাধাও তো দেয়নি। আমি আমার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থী।’

এই ধরনের উপদ্রব রোধে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে রোগীদের গোপনীয়তা সুরক্ষায় আইন আছে। তবে বাংলাদেশে কিছু নীতিমালা থাকলেও সুস্পষ্ট কোনো আইন নেই। এর মধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) কোড অব মেডিকেল এথিকসে লেখা রয়েছে, ‘আমি রোগীদের স্বাতন্ত্র্য এবং মর্যাদাকে সম্মান রক্ষা করব’ এবং ‘রোগীর মৃত্যু হলেও তাঁর গোপন তথ্য কোনোরকম প্রকাশ করব না।’ এই ‘এথিকস’ লঙ্ঘিত হলে অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলের মতো ব্যবস্থা নিতে পারে সংগঠনটি।

এ ছাড়া অন্যান্য আইন দিয়ে রোগীর গোপনীতার সুরক্ষা দেওয়া যেতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎক লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘মানসিক রোগীদের সুস্থতার জন্যই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে যদি তাদের নিয়ে কেউ ভিডিও করে, উত্যক্ত করে বা নানাভাবে বিনোদনের বস্তুতে পরিণত করে, এটি নিঃসন্দেহ অপরাধ। এর সঙ্গে যারা যুক্ত, সে ইউটিউবার হোক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা কর্মচারী হোক, সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত। এটি মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর ব্যাপার। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকারকে যেকোনোভাবে ভঙ্গ করা হলে, এটি মানুষের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সামিল।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত