leadT1ad

কপ৩০ এর অষ্টম দিনের আলোচনা

বেলেমে এআই বিতর্ক: সমাধান নাকি নতুন সংকট

স্ট্রিম গ্রাফিক

কপ৩০-এর অষ্টম দিনে বেলেমে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হলেও অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান জানালেও আলোচনার অগ্রগতি ধীর। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন, জীবাশ্ম জ্বালানির রূপান্তর, জেন্ডার ও ন্যায্যতার বিভাজন দূর করতে এখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ জরুরি। কারিগরি পর্যায়ের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগ, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল এবং বৈশ্বিক অর্থায়ন কাঠামোয় অচলাবস্থা দূর করার দায়িত্ব এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে।

জ্যামাইকা হারিকেন মেলিসার ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতি তুলে ধরে ধনী দেশগুলোর নির্গমন কমানো এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিউবা, মরিশাসসহ ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি এখন তাদের নিত্যদিনের বাস্তবতা; এটি মোকাবিলা করা ‘নৈতিক কর্তব্য’। জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েল ও ব্রাজিলের নেতারা সতর্ক করেছেন, উষ্ণায়ন বাড়ার প্রতিটি অতিরিক্ত অংশ মানবসমাজ ও অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনছে।

এদিকে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্ষতি–ক্ষয়ক্ষতির তহবিল নিয়ে কিছু অগ্রগতি হলেও কার্বন বাজার, জেন্ডার-আলোচনা, জাস্ট ট্রানজিশন ও অভিযোজনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো এখনও আটকে আছে। অর্থায়ন, স্বচ্ছতা, বাণিজ্য ও বর্তমান এনডিসিগুলোর দুর্বলতা; এগুলোতে অগ্রগতি খুবই কম। ব্রাজিলের কপ প্রেসিডেন্ট এনডিসি শক্তিশালী করার রোডম্যাপ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন।

কপ৩০-এ দক্ষিণ কোরিয়ার ঘোষণা দৃষ্টি কাড়ে: ২০৪০ সালের মধ্যে তারা সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করবে এবং ‘পাওয়ারিং পাস্ট কোল অ্যালায়েন্স’-এ যোগ দেবে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারকের এ সিদ্ধান্ত অস্ট্রেলিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া বছরে প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলারের কয়লা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কোরিয়ার সিদ্ধান্ত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শক্তিশালী দেশ অস্ট্রেলিয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি। তাদের বিশ্লেষণ, আগামী পাঁচ বছরে অস্ট্রেলিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানির মূল্য অর্ধেকে নেমে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, অস্ট্রেলিয়ার উচিত গ্রিন টেকনোলজি ব্যবহার করে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে জোর দেওয়া। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের ৮২ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে।

অন্যদিকে জাস্ট ট্রানজিশন নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সৌদি আরবের বাধা অব্যাহত। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো একসঙ্গে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের শর্ত ও পদ্ধতি নিয়ে নতুন প্রতিবেদন প্রস্তাব করলেও সৌদি আরব ও আফ্রিকান গ্রুপ তথ্য-উপাত্ত অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছে। এ অবস্থায় জীবাশ্ম জ্বালানি অ-প্রসারণ চুক্তির সদস্য কলম্বিয়া আগামী এপ্রিলে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে।

এদিকে ২০০টিরও বেশি মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান সাইমন স্টিয়েলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ওপর রাষ্টীয় দমন-পীড়ন উৎসাহিত করার অভিযোগ তুলেছে। খোলা চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, এমন আচরণ মানবাধিকার রক্ষাকারী ও পরিবেশকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলছে।

কপ৩০-এ শিল্প কৃষি খাতের শক্তিশালী উপস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। সর্বশেষ মূল্যায়ন বলছে, বন উজাড়, গবাদি পশু পালন ও শিল্প খাদ্য উৎপাদনের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রায় ৩০০ লবিস্ট এবারের সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন; যা গত বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে বহু লবিস্ট সরকারি প্রতিনিধি দলের অংশ, যাদের আলোচনায় বিশেষ প্রবেশাধিকার রয়েছে।

গবেষকেরা সতর্ক করেছেন, গবাদি পশু পালন, শিল্প খাদ্য উৎপাদন ও কীটনাশক ব্যবহারে পরিবর্তন না করলে প্যারিস চুক্তির ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। আমাজনের বন উজাড়ের প্রধান কারণ, পশুপালন ও পশুখাদ্য শিল্প; যা জমি পরিষ্কার, পানি সংকট ও জীববৈচিত্র্যহানি বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করপোরেট লবি নিয়ন্ত্রণ না করলে ন্যায্য ও টেকসই খাদ্যব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর সবচেয়ে বড় উদ্বেগ জলবায়ু অর্থায়ন। বাংলাদেশের হেড অব ডেলিগেশন ফরিদা আখতার এটিকে ‘বাঁচা–মরার প্রশ্ন’ হিসেবে বর্ণনা করে সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের কাছে অর্থ পৌঁছানোর দাবি তুলেছেন। গত বছর ঘোষিত ৩০০ বিলিয়ন ডলার বাস্তবায়নে ধীরগতি ও ঋণনির্ভরতা হতাশা বাড়িয়েছে।

সাইমন স্টিয়েলের ভাষায়, ‘ইচ্ছা আছে, কিন্তু গতি নেই’। চূড়ান্ত রূপরেখায় ‘ফেজ আউট’ শব্দটি থাকবে কি না, তা নিয়েও তীব্র মতভেদ। জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টের সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়া নিয়েও এই বিতর্কের বড় কারণ।

সম্মেলনের বাইরে নাগরিক সমাজের কর্মীরা বেলেম অ্যাকশন মেকানিজম (বিএএম)-এর পক্ষে সমর্থন জোরদার করছেন। জাস্ট ট্রানজিশন শ্রমিক আন্দোলন থেকে উঠে আসলেও এখন তা জ্বালানি, খনিজ, কৃষি এবং সামনের সারির ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকেও অন্তর্ভুক্ত করছে। প্যারিস চুক্তির প্রস্তাবনায় জাস্ট ট্রানজিশনের উল্লেখ থাকলেও বাধ্যবাধকতা নেই। বিএএমের সমর্থকদের ধারণা, এ উদ্যোগ দেশগুলোকে অগ্রগতি ট্র্যাক করা, সমন্বয় বাড়ানো, প্রযুক্তি ও সেরা অনুশীলন ভাগ করা এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে বাস্তবায়নে সহায়তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

সম্মেলনের ব্লু জোনে আদিবাসী প্রতিনিধিদের উপস্থিতি দৃশ্যমান, কিন্তু আলোচনায় তাদের ভূমিকা সীমিত; তারা প্রায়ই পর্যবেক্ষক মাত্র। তাদের দাবি, আমাজন রক্ষা, জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ এবং সাংস্কৃতিক একরূপতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। কিন্তু ক্ষমতাধর প্রতিনিধিদলের ভিড়ে তারা এক প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। রোববার ব্রাজিলে আদিবাসী নেত্রী ভিসেন্তে ফার্নান্দেস ভিলহালভার গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু, ভূমি ও পরিবেশ রক্ষাকারীদের ওপর সহিংসতার দীর্ঘদিনের উদ্বেগজনক বাস্তবতা আবার মনে করিয়ে দিল।

কপ৩০-এ এআই নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিপুল বিদ্যুৎ ব্যবহার ও উচ্চ নির্গমনের জন্য সমালোচিত হলেও জাতিসংঘ ও ব্রাজিল নতুন এআই ক্লাইমেট ইনস্টিটিউট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে; যা উন্নয়নশীল দেশকে নির্গমন কমানো, পরিবেশ সমস্যার সমাধান ও কৃষি, পরিবহন ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে সাহায্য করবে।

গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, এআই ব্যবহার করে আগামী দশকে ৩ দশমিক ২ থেকে ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো সম্ভব। তবে সমালোচকরা বলছেন, জেনারেটিভ এআই–এর বিস্তারে ডেটা সেন্টারের বিদ্যুৎ ও পানি খরচ বাড়ছে।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষণ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রবৃদ্ধি চলতে থাকলে ২০৩০ সালে অতিরিক্ত ৪৪ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হবে। তাদের মতে, ‘ভালোর জন্য এআই’ উদ্যোগ কিছু সুফল দিলেও এটি মূলত মুনাফাভিত্তিক শিল্পেরই অংশ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগের কোনো বিকল্প নয়।

লেখক: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।

Ad 300x250

সম্পর্কিত