চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার সরকারি প্রক্রিয়াটি বড় ধরনের আইনি বাধার মুখে পড়েছে।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) এ নিয়ে জারি করা রুলের ওপর শুনানি শেষে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ দ্বিধাবিভক্ত রায় দিয়েছেন।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি চলমান চুক্তি প্রক্রিয়াকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করলেও কনিষ্ঠ বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করে প্রক্রিয়াটিকে ‘বৈধ’ বলে অভিমত দিয়েছেন। দুই বিচারপতির দুই রকম রায়ের ফলে নিয়ম অনুযায়ী বিষয়টি এখন নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। তিনি তৃতীয় একটি বেঞ্চ গঠন করে দেবেন, সেখানেই নির্ধারিত হবে এনসিটির চূড়ান্ত ভাগ্য।
বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। আদালতে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফাতেমা নজীব রুল যথাযথ ঘোষণা করে বলেন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়াটি আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ও অবৈধ। অন্যদিকে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ার রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। আদালতে রিটকারী পক্ষের শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
রায়ের তাৎপর্য ও আইনি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল একে দেশবাসীর বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। আদালত চত্বরে তিনি বলেন, আমরা মনে করি এই রায় জাতির জন্য একটি বিজয়। দীর্ঘদিন শুনানির পর জ্যেষ্ঠ বিচারপতি রুলটি অ্যাবসোলিউট করেছেন। অর্থাৎ বর্তমান সরকার বা বন্দর কর্তৃপক্ষ যা করতে চাচ্ছিল, জ্যেষ্ঠ বিচারপতির রায়ে তা অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। এনসিটি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
একই বেঞ্চে দুই বিচারপতির ভিন্নমতের আইনি কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই আইনজীবী জানান, কনিষ্ঠ বিচারপতি মূলত তিনটি বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে, রিটকারীদের মামলা করার অধিকার বা ‘লোকাস স্ট্যান্ডি’ নেই এবং রিটটি অপরিণত বা ‘প্রিম্যাচিউর’। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা ও আইনের যে ব্যত্যয়ের কথা রিটকারীরা তুলে ধরেছিলেন, কনিষ্ঠ বিচারপতি তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, একই বিষয়ে বর্তমান অপারেটরদের করা একটি রিট এর আগে খারিজ হয়েছিল। এখন নিয়ম অনুযায়ী বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। তিনি তৃতীয় একটি বেঞ্চ গঠন করে দেবেন এবং সেখানে পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে চূড়ান্ত রায় আসবে।
তৃতীয় বেঞ্চে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকার বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে এই চুক্তি প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, যেহেতু বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি প্রক্রিয়াটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন, তাই বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারের এই প্রজেক্ট এগিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না। তিনি মনে করেন, বিষয়টি যেহেতু এখনো বিচারাধীন এবং একজন বিচারপতি এটিকে অবৈধ বলেছেন, তাই এই মুহূর্তে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হবে অনফেয়ার বা অনুচিত।
এদিকে শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মন্তব্য করেছিলেন যে, জনস্বার্থের কথা বলা হলেও এই রিটের পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল বা হুলো বিড়াল থাকতে পারে।
সাংবাদিকরা এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কায়সার কামাল বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল হুলো বিড়াল নাকি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সময়ের কালো বিড়ালের কথা বুঝিয়েছেন, তার ব্যাখ্যা তিনিই দিতে পারবেন। যারা বিড়াল নিয়ে ডিল করেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা জনস্বার্থে এবং সৎ উদ্দেশ্যেই মামলাটি করেছি। অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রের অনেক খবর রাখেন, তাই হয়তো তিনি বিড়াল প্রসঙ্গ এনেছেন। তবে আমরা আইনের বাইরে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে চাই না।
উল্লেখ্য, উন্মুক্ত দরপত্র বা প্রতিযোগিতামূলক বিডিং ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন গত জুলাইয়ে রিটটি করেন। রিটে নৌসচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়।
গত ২৬ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে ‘নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন যুক্ত করে জনস্বার্থে এই রিট দায়ের করা হয়েছিল।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৩০ জুলাই বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং এনসিটি পরিচালনায় ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না—তা জানতে চাওয়া হয়। সেই রুলের ওপর দীর্ঘ শুনানি শেষে গত ২৫ নভেম্বর আদালত রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করেছিলেন।