leadT1ad

বিমান বাহিনীকে আধুনিকায়নের এখনই সময়

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

মাস চারেক আগে, গত ২১ জুলাই রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনা বদলে দিয়েছে আমাদের জাতীয় পর্যায়ের হিসাব-নিকাশ। এটিকে শুধুই একটি ‘মর্মান্তিক দুর্ঘটনা’ হিসেবে বিচারের সুযোগ নেই। একে বলতে হবে পরিকল্পনা হয়ে জমে থাকা অবহেলার এক দৃশ্যমান পরিণতি। এর মানবিক মূল্য আমাদের সম্মিলিত স্মৃতিতে গেঁথে আছে।

এই দুর্ঘটনা যান্ত্রিক ত্রুটির চেয়েও বেশি কিছুর ইঙ্গিত দেয়। এটি একটি কৌশলগত শূন্যতা উন্মোচিত করেছে। এই শূন্যতা উঠে এসেছে জাতির প্রবৃদ্ধি এবং তার আকাশশক্তির রূপান্তরের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাবের মধ্য দিয়ে। অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, শহুরে সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক অস্থিরতার পটভূমিতে দেশের সামরিক অবকাঠামো তাল মেলাতে পারেনি। এটি কেবল চূড়ান্ত আধুনিকায়ন বা সরঞ্জাম হালনাগাদের বিষয় নয়। বরং দেশের আকাশসীমার নিরাপত্তাকে পথনির্দেশকারী কৌশলগুলোরও পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।

আকাশসীমার নিরাপত্তা

আকাশসীমা এখন আর নিছক কোনো স্থির সীমানা নয়। এই সীমানা বরং গতিশীল। একে সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন স্তরে নজরদারি, পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সাড়া দেওয়া এবং সমন্বিত কমান্ড প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্য আকাশসীমার নিরাপত্তার কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশের তিনদিকেই ভারত-বেষ্টিত, যাদের আছে শক্তিশালী আঞ্চলিক বিমান শক্তি। সীমান্তের একটি অংশের ওপারে মিয়ানমার। তারাও সীমান্তে সামরিকীকরণ বাড়াচ্ছে। সঙ্গে আছে ক্রমাগত তীব্র হতে থাকা তাদের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার আশঙ্কা।

দেশের আকাশসীমা ভিড়পূর্ণ, সেই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণও বটে। বেসামরিক বিমান চলাচল, সামরিক কার্যক্রম এবং ক্রমবর্ধমান অনিয়ন্ত্রিত ড্রোন ট্রাফিকের ভিড়ে এটি জর্জরিত। এগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং জনবহুল কেন্দ্রগুলোর জন্য হুমকিও বটে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এসব সামলানোর জন্য যা আছে তা হলো এলোমেলো এক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় প্রস্তুতির জায়গায় আছে প্রতিক্রিয়া। নজরদারির মধ্যে আছে ফাঁক। সেখানে সক্ষমতার জায়গা পূরণ করা হয় আশা দিয়ে।

এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য তিনটি স্তরভিত্তিক এক জাতীয় আকাশসীমা কাঠামো গড়ার দাবি রাখে: ১. নিরবচ্ছিন্ন অগ্রিম সতর্কতা ব্যবস্থা, ২. দ্রুত সাড়া দিতে সক্ষম প্রতিরোধক বিমান বহর, এবং ৩. সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্র জুড়ে রিয়েল-টাইম সমন্বয় করতে সক্ষম ডেটা ফিউশন কেন্দ্র।

সিঙ্গাপুরের কৌশলগত গভীরতা এবং আঞ্চলিক আকাশসীমা সীমিত। তা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর এশিয়ার অন্যতম নির্ভরযোগ্য আকাশশক্তি মতবাদ তৈরি করেছে। তাদের এই কৌশলটি গড়ে উঠেছে পূর্ব-সতর্কতা, নেটওয়ার্কযুক্ত প্ল্যাটফর্ম এবং প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের ওপর নির্ভর করে। এটি সংখ্যার ওপর নয়, নির্ভর করে বরং শনাক্তকরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর করার গতির ওপর।

ক্ষমতা এবং রাজনীতি

আকাশশক্তি মানে কেবল সহায়ক শক্তি নয়। এটি বরং এক কৌশলগত নির্ধারক। যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও তা কূটনীতি, প্রতিরোধ এবং মতবাদ পর্যন্ত প্রসারিত। বিভিন্ন দেশ শুধু প্রতিরক্ষার জন্যই তাদের আকাশশক্তি প্রদর্শন করে না। এই শক্তি রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের ভূমিকাও নিশ্চিত করে।

দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে এটি স্পষ্ট। ভারত তার উত্তর-পূর্বে বিমান ঘাঁটিগুলো সম্প্রসারিত করছে। এই সম্প্রসারণ কেবল জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য নয়, কৌশলগত সংকেতও জানাচ্ছে। তারা মহাকাশ-ভিত্তিক গোয়েন্দা এবং নির্ভুল আক্রমণ ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের বিমান সক্ষমতাকে একীভূত করছে। এরই মধ্যে, নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ এবং আঞ্চলিক অবস্থান বজায় রাখতে যুদ্ধবিমানে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে।

প্রতিবেশীরা যখন এভাবে আধুনিকায়ন করছে, বাংলাদেশ তা দেখেও নিশ্চল থাকতে পারে না। আকাশশক্তি এখন জাতির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপস্থিতি আর আকাশকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতার বিষয়। সীমান্ত অতিক্রম করে আসা হুমকির প্রতিক্রিয়া, মানবিক মিশন, বা ভূ-রাজনৈতিক প্রতিরোধ—যেকোনো ক্ষেত্রেই আকাশসীমাকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির একটি কেন্দ্রীয় উপাদান হওয়া উচিত।

মতবাদ এবং প্রতিরোধ

সিঙ্গাপুরের কৌশলগত গভীরতা এবং আঞ্চলিক আকাশসীমা সীমিত। তা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর এশিয়ার অন্যতম নির্ভরযোগ্য আকাশশক্তি মতবাদ তৈরি করেছে। তাদের এই কৌশলটি গড়ে উঠেছে পূর্ব-সতর্কতা, নেটওয়ার্কযুক্ত প্ল্যাটফর্ম এবং প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের ওপর নির্ভর করে। এটি সংখ্যার ওপর নয়, নির্ভর করে বরং শনাক্তকরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর করার গতির ওপর। সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক সতর্কতা বিমানগুলো ডেটা লিংক এবং গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত। তারা কেবল বিমানেই বিনিয়োগ করে না, বরং সাড়াদানকে কার্যকর করে তোলা অপারেশনাল ইকোসিস্টেমেও বিনিয়োগ করে। এই উদাহরণ বাংলাদেশ গুরুত্ব দিয়ে নিতে পারে। মানে, আধুনিক আকাশশক্তি সংখ্যার বিষয় নয়, এটি হলো সমন্বয়, ক্ষিপ্রতা এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করার সক্ষমতার বিষয়।

বাংলাদেশের ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ নীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। আভাস ছিল যে, কৌশলগত প্রতিরোধ এবং আন্তঃপরিচালনা সক্ষমতাসহ একটি আধুনিক ত্রি-সেবা কাঠামো তৈরি করা হবে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন এখনও চলছে ধীরগতিতে। আধুনিকায়নে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বিমান বাহিনী।

নিজের ভূমিকা যদি স্পষ্ট না হয় তাহলে বিমান বাহিনী প্রতিক্রিয়া নির্ভর হয়ে ওঠে। বিস্তৃত এক কর্মসংস্থান কৌশল ছাড়া সরঞ্জাম সংগ্রহ হয়ে যায় খণ্ডিত। নির্ভরযোগ্য প্রতিরোধ ছাড়া কূটনীতি হয় জবরদস্তির শিকার। আঞ্চলিক আকাশ শক্তি মতবাদগুলি সমন্বিত বহু-ক্ষেত্রীয় কার্যক্রমের দিকে এগোচ্ছে। তাই অতীতের ভাবনার জড়তায় বাংলাদেশের আটকে থাকা উচিত নয়।

আধুনিকায়ন কেবল প্রতিপত্তির জন্য ক্রয় করা নয়। এ হলো সক্ষমতার সমন্বয়। এর মধ্যে রয়েছে এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম প্ল্যাটফর্ম, দীর্ঘ-পাল্লার মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়ারফেয়ারের প্রস্তুতি।

বাজেটের ঊর্ধ্বে

বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিমান বাহিনীর আধুনিকায়নের ব্যয় বহন করার সামর্থ নেই, এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত। জাতীয় নিরাপত্তা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। এটি একটি জনকল্যাণমূলক বিষয়, যেহেতু জাতীয় নিরাপত্তা অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। আধুনিক বিমান বাহিনী কেবল যুদ্ধ প্রতিরোধের কাজে লাগে তা নয়। তা দুর্যোগ মোকাবিলা, সীমান্ত নজরদারি, সন্ত্রাস দমন এবং বেসামরিক-সামরিক সমন্বয়কেও সহায়তা করে। এটি যেমন নিরাপত্তার ঢাল, তেমনই তা উন্নয়নের এক সহায়ক শক্তি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক ব্যয় কমে এসেছে। জিডিপির এক শতাংশ সামরিক ব্যয়ে বাংলাদেশ তার উন্নয়নমূলক গতিপথ এবং আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধির তুলনায় পিছিয়ে আছে। একে অতিরিক্ত সামরিকায়নের পক্ষে কোনো যুক্তি হিসেবে দেখলে ভুল হবে। কারণ এই সক্ষমতাগুলোকে অগ্রাধিকার দিলে তা কৌশলগত সুবিধা এনে দিতে পারে।

আধুনিকায়ন কেবল প্রতিপত্তির জন্য ক্রয় করা নয়। এ হলো সক্ষমতার সমন্বয়। এর মধ্যে রয়েছে এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম প্ল্যাটফর্ম, দীর্ঘ-পাল্লার মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়ারফেয়ারের প্রস্তুতি।

বাংলাদেশের উচিত টুকরো টুকরো সরঞ্জাম সংগ্রহের বাইরে গিয়ে প্ল্যাটফর্ম সিনার্জির দিকে এগিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ বিমান, নজরদারি, কমান্ড এবং ইলেকট্রনিক যুদ্ধকে একটি সুসংহত শক্তিতে যুক্ত করা।

সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও নিজ এলাকা রক্ষার প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতা কৌশলগত সমন্বয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। ফলে ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকে অবশ্যই ভূমি, জল, আকাশ এবং মিশ্র এই সব দিক দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া, বছরে অন্তত দুইবার যেন সব বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন চালানোর মতো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করাও জরুরি

এক ভঙ্গুর খণ্ড দশা

ঢাকা শহরের ঘনত্ব বেড়ে গেছে। এই ঘনত্বে নিরাপদ বিমান পরিচালনা সম্ভব নয়। সামরিক এবং বেসামরিক বিমান চলাচল বর্তমানে বিপজ্জনকভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক আকাশসীমায় পরিচালিত হচ্ছে। অথচ বিমানঘাঁটি স্থানান্তরের প্রস্তাবগুলো এখনও অসমাপ্ত অথবা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে আছে। প্রস্তাবের মধ্যে ছিল কুর্মিটোলা থেকে ত্রিশালে এবং আরিয়াল বিল-এ সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা। এই ব্যর্থতাগুলো কিন্তু শুধু সরঞ্জাম বা লজিস্টিকের কারণে হয়নি। এগুলো মূলত রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। এর মধ্য দিয়ে কৌশলগত অগ্রাধিকারের অভাবই স্পষ্ট হয়।

সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও নিজ এলাকা রক্ষার প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রবণতা কৌশলগত সমন্বয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। ফলে ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকে অবশ্যই ভূমি, জল, আকাশ এবং মিশ্র এই সব দিক দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া, বছরে অন্তত দুইবার যেন সব বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন চালানোর মতো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করাও জরুরি।

চিন্তাভাবনায় আধুনিকতা

আকাশে আমাদের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করতে চাইলে স্পষ্ট নীতি, শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখার সক্ষমতা এবং আধুনিক হওয়ার প্রতিশ্রুতি—এই তিনটিরই দরকার। একটি শক্তিশালী বিমান বাহিনী শুধু আকাশকে রক্ষা করে না। হুমকি যখন আগের চেয়েও অনেক দ্রুত গতিতে আসে, তখন তা আমাদের দূর পর্যন্ত পৌঁছানোর, দ্রুত সাড়া দেওয়ার এবং টিকে থাকার ক্ষমতা যোগায়। এটি আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে সম্ভব করে তোলে। এর মাধ্যমে একটি প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতি যেন নিরাপত্তাগত দুর্বলতার কাছে জিম্মি না হওয়া নিশ্চিত করা যায়।

গত ২১ জুলাইয়ের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি কেবল শোকের নয়। এর এক বিশেষ নতুন তাৎপর্য আছে। বাংলাদেশকে অবশ্যই তার প্রতিরক্ষা ভাবনাকে নতুন করে সাজাতে হবে, তার আকাশকে আবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে এবং আধুনিক হতে হবে। এখন উদ্দেশ্য শুধু আরও উঁচুতে ওড়া নয়, বরং আরও দূরদর্শী চিন্তা করা।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত