পুলিশ বাহিনীর সংস্কার
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন থেকে উপস্থাপিত হয়েছে বিচিত্র ধরনের সংস্কার প্রস্তাব। সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের কেন্দ্রে উঠে এসেছে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব। পেশাদারত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নতুন করে এটি তোলা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর সংস্কার কি আদতে সম্ভব? সমস্যা কোথায়?
সামজীর আহমেদ
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কারের স্বপ্ন প্রবলভাবে দেখা দেয়। কারণ, পুরনো বন্দোবস্ত গভীর ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। ফলে নতুন সরকার আসার পরপরই অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে জনগণের ব্যাপক আগ্রহের বিষয় ছিল পুলিশের সংস্কার।
পুলিশের নিপীড়ক ও নিষ্পেষক চেহারাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। বিগত এক বছরে পুলিশের সংস্কারের স্বপ্ন ক্রমশ ধূসর হয়েছে। কিন্তু কেন ধূসর হচ্ছে এটার একটা বোঝাপড়াই বর্তমান লেখার মূল উদ্দেশ্য।
দুনিয়ার বহু দেশে নানান সময়ে পুলিশের সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই আসলে ব্যর্থ হয়েছে। অল্প কিছু সাফল্যও আছে৷ অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার কিছু স্টেট বিশেষ করে জর্জিয়া, কিরঘিজিস্তান এবং রাশিয়া সংস্কার-ব্যর্থতার দৃশ্যমান উদাহরণ। এ কারণে বাংলাদশে পুলিশের সংস্কার সফল হওয়ার ব্যাপারে বড়সড় আশাবাদ না রাখাই ভালো। কেননা, গণতান্ত্রিক বা জনমুখী পুলিশ সৃষ্টির পথে মোটাদাগে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে; এক. রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক, দুই. সাংস্কৃতিক, তিন. সাংগঠনিক ও প্রক্রিয়াগত।
শুরুতেই রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জটি খতিয়ে দেখা যাক৷ আমাদের এই অঞ্চলে পুলিশ কখনোই জনসেবার জন্য তৈরি হয়নি। ঔপনিবেশিক আমলে সরকার রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে পুলিশের জন্ম। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকার ওই বছরই থানা ও দারোগা প্রথার গোড়াপত্তন করে। সিপাহী বিপ্লবের পরপর জন্ম হয় আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থার। এসবের জন্ম জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। মূলত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গোপন খবর সংগ্রহের তাগিদে। বঙ্গভঙ্গের সময়ে সৃষ্টি হয় কলকাতায় স্পেশাল ব্রাঞ্চ। স্বাধীন বাংলাদেশে চিতা, র্যাব, কোবরার জন্ম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে।
সম্মতিমূলক শাসন এ দেশে তৈরিই হয়নি। রাজনীতিবিদেরা জনসম্মতির প্রয়োজনও মনে করেননি শুধুমাত্র কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন ছাড়া। এ কারণে তাদের টিকে থাকতে হয়েছে পুলিশের গায়ে ঠেস দিয়ে। আর এই ঠেস দিতে গিয়ে রাজনীতিবিদ ও পুলিশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে একটি লেনাদেনার সম্পর্ক।
অবৈধ সুবিধা আদায় করার স্বাভাবিক কৌশল হচ্ছে আরেকধরনের অবৈধ সুবিধা দেয়া। এ কারণে রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশের পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব। নিরাপত্তা সেবা প্রদানে বাংলাদেশের পুলিশ যদি বিড়াল হয়, তাহলে বিরোধীদল দমনে সে আসলে বাঘ।
একটা জিডি বা মামলা কিংবা নিরাপত্তাজনিত অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশের সকল সীমাবদ্ধতা আপনার চোখে পড়বে। কিন্তু আন্দোলন করতে নামলে দেখবেন তার কোনো সীমাবদ্ধতাই নেই।
একটা পরিসংখ্যান বলি। ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট পুলিশ প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৭৩ শতাংশ পুলিশ সদস্য কনস্টেবল থেকে এ এসআই পর্যন্ত উন্নীত হয়েছেন। এই গোষ্ঠী কোনো মামলা বা অভিযোগ নিতে পারেন না, ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারেন না। অর্থাৎ, যে কারণে জনগণের পুলিশকে প্রয়োজন হয়, পেট্রোলিং ছাড়া তাঁরা তা মেটাতে পারেন না। কিন্তু আন্দোলন দমনে আবার পুরো বাহিনীকেই পাওয়া যায়৷
আরেকটা উদাহরণ দিই৷ ২০০৪ সালের টিআইবির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ ল অ্যান্ড অর্ডার মেইনটেনেন্সে ব্যয় করেছে ৪০ শতাংশ সময়, ভিআইপি সার্ভিসে ব্যয় করে ৩২ শতাংশ সময় আর মামলা সংক্রান্ত কাজে ব্যয় করেছে মাত্র ১৮ শতাংশ সময়।
একে তো মোট পুলিশের প্রায় ৭৫ শতাংশ সদস্য মামলার অথবা অভিযোগের কাজে আসে না৷ তার ওপর সেই বাকি ২৫ শতাংশও আবার মামলার কাজে সময় ব্যয় করে মাত্র ১৮ শতাংশ। টিআইবির রিপোর্টটি পুরনো হলেও তা অবশ্যই বর্তমানের ইঙ্গিত দিতে সক্ষম। কারণ এই সময়পর্বে পুলিশের সংখ্যা ছাড়া আর কোনো বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক পুলিশিং কী জিনিস তা বুঝতে খুব বেশিদূর যেতে হয় না।
বর্তমান সরকারের এক বছরে পুলিশের নিরাপত্তা সেবা ভয়াবহভাবে কমে গেছে বলেই জনপরিসরে আলাপ রয়েছে। কিন্তু ঠিক এই সময় পরিসরে ১০ মাসে পুলিশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রেফতার করেছে। সংখ্যাটা ৩ লাখ ৫৯ হাজার (সমকাল ০১ জুন ২০২৫)। তার মানে সেবার পুলিশ না থাকলেও, রাজনৈতিক পুলিশ কিন্তু তার পুরোনো গতিতেই আছে। এখন এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার বদল ছাড়া পুলিশের সংস্কার কীভাবে বিচ্ছিন্নভাবে সম্ভব, তা গুরুতর প্রশ্নের বিষয়।
এখন আসি সাংস্কৃতিক কারণ অনুসন্ধানে। সাংস্কৃতিক বিষয়টি সংস্কার আলাপে কেন যেন কোনো গুরুত্বই লাভ করে না। কিন্তু দৈনন্দিনতার চর্চা অত্যন্ত শক্তিশালী। পুলিশ একটা ইউনিফর্মড বাহিনী। পোশাক ও তার সংগঠনের কারণে এই বাহিনীর মধ্যে ফেলো ফিলিংস অত্যন্ত তীব্র। তাদের কাজ বিপজ্জনক হওয়ার কারণে এবং সে যেহেতু জানে মানুষ তাকে ‘ভয়’ করলেও ‘পছন্দ’ করে না, ফলে তার দরদি আসলে সে নিজেই। একজন পুলিশই বোঝে আরেকজন পুলিশের যাপনের যাতনা। এ কারণে সে অপর পুলিশকে বিপদ থেকে রক্ষার্থে প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পাশে দাঁড়ানোর এই চল প্রায়শই তাকে ক্রাইম পার্টনার করে তোলে।
বাংলাদেশে পুলিশের সাথে ক্ষমতার দ্বৈরথ আছে মূলত আমলাদের। এখন আমলাদের নেতৃত্বে তৈরি সংস্কার কমিশন এই বিশাল ফেলো-ফিলিংসের বাহিনী কি আসলেই গ্রহণ করবে? সংস্কার কি চাপিয়ে দেয়া যাবে? সম্মতি উৎপাদন করা না গেলে এই সুগঠিত বাহিনীর বহু মেকানিজম আছে সংস্কারকে নস্যাৎ করার।
দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ রিফর্ম ব্যর্থ হওয়ার এটি বড় কারণ। সংস্কার প্রস্তাব কাগজ থেকে বাস্তবতায় আনতে গেলে ওপর থেকে চাপিয়ে সম্ভব না বলেই আমার মত। পুলিশের ট্রেনিংয়ে যে অমানবিকতার পাঠ দেয়া হয়, এরপর তার কাছে মানবিকতা আশা করা দুরূহই বটে।
পুলিশ তো বটেই, সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে 'মাইরের উপর ওষুধ নাই'। এই বিশ্বাস মজ্জায় নিয়ে রিমান্ডে পুলিশ কীভাবে নির্যাতক হবে না? পুলিশ জবরদস্তিমূলক মানসিকতার ওজর হিসেবে আরেকটি বিষয়কে হাজির করে। সেটি হলো জনগণ জোর না করলে নিয়ম মানে না। অর্থাৎ, অবাধ্য জনগণের ফলেই জবরদস্তিমূলক পুলিশিংয়ের জন্ম। কিন্তু, ঘটনাটা ঠিক তার উলটো।
মানুষ যখন রাষ্ট্র ও পুলিশের কাছে ন্যায়মূলক ব্যবস্থার দেখা পায় না। তখনই আইন অমান্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেক্ষেত্রে পুলিশের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। সে যে মিলিটারি না, এটা বোঝা জরুরি। মিলিটারি কাজ করে ঘোষিত শত্রুর বিরুদ্ধে। সে প্রস্তুত হয় যুদ্ধের জন্য। আর তাই বলপ্রয়োগ তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে পুলিশের কাজ নিরাপত্তাজনিত সেবা দেয়া। সে শত্রুর সাথে লড়াই করে না, নাগরিকের সাথে ডিল করে। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কাজ। এর জন্য এমন প্রোগ্রাম হাতে নেয়া উচিত, এমন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করা উচিত, যা পুলিশের সংস্কৃতিতেই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
পুলিশ বাহিনীর কাঠামো মূলত মিলিটারি কাঠামো। তার র্যাঙ্ক ও প্রোফাইল সেভাবেই সাজানো। তার কমান্ড পালনের ধরনও একইরকম৷ এই কমান্ডকে ধরে রাখতে এবং রাজনৈতিক পুলিশিং ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন’ বা ‘এসিআর’।
এই প্রতিবেদনের ফলে পুলিশ তার ঊর্ধ্বতনের কাছে বাঁধা পড়ে থাকে। সেটার কিছু প্রয়োজনও আছে। কিন্তু সেবা ব্যবস্থার মূল্যায়ন করার কথা সেবাগ্রহিতার। যেমন বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করে থাকে শিক্ষার্থীরা। সেবাগ্রহিতা মূল্যায়ন করলে সেবাদাতার দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। কিন্তু পুলিশি প্রক্রিয়ায় সেই দায়বদ্ধতার অস্তিত্ব নেই।
আবার সাংগঠনিক জায়গা থেকে ওসি ব্যবস্থা একটা মোটামুটি ভয়াবহ ব্যবস্থা। এটি ঔপনিবেশিক দারোগা ব্যবস্থারই এক ধরনের সম্প্রসারণ। একটি পুলিশ স্টেশনের প্রায় মালিকানা তার হাতে। এটি যেমন কাজের ক্ষেত্রে অতিকেন্দ্রীকরণ ও জট তৈরি করে, তেমনি এর আছে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য। ৬৪০ জনের মতো ওসি নিয়ন্ত্রণে থাকলেই গোটা একটা দেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক বিষয় থাকলেও বর্তমান লেখার পরিসরে তা আলাপের সুযোগ নেই। আমি মনে করি, পুলিশ সংগঠনকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে৷ বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো অব্যাহত থাকলে তা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে প্রতিহত করবে।
সংস্কারের ব্যাপারে নিরাশ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, সমস্যা নির্ণয় ও ফিজিবিলিটি টেস্ট কিংবা রিয়ালিটি চেক সফল সংস্কারের পূর্বশর্ত। সেই ইঙ্গিতটুকুই এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
সামজীর আহমেদ, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি পুলিশের বিউপনিবেশায়ন বিষয়ক গবেষণা ও পর্যালোচনার সঙ্গে যুক্ত।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কারের স্বপ্ন প্রবলভাবে দেখা দেয়। কারণ, পুরনো বন্দোবস্ত গভীর ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। ফলে নতুন সরকার আসার পরপরই অনেকগুলো সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে জনগণের ব্যাপক আগ্রহের বিষয় ছিল পুলিশের সংস্কার।
পুলিশের নিপীড়ক ও নিষ্পেষক চেহারাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। বিগত এক বছরে পুলিশের সংস্কারের স্বপ্ন ক্রমশ ধূসর হয়েছে। কিন্তু কেন ধূসর হচ্ছে এটার একটা বোঝাপড়াই বর্তমান লেখার মূল উদ্দেশ্য।
দুনিয়ার বহু দেশে নানান সময়ে পুলিশের সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই আসলে ব্যর্থ হয়েছে। অল্প কিছু সাফল্যও আছে৷ অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার কিছু স্টেট বিশেষ করে জর্জিয়া, কিরঘিজিস্তান এবং রাশিয়া সংস্কার-ব্যর্থতার দৃশ্যমান উদাহরণ। এ কারণে বাংলাদশে পুলিশের সংস্কার সফল হওয়ার ব্যাপারে বড়সড় আশাবাদ না রাখাই ভালো। কেননা, গণতান্ত্রিক বা জনমুখী পুলিশ সৃষ্টির পথে মোটাদাগে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে; এক. রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক, দুই. সাংস্কৃতিক, তিন. সাংগঠনিক ও প্রক্রিয়াগত।
শুরুতেই রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জটি খতিয়ে দেখা যাক৷ আমাদের এই অঞ্চলে পুলিশ কখনোই জনসেবার জন্য তৈরি হয়নি। ঔপনিবেশিক আমলে সরকার রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে পুলিশের জন্ম। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকার ওই বছরই থানা ও দারোগা প্রথার গোড়াপত্তন করে। সিপাহী বিপ্লবের পরপর জন্ম হয় আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থার। এসবের জন্ম জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। মূলত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গোপন খবর সংগ্রহের তাগিদে। বঙ্গভঙ্গের সময়ে সৃষ্টি হয় কলকাতায় স্পেশাল ব্রাঞ্চ। স্বাধীন বাংলাদেশে চিতা, র্যাব, কোবরার জন্ম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে।
সম্মতিমূলক শাসন এ দেশে তৈরিই হয়নি। রাজনীতিবিদেরা জনসম্মতির প্রয়োজনও মনে করেননি শুধুমাত্র কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন ছাড়া। এ কারণে তাদের টিকে থাকতে হয়েছে পুলিশের গায়ে ঠেস দিয়ে। আর এই ঠেস দিতে গিয়ে রাজনীতিবিদ ও পুলিশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে একটি লেনাদেনার সম্পর্ক।
অবৈধ সুবিধা আদায় করার স্বাভাবিক কৌশল হচ্ছে আরেকধরনের অবৈধ সুবিধা দেয়া। এ কারণে রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশের পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব। নিরাপত্তা সেবা প্রদানে বাংলাদেশের পুলিশ যদি বিড়াল হয়, তাহলে বিরোধীদল দমনে সে আসলে বাঘ।
একটা জিডি বা মামলা কিংবা নিরাপত্তাজনিত অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশের সকল সীমাবদ্ধতা আপনার চোখে পড়বে। কিন্তু আন্দোলন করতে নামলে দেখবেন তার কোনো সীমাবদ্ধতাই নেই।
একটা পরিসংখ্যান বলি। ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট পুলিশ প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৭৩ শতাংশ পুলিশ সদস্য কনস্টেবল থেকে এ এসআই পর্যন্ত উন্নীত হয়েছেন। এই গোষ্ঠী কোনো মামলা বা অভিযোগ নিতে পারেন না, ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারেন না। অর্থাৎ, যে কারণে জনগণের পুলিশকে প্রয়োজন হয়, পেট্রোলিং ছাড়া তাঁরা তা মেটাতে পারেন না। কিন্তু আন্দোলন দমনে আবার পুরো বাহিনীকেই পাওয়া যায়৷
আরেকটা উদাহরণ দিই৷ ২০০৪ সালের টিআইবির একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ ল অ্যান্ড অর্ডার মেইনটেনেন্সে ব্যয় করেছে ৪০ শতাংশ সময়, ভিআইপি সার্ভিসে ব্যয় করে ৩২ শতাংশ সময় আর মামলা সংক্রান্ত কাজে ব্যয় করেছে মাত্র ১৮ শতাংশ সময়।
একে তো মোট পুলিশের প্রায় ৭৫ শতাংশ সদস্য মামলার অথবা অভিযোগের কাজে আসে না৷ তার ওপর সেই বাকি ২৫ শতাংশও আবার মামলার কাজে সময় ব্যয় করে মাত্র ১৮ শতাংশ। টিআইবির রিপোর্টটি পুরনো হলেও তা অবশ্যই বর্তমানের ইঙ্গিত দিতে সক্ষম। কারণ এই সময়পর্বে পুলিশের সংখ্যা ছাড়া আর কোনো বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। রাজনৈতিক পুলিশিং কী জিনিস তা বুঝতে খুব বেশিদূর যেতে হয় না।
বর্তমান সরকারের এক বছরে পুলিশের নিরাপত্তা সেবা ভয়াবহভাবে কমে গেছে বলেই জনপরিসরে আলাপ রয়েছে। কিন্তু ঠিক এই সময় পরিসরে ১০ মাসে পুলিশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রেফতার করেছে। সংখ্যাটা ৩ লাখ ৫৯ হাজার (সমকাল ০১ জুন ২০২৫)। তার মানে সেবার পুলিশ না থাকলেও, রাজনৈতিক পুলিশ কিন্তু তার পুরোনো গতিতেই আছে। এখন এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার বদল ছাড়া পুলিশের সংস্কার কীভাবে বিচ্ছিন্নভাবে সম্ভব, তা গুরুতর প্রশ্নের বিষয়।
এখন আসি সাংস্কৃতিক কারণ অনুসন্ধানে। সাংস্কৃতিক বিষয়টি সংস্কার আলাপে কেন যেন কোনো গুরুত্বই লাভ করে না। কিন্তু দৈনন্দিনতার চর্চা অত্যন্ত শক্তিশালী। পুলিশ একটা ইউনিফর্মড বাহিনী। পোশাক ও তার সংগঠনের কারণে এই বাহিনীর মধ্যে ফেলো ফিলিংস অত্যন্ত তীব্র। তাদের কাজ বিপজ্জনক হওয়ার কারণে এবং সে যেহেতু জানে মানুষ তাকে ‘ভয়’ করলেও ‘পছন্দ’ করে না, ফলে তার দরদি আসলে সে নিজেই। একজন পুলিশই বোঝে আরেকজন পুলিশের যাপনের যাতনা। এ কারণে সে অপর পুলিশকে বিপদ থেকে রক্ষার্থে প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পাশে দাঁড়ানোর এই চল প্রায়শই তাকে ক্রাইম পার্টনার করে তোলে।
বাংলাদেশে পুলিশের সাথে ক্ষমতার দ্বৈরথ আছে মূলত আমলাদের। এখন আমলাদের নেতৃত্বে তৈরি সংস্কার কমিশন এই বিশাল ফেলো-ফিলিংসের বাহিনী কি আসলেই গ্রহণ করবে? সংস্কার কি চাপিয়ে দেয়া যাবে? সম্মতি উৎপাদন করা না গেলে এই সুগঠিত বাহিনীর বহু মেকানিজম আছে সংস্কারকে নস্যাৎ করার।
দুনিয়াব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ রিফর্ম ব্যর্থ হওয়ার এটি বড় কারণ। সংস্কার প্রস্তাব কাগজ থেকে বাস্তবতায় আনতে গেলে ওপর থেকে চাপিয়ে সম্ভব না বলেই আমার মত। পুলিশের ট্রেনিংয়ে যে অমানবিকতার পাঠ দেয়া হয়, এরপর তার কাছে মানবিকতা আশা করা দুরূহই বটে।
পুলিশ তো বটেই, সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে 'মাইরের উপর ওষুধ নাই'। এই বিশ্বাস মজ্জায় নিয়ে রিমান্ডে পুলিশ কীভাবে নির্যাতক হবে না? পুলিশ জবরদস্তিমূলক মানসিকতার ওজর হিসেবে আরেকটি বিষয়কে হাজির করে। সেটি হলো জনগণ জোর না করলে নিয়ম মানে না। অর্থাৎ, অবাধ্য জনগণের ফলেই জবরদস্তিমূলক পুলিশিংয়ের জন্ম। কিন্তু, ঘটনাটা ঠিক তার উলটো।
মানুষ যখন রাষ্ট্র ও পুলিশের কাছে ন্যায়মূলক ব্যবস্থার দেখা পায় না। তখনই আইন অমান্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেক্ষেত্রে পুলিশের মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। সে যে মিলিটারি না, এটা বোঝা জরুরি। মিলিটারি কাজ করে ঘোষিত শত্রুর বিরুদ্ধে। সে প্রস্তুত হয় যুদ্ধের জন্য। আর তাই বলপ্রয়োগ তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে পুলিশের কাজ নিরাপত্তাজনিত সেবা দেয়া। সে শত্রুর সাথে লড়াই করে না, নাগরিকের সাথে ডিল করে। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কাজ। এর জন্য এমন প্রোগ্রাম হাতে নেয়া উচিত, এমন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করা উচিত, যা পুলিশের সংস্কৃতিতেই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
পুলিশ বাহিনীর কাঠামো মূলত মিলিটারি কাঠামো। তার র্যাঙ্ক ও প্রোফাইল সেভাবেই সাজানো। তার কমান্ড পালনের ধরনও একইরকম৷ এই কমান্ডকে ধরে রাখতে এবং রাজনৈতিক পুলিশিং ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় ‘বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন’ বা ‘এসিআর’।
এই প্রতিবেদনের ফলে পুলিশ তার ঊর্ধ্বতনের কাছে বাঁধা পড়ে থাকে। সেটার কিছু প্রয়োজনও আছে। কিন্তু সেবা ব্যবস্থার মূল্যায়ন করার কথা সেবাগ্রহিতার। যেমন বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ন করে থাকে শিক্ষার্থীরা। সেবাগ্রহিতা মূল্যায়ন করলে সেবাদাতার দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। কিন্তু পুলিশি প্রক্রিয়ায় সেই দায়বদ্ধতার অস্তিত্ব নেই।
আবার সাংগঠনিক জায়গা থেকে ওসি ব্যবস্থা একটা মোটামুটি ভয়াবহ ব্যবস্থা। এটি ঔপনিবেশিক দারোগা ব্যবস্থারই এক ধরনের সম্প্রসারণ। একটি পুলিশ স্টেশনের প্রায় মালিকানা তার হাতে। এটি যেমন কাজের ক্ষেত্রে অতিকেন্দ্রীকরণ ও জট তৈরি করে, তেমনি এর আছে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য। ৬৪০ জনের মতো ওসি নিয়ন্ত্রণে থাকলেই গোটা একটা দেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক বিষয় থাকলেও বর্তমান লেখার পরিসরে তা আলাপের সুযোগ নেই। আমি মনে করি, পুলিশ সংগঠনকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে৷ বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো অব্যাহত থাকলে তা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে প্রতিহত করবে।
সংস্কারের ব্যাপারে নিরাশ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, সমস্যা নির্ণয় ও ফিজিবিলিটি টেস্ট কিংবা রিয়ালিটি চেক সফল সংস্কারের পূর্বশর্ত। সেই ইঙ্গিতটুকুই এই লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
সামজীর আহমেদ, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি পুলিশের বিউপনিবেশায়ন বিষয়ক গবেষণা ও পর্যালোচনার সঙ্গে যুক্ত।
কেন এত বছর ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি—এর কোনো সদুত্তর কখনোই কোনো সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে পারেনি। বহুদিন ধরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও প্লাটফর্ম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও সে দাবি বাস্তবায়ন করেনি প্রশাসনগুলো।
৫ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ১১টি ইইউ দেশের সঙ্গে যোগ দিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই পদক্ষেপও কি ইউরোপের অসহায়ত্ব ও অপ্রাসঙ্গিকতার আরেকটি উদাহরণ হয়ে থাকবে?
২ দিন আগেসম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পোশাকসংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন ঘিরে নারীর পোশাক-বিতর্ক আবার চাঙা হয়ে উঠেছে। নারীর পোশাক নিয়ে আমাদের সমাজে কারও কারও মধ্যে কেন অস্বস্তি কাজ করে?
২ দিন আগেসীমানা নিয়ে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিবাদের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৮৬৩ সালে কম্বোডিয়ায় ফরাসি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্রান্সের একটি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয় হয় মূলত ১৯০৭ সালে।
৩ দিন আগে