উত্তর প্রজন্মের নারীদের জন্য সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খান প্রায় চল্লিশ বছর কিংবা তারও আগের একটি গার্হস্থ্য নিপীড়নের ঘটনা সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে দারুণ হইচই। হুমায়ূনকে নিয়ে গুলতেকিনের বক্তব্যের পর কেন আমরা পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেলাম?
উম্মে ফারহানা
‘ঠাকুমার ঝুলি’ আর সুকুমার সমগ্রের গল্প কবিতা ছড়ার পরে উপন্যাস হিসেবে প্রথম যে বইটি আমার হাতে আসে তার নাম ‘নুহাশ এবং আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ’। নুহাশ নামে ছোট্ট একটি মেয়ে কীভাবে আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের সাহায্যে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ আটকে দেয়, তা নিয়ে কাহিনি। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী দশ বছর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস যেখানে পেয়েছি গোগ্রাসে পড়েছি। আমার প্রজন্মের অনেকের অভিজ্ঞতাই এ রকম। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূন একটি আবেগঘন লেখা প্রকাশ করেন নিজের প্রয়াত পিতা সম্পর্কে। ভেঙে যেতে থাকা পরিবারে বেড়ে উঠতে থাকা একটি কিশোরের বয়ান অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ছিল। ততদিনে যদিও আমি নিজে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া আর নাটক সিনেমা দেখাও ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু এককালের প্রিয় লেখকের মৃত্যুতে বিচলিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি এবং মানি যে জগতে কোন লেখক-কবি-শিল্পীই সমালোচনার উর্ধে নন। শেকস্পিয়ার চার শ বছর আগে শাইলককে যেভাবে ধর্মান্তরিত করেছিলেন, তা অ্যান্টি সেমিটিজমের দোষে দুষ্ট হয় কি না, সেটি যেমন আলোচনা করা যায়; একইভাবে সমালোচনা করা যায় লিও তলস্টয়ের মতো শেষ বয়সে প্রায় সন্ত বনে যাওয়া মহান লেখকের দাম্পত্য জীবনের স্বেচ্ছাচারিতার। শার্ল বোদলেয়ার সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না, তা জানা তাঁর কবিতা উপভোগ করবার জন্য জরুরি নয়। তবু আমরা এসব জানতে চাই। সিলভিয়া প্লাথ আত্মহত্যা করার পর টেড হিউজ যাঁকে বিয়ে করেছিলেন সেই ক্যারোল অরচার্ডও একই প্রক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার পর পারিবারিক সহিংসতার দায় আর এড়াতে পারেননি এই ‘পোয়েট লরেট’। একজন ব্যক্তি যত বিখ্যাত আর প্রথিতযশাই হোন না কেন, কারও প্রতি করা অন্যায় এবং নিপীড়ন, নিপীড়িতের ক্রন্দন আর অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলা সম্ভব হয় না।
একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেল বাংলাদেশের প্রবাদতুল্য জনপ্রিয়—জীবিত থাকতেই কিংবদন্তি বনে যাওয়া কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ক্ষেত্রে। উত্তর প্রজন্মের নারীদের জন্য সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য প্রয়াত লেখকের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খান প্রায় চল্লিশ বছর কিংবা তারও আগের একটি গার্হস্থ্য নিপীড়নের ঘটনা সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। একই ঘটনার সম্পূর্ণ উল্টো বয়ান আমরা পড়েছি হুমায়ূন আহমেদের আত্মস্মৃতি ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ নামের বইয়ে; যেখানে তিনি নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিরত অবস্থায় মার্কিন মুলুকে নিজের প্রবাস জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের স্বত্ত্বের জায়গায় ‘গুলতেকিন আহমেদ’ হিসেবে যাঁর নাম থাকতে দেখতাম তিনিই গুলতেকিন খান। এই দম্পতির প্রথম কন্যা নোভাকে নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ফেলে আমেরিকা পাড়ি দেওয়া সম্পর্কেও অন্য একটি বয়ান মাত্র দুই-এক দিন আগে আমরা জানতে পারলাম গুলতেকিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে।
গুলতেকিন খানের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নেটিজেনরা পক্ষে-বিপক্ষে এখন অনেক কিছুই বলছেন। যারা তাঁর পক্ষে আছেন, তাঁদের অবস্থান বোধগম্য। নারীবাদ হিসেবে যদি না-ও দেখেন, মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন হলেও যেকোনো সংবেদনশীল ব্যক্তি তাঁর অতীত ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতে দেখলে বিচলিত হবেন, সহমর্মী হবেন—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা গুলতেকিনের বিপক্ষে আছেন, তাঁদের মধ্যে কেন এইটুকু মানবিকতার অভাব? একজন উচ্চশিক্ষিত আর পরিণত বয়সের নারী নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের একটি হিতোপদেশ দিতে চাইলে তাঁদের এত আপত্তি কেন?
আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ হলো, এই কথাগুলো গুলতেকিন খান না বলে অন্য যে কেউ বললে এই বিপক্ষের ব্যক্তিরা তাঁর পক্ষে থাকতেন। কিন্তু প্রিয় লেখকের সৃষ্টি করা হাইপার রিয়েলিটিতে গুলতেকিন একজন রূপকথার রানি, যাঁকে আমেরিকা থেকে দশ পৃষ্ঠার চিঠিতে ‘আমি এনে দেবো তোমার উঠানে সাতটি অমরাবতী’ লিখে পাঠালে তিনি প্রেমাতুর হয়ে এবং বাড়ির সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে কাঁদতে কাঁদতে ছোট বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় উড়াল দেন।
তবে এখন এত দিন পর আমরা গুলতেকিনের যে ভাষ্য শুনতে পাই তা হলো, উনিশ বছরের একটি কম বয়সী মেয়েকে পারিবারিক চাপে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা না দিয়ে বাচ্চা নিয়ে খামখেয়ালি স্বামীর পিএইচডিযাত্রার সঙ্গিনী হতে আমেরিকায় যেতে হয়েছিল। আসলে পাঠকের সামনে সৃষ্টি করা যে আখ্যানের জগত হুমায়ূনকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল, সেই জগতের রূপকথার রাজকন্যা আর রাজপুত্র হলেন নোভা, শীলা, বিপাশা ও নুহাশ। চরিত্র হিসেবে জনপ্রিয়তার দিক থেকে এঁরা প্রায় তিন গোয়েন্দার রবিন, কিশোর, মুসা ও জিনার সমকক্ষ। পাঠককূল দীর্ঘ সময়ের জন্য বিস্মৃত হয়ে ছিলেন যে এই মানুষগুলো আসলে রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদের জীবনেও আছে আমাদেরই মতো সাধারণ সুখ-দুঃখ, সাধারণ রাগ বিদ্বেষ অসূয়া আর প্রতিশোধস্পৃহা।
গুলতেকিন খানের এই বক্তব্য এত দিন পর বোমা ফাটানোর কোনো শক্তিই রাখার কথা নয়। অসুখী দাম্পত্য থেকে তাঁরা দুজনেই বের হয়ে গিয়েছিলেন, দুজনেই বেছে নিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গী আর সঙ্গিনী। মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময়ই মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের ধ্বজা ওড়ানো সাহিত্যিকের জগত আর বাস্তব জগতের মধ্যে ফারাকটা পাঠকদের বুঝে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ এক ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় লেখক। তাঁর অধিকাংশ ভক্তই অন্ধ।
রূপকথার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘দুয়োরানি’র আবির্ভাব ঘটলেও রাজা তখনো থেকে যান সব সমালোচনার উর্ধ্বে। গুলতেকিন আর শাওনের মধ্যে কে সুয়োরানি আর কে দুয়োরানি, সেই বিতর্কে না গিয়েও এ কথা স্পষ্টই বোঝা যায় রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্তের জন্য রাজা দশরথের দোষ যেমন কেউ দেখেনি, দ্বিতীয় রানির আগমনের পরেও লেখককে বহুগামী কিংবা অবিশ্বস্ত হিসেবে খারিজ করতে রাজি হয়নি বিরাটসংখ্যক হুমায়ূন ভক্ত। কিন্তু গুলতেকিন খান সেই রূপকথার রানীর আসন থেকে নেমে সাধারণ এক রক্তমাংসের নারীর মতো হ্যাশট্যাগ মি-টু আন্দোলনে অংশ নেবেন, তা মেনে নিতে বোধ করি অনেকেরই কষ্ট হচ্ছে। এমনকি নারীবাদীদের কেউ কেউ ভাবছেন, এভাবে ভিক্টিমহুড প্লে করাকে আদৌও নারীবাদী অবস্থান বলা যায় কি না। অনেকখানি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সামর্থ থাকার পরেও ২৫/৩০ বছর ধরে নিপীড়কের সঙ্গে আপোষ করে যাওয়া একবিংশ শতকের একটি শিক্ষিত নারীকে মানায়! ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রি আছে, এমন ছাত্রী নিশ্চয়ই তো ‘ডলস হাউস’-এর নোরার কাহিনি জানতেনই।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে হুমায়ূন আহমেদের পরিবার বাংলাদেশের আর দশটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আলাদা কিছুই নয়। এদেশের আরও বহু পরিবারের মায়েরাই স্বামীর মৃত্যুর পর কষ্ট করে সন্তানদের পালন করেন, অনেক ভাই-বোনই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, আমেরিকা থেকে পিএইচডি করেন, উন্নত গবেষণাগারে গবেষণার কাজ করেন। তাঁদের কারও গল্পই আমরা জানতে পারি না। তবে হুমায়ূন আহমেদের কারণেই আমরা জানতে পেরেছি কীভাবে তাঁরা ভাইবোনেরা বাবার কাছে ‘গীতবিতান’ থেকে কবিতা মুখস্ত করার অনুপ্রেরণা পেতেন; কীভাবে তাঁর বিয়ের দিন বাসরঘর সাজানোর জন্য তাঁর ভাই-বোনেরা প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ফ্যান ধার এনেছিলেন। এই পারিবারিক গল্পগুলো পাঠককে পরিবার সম্পর্কে এক ইউটোপিয়ান বিশ্বাস দিতো। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে থাকে অনেক ছোটবড় হিংসা বিদ্বেষ আর রেষারেষিও, থাকে মৃতের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে কাড়াকাড়ি। কিন্তু সেগুলো কখনো হুমায়ূন আহমেদের আখ্যানের জগতে আসেনি। ভক্ত পাঠক ধরেই নিয়েছেন, হুমায়ুনের সৃষ্ট সবকিছুই রূপকথার মতো সুন্দর। কিন্তু তাঁর পরিবারের রক্তমাংসের সদস্যেরা কেউই আসলে রূপকথার চরিত্র নন, হুমায়ূনের মা ভাই-বোন স্ত্রী-সন্তানেরা সেই হাইপার রিয়েলিটির বাইরের বাস্তব মানুষ।
গুলতেকিন খানের প্রতি সমবেদনা যাঁরা দেখাতে পারছেন না কিংবা সমবেদনা থাকলেও তাঁর বর্তমান বক্তব্য প্রকাশের পক্ষে থাকতে পারছেন না, তাঁরা সম্ভবত অমানবিক অসংবেদনশীল নারীবিদ্বেষী মানুষ নন। তাঁরা একদল স্বপ্নালু মানুষ, যাঁরা চোখের সামনে নিজেদের একটা ইউটোপিয়ান জগতকে ভেঙে যেতে দেখে আশাহত হয়ে গেছেন। তাই ভগ্নহৃদয় নিয়ে শাপ-শাপান্ত করছেন গুলতেকিনকে। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, এই গুলতেকিন তাঁদের সেই রূপকথার রানী গুলতেকিন আহমেদ নন, তিনি রক্তমাংসের গুলতেকিন খান। বাস্তবের নুহাশ হুমায়ূনের বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, কোনো আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের সাহায্যে তা ঠেকাতে তিনি পারেন না।
বলাবাহুল্য, এই নুহাশ ডিলিউশনে ভোগাদের মধ্যে আমিও একজন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক
‘ঠাকুমার ঝুলি’ আর সুকুমার সমগ্রের গল্প কবিতা ছড়ার পরে উপন্যাস হিসেবে প্রথম যে বইটি আমার হাতে আসে তার নাম ‘নুহাশ এবং আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ’। নুহাশ নামে ছোট্ট একটি মেয়ে কীভাবে আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের সাহায্যে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ আটকে দেয়, তা নিয়ে কাহিনি। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী দশ বছর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস যেখানে পেয়েছি গোগ্রাসে পড়েছি। আমার প্রজন্মের অনেকের অভিজ্ঞতাই এ রকম। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূন একটি আবেগঘন লেখা প্রকাশ করেন নিজের প্রয়াত পিতা সম্পর্কে। ভেঙে যেতে থাকা পরিবারে বেড়ে উঠতে থাকা একটি কিশোরের বয়ান অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ছিল। ততদিনে যদিও আমি নিজে হুমায়ূন আহমেদের বই পড়া আর নাটক সিনেমা দেখাও ছেড়ে দিয়েছি, কিন্তু এককালের প্রিয় লেখকের মৃত্যুতে বিচলিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি জানি এবং মানি যে জগতে কোন লেখক-কবি-শিল্পীই সমালোচনার উর্ধে নন। শেকস্পিয়ার চার শ বছর আগে শাইলককে যেভাবে ধর্মান্তরিত করেছিলেন, তা অ্যান্টি সেমিটিজমের দোষে দুষ্ট হয় কি না, সেটি যেমন আলোচনা করা যায়; একইভাবে সমালোচনা করা যায় লিও তলস্টয়ের মতো শেষ বয়সে প্রায় সন্ত বনে যাওয়া মহান লেখকের দাম্পত্য জীবনের স্বেচ্ছাচারিতার। শার্ল বোদলেয়ার সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না, তা জানা তাঁর কবিতা উপভোগ করবার জন্য জরুরি নয়। তবু আমরা এসব জানতে চাই। সিলভিয়া প্লাথ আত্মহত্যা করার পর টেড হিউজ যাঁকে বিয়ে করেছিলেন সেই ক্যারোল অরচার্ডও একই প্রক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার পর পারিবারিক সহিংসতার দায় আর এড়াতে পারেননি এই ‘পোয়েট লরেট’। একজন ব্যক্তি যত বিখ্যাত আর প্রথিতযশাই হোন না কেন, কারও প্রতি করা অন্যায় এবং নিপীড়ন, নিপীড়িতের ক্রন্দন আর অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলা সম্ভব হয় না।
একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেল বাংলাদেশের প্রবাদতুল্য জনপ্রিয়—জীবিত থাকতেই কিংবদন্তি বনে যাওয়া কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ক্ষেত্রে। উত্তর প্রজন্মের নারীদের জন্য সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য প্রয়াত লেখকের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খান প্রায় চল্লিশ বছর কিংবা তারও আগের একটি গার্হস্থ্য নিপীড়নের ঘটনা সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। একই ঘটনার সম্পূর্ণ উল্টো বয়ান আমরা পড়েছি হুমায়ূন আহমেদের আত্মস্মৃতি ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ নামের বইয়ে; যেখানে তিনি নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডিরত অবস্থায় মার্কিন মুলুকে নিজের প্রবাস জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের স্বত্ত্বের জায়গায় ‘গুলতেকিন আহমেদ’ হিসেবে যাঁর নাম থাকতে দেখতাম তিনিই গুলতেকিন খান। এই দম্পতির প্রথম কন্যা নোভাকে নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ফেলে আমেরিকা পাড়ি দেওয়া সম্পর্কেও অন্য একটি বয়ান মাত্র দুই-এক দিন আগে আমরা জানতে পারলাম গুলতেকিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে।
গুলতেকিন খানের বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নেটিজেনরা পক্ষে-বিপক্ষে এখন অনেক কিছুই বলছেন। যারা তাঁর পক্ষে আছেন, তাঁদের অবস্থান বোধগম্য। নারীবাদ হিসেবে যদি না-ও দেখেন, মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন হলেও যেকোনো সংবেদনশীল ব্যক্তি তাঁর অতীত ক্ষত থেকে রক্ত ঝরতে দেখলে বিচলিত হবেন, সহমর্মী হবেন—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা গুলতেকিনের বিপক্ষে আছেন, তাঁদের মধ্যে কেন এইটুকু মানবিকতার অভাব? একজন উচ্চশিক্ষিত আর পরিণত বয়সের নারী নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের নারীদের একটি হিতোপদেশ দিতে চাইলে তাঁদের এত আপত্তি কেন?
আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ হলো, এই কথাগুলো গুলতেকিন খান না বলে অন্য যে কেউ বললে এই বিপক্ষের ব্যক্তিরা তাঁর পক্ষে থাকতেন। কিন্তু প্রিয় লেখকের সৃষ্টি করা হাইপার রিয়েলিটিতে গুলতেকিন একজন রূপকথার রানি, যাঁকে আমেরিকা থেকে দশ পৃষ্ঠার চিঠিতে ‘আমি এনে দেবো তোমার উঠানে সাতটি অমরাবতী’ লিখে পাঠালে তিনি প্রেমাতুর হয়ে এবং বাড়ির সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে কাঁদতে কাঁদতে ছোট বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় উড়াল দেন।
তবে এখন এত দিন পর আমরা গুলতেকিনের যে ভাষ্য শুনতে পাই তা হলো, উনিশ বছরের একটি কম বয়সী মেয়েকে পারিবারিক চাপে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা না দিয়ে বাচ্চা নিয়ে খামখেয়ালি স্বামীর পিএইচডিযাত্রার সঙ্গিনী হতে আমেরিকায় যেতে হয়েছিল। আসলে পাঠকের সামনে সৃষ্টি করা যে আখ্যানের জগত হুমায়ূনকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল, সেই জগতের রূপকথার রাজকন্যা আর রাজপুত্র হলেন নোভা, শীলা, বিপাশা ও নুহাশ। চরিত্র হিসেবে জনপ্রিয়তার দিক থেকে এঁরা প্রায় তিন গোয়েন্দার রবিন, কিশোর, মুসা ও জিনার সমকক্ষ। পাঠককূল দীর্ঘ সময়ের জন্য বিস্মৃত হয়ে ছিলেন যে এই মানুষগুলো আসলে রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদের জীবনেও আছে আমাদেরই মতো সাধারণ সুখ-দুঃখ, সাধারণ রাগ বিদ্বেষ অসূয়া আর প্রতিশোধস্পৃহা।
গুলতেকিন খানের এই বক্তব্য এত দিন পর বোমা ফাটানোর কোনো শক্তিই রাখার কথা নয়। অসুখী দাম্পত্য থেকে তাঁরা দুজনেই বের হয়ে গিয়েছিলেন, দুজনেই বেছে নিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গী আর সঙ্গিনী। মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময়ই মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের ধ্বজা ওড়ানো সাহিত্যিকের জগত আর বাস্তব জগতের মধ্যে ফারাকটা পাঠকদের বুঝে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ এক ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় লেখক। তাঁর অধিকাংশ ভক্তই অন্ধ।
রূপকথার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘দুয়োরানি’র আবির্ভাব ঘটলেও রাজা তখনো থেকে যান সব সমালোচনার উর্ধ্বে। গুলতেকিন আর শাওনের মধ্যে কে সুয়োরানি আর কে দুয়োরানি, সেই বিতর্কে না গিয়েও এ কথা স্পষ্টই বোঝা যায় রামচন্দ্রকে বনবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্তের জন্য রাজা দশরথের দোষ যেমন কেউ দেখেনি, দ্বিতীয় রানির আগমনের পরেও লেখককে বহুগামী কিংবা অবিশ্বস্ত হিসেবে খারিজ করতে রাজি হয়নি বিরাটসংখ্যক হুমায়ূন ভক্ত। কিন্তু গুলতেকিন খান সেই রূপকথার রানীর আসন থেকে নেমে সাধারণ এক রক্তমাংসের নারীর মতো হ্যাশট্যাগ মি-টু আন্দোলনে অংশ নেবেন, তা মেনে নিতে বোধ করি অনেকেরই কষ্ট হচ্ছে। এমনকি নারীবাদীদের কেউ কেউ ভাবছেন, এভাবে ভিক্টিমহুড প্লে করাকে আদৌও নারীবাদী অবস্থান বলা যায় কি না। অনেকখানি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সামর্থ থাকার পরেও ২৫/৩০ বছর ধরে নিপীড়কের সঙ্গে আপোষ করে যাওয়া একবিংশ শতকের একটি শিক্ষিত নারীকে মানায়! ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রি আছে, এমন ছাত্রী নিশ্চয়ই তো ‘ডলস হাউস’-এর নোরার কাহিনি জানতেনই।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে হুমায়ূন আহমেদের পরিবার বাংলাদেশের আর দশটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আলাদা কিছুই নয়। এদেশের আরও বহু পরিবারের মায়েরাই স্বামীর মৃত্যুর পর কষ্ট করে সন্তানদের পালন করেন, অনেক ভাই-বোনই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, আমেরিকা থেকে পিএইচডি করেন, উন্নত গবেষণাগারে গবেষণার কাজ করেন। তাঁদের কারও গল্পই আমরা জানতে পারি না। তবে হুমায়ূন আহমেদের কারণেই আমরা জানতে পেরেছি কীভাবে তাঁরা ভাইবোনেরা বাবার কাছে ‘গীতবিতান’ থেকে কবিতা মুখস্ত করার অনুপ্রেরণা পেতেন; কীভাবে তাঁর বিয়ের দিন বাসরঘর সাজানোর জন্য তাঁর ভাই-বোনেরা প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ফ্যান ধার এনেছিলেন। এই পারিবারিক গল্পগুলো পাঠককে পরিবার সম্পর্কে এক ইউটোপিয়ান বিশ্বাস দিতো। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে থাকে অনেক ছোটবড় হিংসা বিদ্বেষ আর রেষারেষিও, থাকে মৃতের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে কাড়াকাড়ি। কিন্তু সেগুলো কখনো হুমায়ূন আহমেদের আখ্যানের জগতে আসেনি। ভক্ত পাঠক ধরেই নিয়েছেন, হুমায়ুনের সৃষ্ট সবকিছুই রূপকথার মতো সুন্দর। কিন্তু তাঁর পরিবারের রক্তমাংসের সদস্যেরা কেউই আসলে রূপকথার চরিত্র নন, হুমায়ূনের মা ভাই-বোন স্ত্রী-সন্তানেরা সেই হাইপার রিয়েলিটির বাইরের বাস্তব মানুষ।
গুলতেকিন খানের প্রতি সমবেদনা যাঁরা দেখাতে পারছেন না কিংবা সমবেদনা থাকলেও তাঁর বর্তমান বক্তব্য প্রকাশের পক্ষে থাকতে পারছেন না, তাঁরা সম্ভবত অমানবিক অসংবেদনশীল নারীবিদ্বেষী মানুষ নন। তাঁরা একদল স্বপ্নালু মানুষ, যাঁরা চোখের সামনে নিজেদের একটা ইউটোপিয়ান জগতকে ভেঙে যেতে দেখে আশাহত হয়ে গেছেন। তাই ভগ্নহৃদয় নিয়ে শাপ-শাপান্ত করছেন গুলতেকিনকে। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, এই গুলতেকিন তাঁদের সেই রূপকথার রানী গুলতেকিন আহমেদ নন, তিনি রক্তমাংসের গুলতেকিন খান। বাস্তবের নুহাশ হুমায়ূনের বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়, কোনো আলাদীনের চেরাগের দৈত্যের সাহায্যে তা ঠেকাতে তিনি পারেন না।
বলাবাহুল্য, এই নুহাশ ডিলিউশনে ভোগাদের মধ্যে আমিও একজন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল তর্ক। তবে এই তর্ক এখন আর শুধু একজন লেখককে ঘিরে নয়, এটি বরং হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের মানুষের মনোভঙ্গী বোঝারও আয়না। কিন্তু কেন?
১ ঘণ্টা আগেইতিহাসের পুনর্লিখন যখন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে ঘটতে শুরু করে, তখন তা কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতকেও বন্দি করে ফেলে। তাই ভারত এক সংকটময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন মূল প্রশ্ন, দেশ কি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিশ্রুতির পথে চলবে, নাকি আরএসএসকে কেন্দ্র করে নতুন জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা তৈরি করবে?
৩ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্রকে পণ্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে। এই পণ্যায়ন শাসনব্যবস্থাকে ঠেলে দিয়েছে তোষামোদী নেটওয়ার্কের হাতে। এর ফলে ভেঙে পড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক সততা ও মানুষের বিশ্বাস। বাংলাদেশে রাজনৈতিক তোষামোদ নিশ্চিত করে যে রাষ্ট্রের সম্পদ, পদায়ন ও চুক্তি সবই যাবে অনুগতদের হাতে।
৩ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে একজন স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতন কত? বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া আইটি খাতের একজন তরুণ পেশাজীবীর বেতনই প্রায়ই এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রভাষকের চেয়ে বেশি!
৬ ঘণ্টা আগে