leadT1ad

ভূমিকম্প: আমাদের ভয়ের প্রকৃত জায়গাটি আসলে কোথায়?

মো. শফিক-উর রহমান
মো. শফিক-উর রহমান

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯: ২৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রকৃতি তার নিজস্ব ভাষায় সতর্কবার্তা পাঠায়, কিন্তু মানুষ কি সেই ভাষা বুঝতে পারছে? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় যেভাবে ঘন ঘন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে, তা আমাদের অস্তিত্বের প্রতি এক বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছুড়ে দিয়েছে। গতকাল যে ভূমিকম্পটি দেশজুড়ে অনুভূত হলো, তা ছিল গত ১০০ বছরের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী। আতঙ্কের রেশ কাটতে না কাটতেই আজ আবারও ঢাকাবাসী কম্পন অনুভব করল, যার উৎপত্তিস্থল ছিল খোদ ঢাকার বাড্ডা এলাকায়। ভূতাত্ত্বিক ও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন যে, বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আসন্ন মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত? কিংবা আমাদের ভয়ের প্রকৃত জায়গাটি আসলে কোথায়?

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও এর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে মানুষের তৈরি অবকাঠামোর ওপর। আমাদের সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গাটি হলো আমাদের অপরিকল্পিত ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো। গ্রামের দিকে বা যেখানে ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। কিন্তু ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলো, যেখানে মানুষের ঘনত্ব অত্যধিক এবং ভবনগুলো পরিকল্পনার তোয়াক্কা না করে গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানেই বিপদ ওত পেতে আছে।

নগর পরিকল্পনার নিয়ম-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যত্রতত্র উচ্চ ভবন তৈরি করা হয়েছে। একটি তিন বা চার তলা ভবনের চেয়ে ১৩ বা ১৫ তলা ভবনের ঝুঁকি স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি। কিন্তু ভয়ের কারণ কেবল উচ্চতা নয়; ভয়ের কারণ হলো ভবনের মধ্যবর্তী দূরত্বের অভাব। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ভবনের চারপাশে নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা ছাড়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে দেখা যায় একটি ভবনের গা ঘেঁষে আরেকটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। বড় মাত্রার ভূমিকম্পে যখন এই বিশালাকার ভবনগুলো দুলতে শুরু করবে, তখন একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, যা কল্পনা করাও দুষ্কর।

আমাদের ভয়ের আরেকটি বড় কারণ হলো নির্মাণ ও আবাসন শিল্পে ‘সেফটি স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত না করা। দালানকোঠা নির্মাণের সময় সেফটি স্ট্যান্ডার্ডের সাথে কম্প্রোমাইজ করে যেনতেনভাবে কাজ শেষ করার এক অশুভ প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে। জাপানের মতো দেশগুলো ভূমিকম্প সহনশীল প্রযুক্তি ব্যবহার করে আকাশচুম্বী অট্টালিকা বানাচ্ছে, আর আমরা সাধারণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হিমশিম খাচ্ছি। সামান্য কম্পনেই দেখা যায় ভবনের রেলিং ভেঙে পড়ছে কিংবা গ্লাস খসে পড়ছে। রেলিংটি কীভাবে লাগানো হয়েছিল যে তা সামান্য ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারল না? কিংবা গ্লাস ফিটিংস ঠিকমতো চেক করা হয়েছিল কি না—এসব প্রশ্ন আমাদের নির্মাণকাজের গুণগত মানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। পরিসংখ্যান না থাকলেও খালি চোখে এটা স্পষ্ট যে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ সেগুলোতে পর্যাপ্ত খালি জায়গা রাখা হয়নি এবং ভূমিকম্প সহনশীল প্রযুক্তির ব্যবহার নেই বললেই চলে।

এখন একটি মনস্তাত্ত্বিক ও আর্থসামাজিক প্রশ্ন সামনে আসে—এত ভয়াবহ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন সতর্ক হচ্ছে না? কেন মানুষ জেনে-শুনে মৃত্যুফাঁদে বসবাস করছে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের ‘মার্কেট ইকোনমি’ বা বাজার অর্থনীতির নিষ্ঠুর বাস্তবতায়। জীবনের চেয়ে এখানে জীবিকার তাগিদ বড়। ১০০ বছরের পুরনো জরাজীর্ণ বাড়ি, যার ছাদ খসে পড়ছে, সেখানেও মানুষ বসবাস করছে। কারণ থাকার জায়গার তীব্র সংকট এবং আকাশচুম্বী বাসা ভাড়া। এমনকি সরকারি কোয়ার্টার বা ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করার পরেও মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে থাকছে।

এই পরিস্থিতিকে রাস্তায় চলাচলকারী ফিটনেসবিহীন বাসের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যে লক্কড়-ঝক্কড় বাসটি ৫-৭ বছর আগেই ডাম্পিং স্টেশনে ফেলে দেওয়া উচিত ছিল, সেটি দিব্যি রাস্তায় চলছে এবং যাত্রীরাও তাতে চড়ছে। কারণ, বাসটি চললে মালিকের টাকা আসে, আর যাত্রীর প্রয়োজন গন্তব্যে পৌঁছানো। ঠিক একইভাবে, একটি ভবন মালিক জানেন তার ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটি ভেঙে ফেলা উচিত। কিন্তু তিনি তা ভাঙছেন না কারণ সেখান থেকে তিনি ভাড়া পাচ্ছেন কিংবা তার নিজের থাকার জায়গা সেটিই। দিনশেষে আমরা জীবনের চেয়ে টাকার মূল্য বা সাময়িক প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। বাংলাদেশে মানুষের জীবনের কি আসলেই সেই মূল্য আছে? ফুটপাতে যে মানুষটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় ঘুমাচ্ছে, তার নিরাপত্তা কোথায়? এই প্রশ্নগুলো আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবেকের দিকে আঙুল তোলে।

তাহলে সমাধান কী? ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো কি অপসারণ করা সম্ভব? তাত্ত্বিকভাবে সরকারের বা রাজউকের উচিত এই ভবনগুলো ভেঙে ফেলা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙতে গেলে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে, আবাসন সংকট চরমে পৌঁছাবে। রাজউক বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কি সেই সক্ষমতা, জনবল বা সততা আছে? আমরা দেখেছি নদীর পাড় দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মীদের হামলার শিকার হতে হয়। সেখানে শহরের ভেতরে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন একটি ছয় তলা ভবন ভাঙা রাজউকের পক্ষে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তারা হয়তো জনবল বা লজিস্টিক সাপোর্টের অজুহাত দেখিয়ে পিছু হটে যাবে।

সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো দুর্যোগ পরবর্তী উদ্ধারকাজ। বড় ধরনের কোনো ডিজাস্টার বা বিপর্যয় ঘটলে তা মোকাবিলা করার সক্ষমতা আমাদের মোটেও নেই। আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অত্যন্ত সাহসী হলেও তাদের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। একটি ১০ তলা বা তার বেশি উচ্চতার ভবনে আগুন লাগলে বা ধসে পড়লে সেখানে পৌঁছানোর মতো পর্যাপ্ত লম্বা মই বা উদ্ধার সরঞ্জাম আমাদের নেই। এয়ারপোর্টের কার্গোতে আগুন লাগার ঘটনা কিংবা বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টে আগুনের ট্র্যাজেডি আমাদের অক্ষমতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বেইলি রোডের ঘটনায় কতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেল! অথচ উন্নত বিশ্বে রেস্টুরেন্টে আগুন লাগলে উদ্ধারব্যবস্থা এত দ্রুত ও কার্যকর হয় যে প্রাণহানি খুব কম ঘটে। আমাদের ক্ষেত্রে উদ্ধার সক্ষমতা একেবারেই অপ্রতুল।

এমতাবস্থায়, হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। আসন্ন মহাদুর্যোগের আশঙ্কা মাথায় রেখে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে মূলত দুটি পর্যায়ে—ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক। ব্যক্তি পর্যায়ে যখনই কেউ কোনো স্থাপনা নির্মাণ করবেন, তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে ভূমিকম্প হলে তার ও তার পরিবারের নিরাপত্তা কী হবে। সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে যেনতেনভাবে ভবন তৈরি না করে, নিয়ম-নীতি মেনে এবং সাধ্যমতো ভূমিকম্প সহনশীল প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। এটি নিজের জীবনের বিনিয়োগ।

অন্যদিকে, দাপ্তরিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দায়িত্বশীলদের ঘুম ভাঙতে হবে। রাজউক ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে তাদের কাজের প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। নতুন ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং পুরনো ভবনগুলোর ক্ষেত্রে নিয়মিত ইন্সপেকশন বা তদারকি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রাতারাতি সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা সম্ভব না হলেও, ধাপে ধাপে এর সমাধান বের করতে হবে এবং উদ্ধার কাজের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ব্যক্তি সচেতনতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কঠোর তদারকি—এই দুয়ের সমন্বয় ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো উত্তরণের পথ খোলা নেই। প্রকৃতি সময় দিচ্ছে, কিন্তু সেই সময় অফুরন্ত নয়।

লেখক: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স এর সহসভাপতি; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত