leadT1ad

২১ ট্রিলিয়ন পেরিয়ে ঋণ: অর্থনীতি কি সতর্কবার্তা গুরুত্ব দিচ্ছে

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের সরকারি ঋণ ২০২৫ সালে ২১ ট্রিলিয়ন টাকার সীমা পেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকেই শুধু একটি সংখ্যা হিসেবে দেখছেন। কিন্তু অর্থনীতির ভেতর থেকে বিষয়টি দেখলে বোঝা যায় এটি আমাদের আর্থিক বাস্তবতার একটি স্পষ্ট বার্তা। রাজস্ব সংগ্রহ যেমন বাড়েনি, উন্নয়ন ব্যয় তেমনই ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটি এমন একটি পর্যায়ে এসেছে যেখানে ঋণ এখন আর শুধু বিকল্প অর্থায়নের উৎস নয়, বরং আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য সচেতনভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজনীয় একটি দায়।

২০২৫ সালে ঋণের পরিমাণ এক বছরে প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। আমরা যদি গত পাঁচ বছরের দিকে তাকাই, দেখব বৈদেশিক ঋণ সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে। এই বৃদ্ধি শুধু বড় প্রকল্পের কারণে নয়, বরং মহামারির পর বাজেট সহায়তার প্রবাহ এবং কিছু অনিবার্য ব্যয়েরও প্রভাব রয়েছে। প্রকল্পগুলো অবশ্যই দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের অদক্ষতা ও ব্যয় বাড়ার ফলে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সুফল সময়মতো মিলছে না। একটি প্রকল্পের রিটার্ন যতদিন বিলম্বিত হয়, ততদিন প্রকল্পটি অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে রাখে।

অন্যদিকে সুদ পরিশোধের হার যেভাবে বাড়ছে সেটিও একটি বড় উদ্বেগ। এখন বছরে এক লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি শুধু সুদ পরিশোধে যাচ্ছে এবং এটি গত বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। সরকারি ব্যয়ের বড় একটি অংশ যদি সুদ পরিশোধে আটকে যায়, তাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে অর্থ দিতে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যা তৈরি হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি মানবসম্পদ উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

রপ্তানি ও রাজস্ব আয়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধের চাপ যে দ্রুত বাড়ছে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নজরে এসেছে। আইএমএফ বাংলাদেশকে এখন মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ ঋণগ্রহীতা হিসেবে দেখছে। অর্থাৎ আমাদের আয় যত দ্রুত বাড়ছে না, তার চেয়ে দ্রুত বাড়ছে দায়। এর ফলে ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা সংকুচিত হতে পারে এবং শর্তও কঠোর হতে পারে। একটি দেশ যখন বৈদেশিক ঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন বিনিময় হার, মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ—এসব ক্ষেত্রেই ঝুঁকি বাড়ে।

তবে পরিস্থিতি অচল নয়। বরং বলা যায় এটি আমাদের আরও পরিণত হওয়ার সুযোগ। সবচেয়ে আগে দরকার রাজস্ব সংগৃহীত করার সক্ষমতা বাড়ানো। করদাতার সংখ্যা বাড়ানো, ট্যাক্স প্রশাসনকে প্রযুক্তিনির্ভর করা এবং অনিয়ম কমানো এখন জরুরি। খুব সহজভাবে বললে কর বাড়ানো নয়, বরং কর আদায়ের দক্ষতা বাড়ানো এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ।

নতুন উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের আগে একটি কঠোর অর্থনৈতিক মূল্যায়ন জরুরি। একটি প্রকল্প কত দিনে রিটার্ন দেবে, দেশীয় উৎপাদন বা রপ্তানিতে কতটা অবদান রাখবে বা কত কর্মসংস্থান তৈরি করবে তা হিসাব ছাড়া সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতে ঋণের চাপই বাড়বে। নতুন ঋণ শুধুই পুরোনো ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবহার হলে তা কোনো দেশের জন্যই ভালো লক্ষণ নয়।

ঋণ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত কাঠামো তৈরি করার যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত সময়োপযোগী। যদি একটি একীভূত অফিস থাকে যেখানে সব ধরনের ঋণের তথ্য, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং বার্ষিক ঋণগ্রহণের পরিকল্পনা পরিচালিত হবে, তবে সিদ্ধান্ত হবে আরও তথ্যভিত্তিক এবং বাজার বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিকভাবে এটি একটি স্বীকৃত প্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

স্বল্পমেয়াদে ঋণের চাপ সামাল দেওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি বাড়ানোই হবে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। পোশাক নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য খাতকে উৎসাহ দেওয়া, প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প গড়ে তোলা এবং বৈদেশিক বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। এছাড়া দেশীয় উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিলে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং চাপও কমবে বৈদেশিক মুদ্রায়।

২১ ট্রিলিয়ন টাকার ঋণ আমাদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। এই সংকেত উপেক্ষা করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও বড় দায় বইতে হবে। কিন্তু যদি আমরা এখনই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিই, রাজস্ব সংগ্রহ, ব্যয় দক্ষতা ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনি, তাহলে এই চ্যালেঞ্জই পরিণত হবে একটি শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি গঠনের সুযোগে। দেশের অর্থনীতি এমন এক পর্যায়ে এসেছে যেখানে সিদ্ধান্ত ভুল হলে ক্ষতির সম্ভাবনা বড়, আবার সঠিক সিদ্ধান্ত হলে ভবিষ্যত হবে আরও মজবুত। এখন পছন্দ আমাদেরই।

লেখক: ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত