উচ্চকক্ষে সদস্য নির্বাচন
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর ৩১ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসন বিশিষ্ট। আর এর সদস্য মনোনীত হবেন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে যে ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে আসন। তবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে দ্বিধাবিভক্তি।
কে এম মহিউদ্দিন
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সাধারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্বাচিত ১০০ জন সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কারের অন্যতম আলোচিত ইস্যু হিসেবে উচ্চকক্ষ এবং সংখ্যানুপাতিক (প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন—পিআর সিস্টেম) নির্বাচন পদ্ধতির এ প্রস্তাব কিছু রাজনৈতিক দলের প্রশংসা পেলেও বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট মতপার্থক্যও দেখা দিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সমমনা দল কমিশনের এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে বটে, তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও এলডিপি এ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। ফলে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও সদস্য মনোনয়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। বাংলাদেশের মতো জনবহুল কিন্তু আয়তনে ছোট, এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ আদৌ প্রয়োজনীয় কি না, সামনে এসেছে সে প্রশ্নও।
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা রয়েছে, এমন দেশগুলোর সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়ে থাকে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো ও রাশিয়ায় দুটি কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে। তবে কিছু দেশ যেমন যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স ও জাপানে যদিও যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি নেই, তবুও তাদের সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট।
অন্যদিকে ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা থাকায় এসব দেশের আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন ও জেরেমি বেনথাম এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে থাকলেও জন স্টুয়ার্ট মিল ও লর্ড ব্রাইস দ্বিকক্ষের সমর্থনে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে যুক্তরাজ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে নিম্নকক্ষ (কমন্স সভা) প্রধান ক্ষমতাধর। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্য নন এবং তাঁর ক্ষমতা সীমিত। তবে আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় কংগ্রেসে ভেটো, তদারকি ও জবাবদিহি প্রক্রিয়া সক্রিয়ভাবে কাজ করে।
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (ফিউশন অব পাওয়ারস) থাকায় সংসদের নিম্নকক্ষ প্রায়শই শাসন বিভাগের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের কাঠামোতে আইন প্রণয়নে কার্যত নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে ওয়েস্টমিনিস্টার মডেলের অনুসারী দেশগুলোতে নির্বাচন পদ্ধতি হিসেবে ’ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) অনুসরণ করে।
এ পদ্ধতিতে সাধারণত সংসদে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ সীমিত। অন্যদিকে জার্মানির মতো ইউরোপের যেসব দেশে একই সঙ্গে ’ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ ও পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেসব দেশে সাধারণত কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রবণতা বেশি।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের সদস্য সংখ্যা মোট ৩৫০ জন। যাঁদের মধ্যে একক নির্বাচনী এলাকা থেকে এফপিটিপি পদ্ধতিতে সরাসরি জনগণের ভোটে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচিত হন। আর অবশিষ্ট ৫০ জন সংরক্ষিত (নারী) আসন থেকে আইনানুযায়ী সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসন সংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি বড় দলগুলোর জন্য সুবিধাজনক। বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদ এককক্ষবিশিষ্ট হলেও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো উচ্চকক্ষ প্রবর্তনের প্রস্তাব এসেছে। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চককক্ষের ১০০ জন সদস্যের সবাই-ই জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্য ভোটের ভিত্তিতে সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। তবে এ প্রস্তাবে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো দ্বিমত পোষণ করে বলছে, জাতীয় নির্বাচনে সংসদে দলের প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে সদস্য মনোনয়নই যৌক্তিক। এ পদ্ধতি কার্যকর হলে নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই উচ্চকক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, যা মূলত বর্তমান সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য নির্বাচনের মতোই।
সাধারণত কোনো সংসদের সদস্য নির্বাচনের জন্য দুই ধরনের পদ্ধতির প্রচলন দেখা যায়— ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) ও ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ বা পিআর পদ্ধতি।
প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোট পান, তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অন্যপক্ষে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থায় একই সঙ্গে নির্বাচনী এলাকার ভোটার এবং নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের সমানুপাতিক হারে প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে প্রার্থী নির্বাচনের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে—একক হস্তান্তর পদ্ধতি (সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট) ও দলীয় তালিকা পদ্ধতি (পার্টি লিস্ট সিস্টেম)।
এখানে প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে ভোটাররা তাঁদের পছন্দক্রম উল্লেখ করে একটি ব্যালট পেপারে একই সঙ্গে একাধিক প্রার্থীকে ভোট প্রদান করেন। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার একবার ভোট দেন। কিন্তু ভোটারদের পছন্দক্রম অনুসারে কোন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, তা নির্ণয়ের জন্য বারবার ভোট গণনা করতে হয়।
আর দলীয় তালিকা পদ্ধতিতে দলগুলো নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রার্থীদের একটি তালিকা তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করে। এরপর নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যার অনুপাতে দলীয় তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।
আর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে প্রতিফলিত হয় প্রত্যেক ভোটারের মতামত। এতে দেশের ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর সংসদে প্রতিনিধিত্ব লাভের সুযোগ থাকে। তথাপি এ পদ্ধতি জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। ইউরোপের কিছু দেশে— জার্মানি, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি—এফপিটিপি ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব—উভয় পদ্ধতিতেই সংসদের সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
নির্বাচনের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হিসেবে এফপিটিপি পদ্ধতি জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে ভোটারেরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য থেকে একজনকে ভোট দিতে পারেন এবং ভোট গণনায় যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে সংখ্যানুপাতিক হারে কম ভোট কম পেলেও তিনিই নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিল, এমন অধিকাংশ দেশে একক নির্বাচনী আসন থেকে এফপিটিপি পদ্ধতিতে সংসদের সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির কোন ধরনটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার্যকর হবে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বিএনপি প্রস্তাবিত আসনভিত্তিক বরাদ্দ হলে কোনো একটি বড় দলের আধিপত্য বজায় থাকবে। অন্যদিকে, জার্মানির মতো দলীয় তালিকাভিত্তিক পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করলে কোনো একটি বড় দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিনিধি মনোনয়নে দায়িত্বশীলতা বাড়বে। এ পদ্ধতিতে দলগুলো সাধারণ নির্বাচনের সময় উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা আগেই প্রকাশ করবে। ফলে জনগণও আগে থেকেই জানতে পারবে কোন দল কাকে উচ্চকক্ষে পাঠাতে চায়। এতে করে প্রার্থী মনোনয়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে এবং উচ্চকক্ষের কার্যকারিতা বাড়বে বলে ধারণা করা যায়।
নিজ নিজ শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও শাসনব্যবস্থার চাহিদা অনুযায়ী গড়ে উঠেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সের আইনসভা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন সংবিধান প্রণেতারা রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অতিমাত্রায় ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং আশা করা যায় অচিরেই এটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে।
বাংলাদেশে প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ যদি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সাংবিধানিক চেতনার ভিত্তিতে গড়ে তোলা যায়, তবে তা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব কমিয়ে সংসদের ভূমিকাকে জোরদার করতে পারে বলেই মনে হয়। পাশাপাশি শাসন বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে কার্যকর ভারসাম্য রক্ষার পথও প্রশস্ত হবে। তবে এর জন্য যা দরকার তা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের প্রতি সব পক্ষের প্রতিশ্রুতি।
ড. কে এম মহিউদ্দিন : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সাধারণ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্বাচিত ১০০ জন সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কারের অন্যতম আলোচিত ইস্যু হিসেবে উচ্চকক্ষ এবং সংখ্যানুপাতিক (প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন—পিআর সিস্টেম) নির্বাচন পদ্ধতির এ প্রস্তাব কিছু রাজনৈতিক দলের প্রশংসা পেলেও বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট মতপার্থক্যও দেখা দিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সমমনা দল কমিশনের এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে বটে, তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও এলডিপি এ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। ফলে উচ্চকক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও সদস্য মনোনয়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। বাংলাদেশের মতো জনবহুল কিন্তু আয়তনে ছোট, এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ আদৌ প্রয়োজনীয় কি না, সামনে এসেছে সে প্রশ্নও।
সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা রয়েছে, এমন দেশগুলোর সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হয়ে থাকে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো ও রাশিয়ায় দুটি কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে। তবে কিছু দেশ যেমন যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স ও জাপানে যদিও যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি নেই, তবুও তাদের সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট।
অন্যদিকে ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা থাকায় এসব দেশের আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন ও জেরেমি বেনথাম এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে থাকলেও জন স্টুয়ার্ট মিল ও লর্ড ব্রাইস দ্বিকক্ষের সমর্থনে যুক্তি তুলে ধরেছেন।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে যুক্তরাজ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে নিম্নকক্ষ (কমন্স সভা) প্রধান ক্ষমতাধর। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি আইনসভার সদস্য নন এবং তাঁর ক্ষমতা সীমিত। তবে আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় কংগ্রেসে ভেটো, তদারকি ও জবাবদিহি প্রক্রিয়া সক্রিয়ভাবে কাজ করে।
সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (ফিউশন অব পাওয়ারস) থাকায় সংসদের নিম্নকক্ষ প্রায়শই শাসন বিভাগের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের কাঠামোতে আইন প্রণয়নে কার্যত নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে ওয়েস্টমিনিস্টার মডেলের অনুসারী দেশগুলোতে নির্বাচন পদ্ধতি হিসেবে ’ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) অনুসরণ করে।
এ পদ্ধতিতে সাধারণত সংসদে ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ সীমিত। অন্যদিকে জার্মানির মতো ইউরোপের যেসব দেশে একই সঙ্গে ’ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ ও পিআর পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেসব দেশে সাধারণত কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রবণতা বেশি।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের সদস্য সংখ্যা মোট ৩৫০ জন। যাঁদের মধ্যে একক নির্বাচনী এলাকা থেকে এফপিটিপি পদ্ধতিতে সরাসরি জনগণের ভোটে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচিত হন। আর অবশিষ্ট ৫০ জন সংরক্ষিত (নারী) আসন থেকে আইনানুযায়ী সাধারণ আসনে নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসন সংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি বড় দলগুলোর জন্য সুবিধাজনক। বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদ এককক্ষবিশিষ্ট হলেও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো উচ্চকক্ষ প্রবর্তনের প্রস্তাব এসেছে। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চককক্ষের ১০০ জন সদস্যের সবাই-ই জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্য ভোটের ভিত্তিতে সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবেন। তবে এ প্রস্তাবে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো দ্বিমত পোষণ করে বলছে, জাতীয় নির্বাচনে সংসদে দলের প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে সদস্য মনোনয়নই যৌক্তিক। এ পদ্ধতি কার্যকর হলে নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই উচ্চকক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, যা মূলত বর্তমান সংরক্ষিত নারী আসনে সদস্য নির্বাচনের মতোই।
সাধারণত কোনো সংসদের সদস্য নির্বাচনের জন্য দুই ধরনের পদ্ধতির প্রচলন দেখা যায়— ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) ও ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ বা পিআর পদ্ধতি।
প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোট পান, তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। অন্যপক্ষে, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থায় একই সঙ্গে নির্বাচনী এলাকার ভোটার এবং নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের সমানুপাতিক হারে প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে প্রার্থী নির্বাচনের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে—একক হস্তান্তর পদ্ধতি (সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট) ও দলীয় তালিকা পদ্ধতি (পার্টি লিস্ট সিস্টেম)।
এখানে প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে ভোটাররা তাঁদের পছন্দক্রম উল্লেখ করে একটি ব্যালট পেপারে একই সঙ্গে একাধিক প্রার্থীকে ভোট প্রদান করেন। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার একবার ভোট দেন। কিন্তু ভোটারদের পছন্দক্রম অনুসারে কোন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, তা নির্ণয়ের জন্য বারবার ভোট গণনা করতে হয়।
আর দলীয় তালিকা পদ্ধতিতে দলগুলো নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রার্থীদের একটি তালিকা তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করে। এরপর নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে প্রতিটি দলের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যার অনুপাতে দলীয় তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।
আর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে প্রতিফলিত হয় প্রত্যেক ভোটারের মতামত। এতে দেশের ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর সংসদে প্রতিনিধিত্ব লাভের সুযোগ থাকে। তথাপি এ পদ্ধতি জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। ইউরোপের কিছু দেশে— জার্মানি, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি—এফপিটিপি ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব—উভয় পদ্ধতিতেই সংসদের সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
নির্বাচনের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হিসেবে এফপিটিপি পদ্ধতি জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে ভোটারেরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য থেকে একজনকে ভোট দিতে পারেন এবং ভোট গণনায় যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন। এক্ষেত্রে সংখ্যানুপাতিক হারে কম ভোট কম পেলেও তিনিই নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ছিল, এমন অধিকাংশ দেশে একক নির্বাচনী আসন থেকে এফপিটিপি পদ্ধতিতে সংসদের সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির কোন ধরনটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কার্যকর হবে, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বিএনপি প্রস্তাবিত আসনভিত্তিক বরাদ্দ হলে কোনো একটি বড় দলের আধিপত্য বজায় থাকবে। অন্যদিকে, জার্মানির মতো দলীয় তালিকাভিত্তিক পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করলে কোনো একটি বড় দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিনিধি মনোনয়নে দায়িত্বশীলতা বাড়বে। এ পদ্ধতিতে দলগুলো সাধারণ নির্বাচনের সময় উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা আগেই প্রকাশ করবে। ফলে জনগণও আগে থেকেই জানতে পারবে কোন দল কাকে উচ্চকক্ষে পাঠাতে চায়। এতে করে প্রার্থী মনোনয়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে এবং উচ্চকক্ষের কার্যকারিতা বাড়বে বলে ধারণা করা যায়।
নিজ নিজ শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও শাসনব্যবস্থার চাহিদা অনুযায়ী গড়ে উঠেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সের আইনসভা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন সংবিধান প্রণেতারা রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির ভিত্তিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অতিমাত্রায় ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং আশা করা যায় অচিরেই এটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে।
বাংলাদেশে প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ যদি দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সাংবিধানিক চেতনার ভিত্তিতে গড়ে তোলা যায়, তবে তা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব কমিয়ে সংসদের ভূমিকাকে জোরদার করতে পারে বলেই মনে হয়। পাশাপাশি শাসন বিভাগ ও আইনসভার মধ্যে কার্যকর ভারসাম্য রক্ষার পথও প্রশস্ত হবে। তবে এর জন্য যা দরকার তা হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ও অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের প্রতি সব পক্ষের প্রতিশ্রুতি।
ড. কে এম মহিউদ্দিন : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি প্রজ্ঞাপন আমার নজরে এল। প্রজ্ঞাপনটি হলো, রাত দশটার পর হলে ফিরলে ছাত্রীদের হলের সিট বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি তা দশটা এক মিনিট হলেও। অবাক করা প্রজ্ঞাপন বটে!
১ ঘণ্টা আগেযুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক আরও জোরদার করা।
১ দিন আগে২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে যে ছাত্র আন্দোলন হলো এবং এতে তৎকালীন সরকারের ছাত্র-সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী—এই দুইয়ের নৃশংসতায় সহস্রাধিক যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, আজও তা ভুলতে পারি না। মূলত এর পরেই তো শুরু হলো ছাত্র-জনতার গণজোয়ার।
২ দিন আগেকেন এত বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি—এর কোনো সদুত্তর কখনোই কোনো সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে পারেনি। বহুদিন ধরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও প্লাটফর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও সে দাবি বাস্তবায়ন করেনি প্রশাসনগুলো।
২ দিন আগে