leadT1ad

আনাস আল শরীফ: মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে সাংবাদিকতা

ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে চার সহকর্মীসহ নিহত হয়েছেন আল-জাজিরার অদম্য সাহসী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আনাস আল শরীফ। এই হত্যা নিছক এক সাংবাদিককে হত্যা করা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক জাতিগত নির্মূল করার বর্বর প্রয়াসের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা।

সেহের দাদজু
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ১৪
আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ১৫
স্ট্রিম গ্রাফিক

মাত্র ২৮ বছরের তরুণ ছিলেন আল-জাজিরার ফিলিস্তিনি প্রতিবেদক আনাস আল শরীফ। স্পষ্টতার সঙ্গে তুলে ধরতেন ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার অমানবিক রূপ। তাঁর প্রতিবেদনে প্রাণহীন শুষ্ক তথ্য ছাড়িয়ে উঠে আসত অবরুদ্ধ জীবনের নিখাদ ও অনাবৃত প্রতিচ্ছবি।

তাঁর ক্যামেরার চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখেছিল বিস্ফোরণ ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের নীরব বিপর্যয়ের দৃশ্য। অনাহারে শুকিয়ে যাওয়া শিশুদের ফাঁকা চোখ, হাসপাতালের উঠোনে তড়িঘড়ি করে হওয়া জানাজা, আর এক জাতির অবিচল ইচ্ছাশক্তি—যারা পৃথিবী থেকে মুছে যেতে চায় না।

যুদ্ধের প্রথম শিকার হয় সত্য। সেখানে শরীফ তাঁর সাহস দিয়ে সাংবাদিকতাকে পরিণত করেছিলেন এক প্রতিরোধে। শীতল পরিসংখ্যানকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন হৃদয়স্পর্শী মানবিক গল্পে। এই গল্প বিশ্বকে উদাসীন না থেকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছিল।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাংবাদিক শরীফ সাংবাদিকতা করতেন মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে। কিন্তু তাঁর অবিচল উপস্থিতি ছিল বিপদের একেবারে মধ্যখানে।

জন্মেছিলেন জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে। তিনি ছিলেন গাজার দুর্ভাগ্যের সন্তান, দ্বিতীয় ইন্তিফাদার শিশু, অবরোধের কিশোর, আর এমন এক যুবক যে বারবার বোমাবর্ষণে হারিয়েছেন নিজের ভিটেমাটি।

উত্তর গাজায় প্রবেশ বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেখান থেকে সংবাদ পাঠাতে গিয়ে আনাস শরীফ তৈরি করতেন বিস্তারিত, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিবেদন। বাইরের পৃথিবীর কাছে তথ্যের ব্যাপক শূন্যতা পূরণ করতেন তিনি। তাঁর সাংবাদিকতা নথিবদ্ধ করেছিল হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের গ্রেপ্তার, আল-শিফা হাসপাতালসহ চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে হামলা এবং অনাহারে কাতর বেসামরিক মানুষের জীবন। নইলে হয়তো ইসরায়েলিদের তৈরি করা এই দুর্ভিক্ষ আর গণহত্যার খবর তাদের কাছ থেকেই পেতে হতো আমাদের।

দূরবর্তী স্যাটেলাইট চিত্র বা পরিমিত ভদ্র সরকারি ভাষার বদলে, শরীফের সরাসরি প্রতিবেদন বলত মাটির গল্প। সেখানে থাকত বিস্ফোরণের ধোঁয়া ও বিশৃঙ্খলা, আহতদের আর্তচিৎকার আর ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের অদম্য দৃঢ়তার কথা।

ইসরায়েলের সরকারি বয়ানের বিপরীতে তাঁর কণ্ঠ তুলে ধরত স্পষ্ট সীমাহীন ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ। যখন খবর হয়ে উঠছিল শুধু ফেসবুক, ইউটিউবের অ্যালগরিদম-নিয়ন্ত্রিত এক অভিজ্ঞতা, তখন তাঁর দেওয়া সংবাদ পৌঁছাত মানুষের কাছে। জাগিয়ে তুলত বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও সংহতি, ত্বরান্বিত করত ত্রাণ প্রচেষ্টা, আর বাড়িয়ে দিত দায়বদ্ধতার দাবি।

শরীফ শুধু ঘটনার প্রতিবেদন করছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক নিয়ামক শক্তি। তিনি বিশ্বকে বাধ্য করছিলেন বন্ধ চোখ মেলে দেখতে।

নিজেই যখন লক্ষ্যবস্তু হলেন

দুনিয়াজোড়া শরীফের প্রভাব তাঁকে ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। ২০২৫ সালের ১০ আগস্ট, আল-শিফা হাসপাতালের কাছে সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি বিমান হামলা চালায়। মুহূর্তেই প্রাণ হারান শরীফ ও আল-জাজিরার তাঁর চার সহকর্মী—মোহাম্মদ কুরেইকেহ, ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নুফাল এবং আরেকজন স্টাফ সদস্য। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে, শরীফ নাকি হামাসের এক গণমাধ্যম ইউনিট পরিচালনা করে ইসরায়েলে হামলার সমন্বয় করছিলেন। এই অভিযোগ আল-জাজিরা ভিত্তিহীন এবং প্রমাণহীন বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

শরীফ ও তাঁর সহকর্মীসহ অনেক সাংবাদিককে ধারাবাহিকভাবে হত্যা করে আসছে ইসরায়েল। এই হত্যাযজ্ঞ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই হত্যা একটি বড় কৌশলের অংশ। ইসরায়েলিদের যুদ্ধাপরাধের দলিলপত্র নষ্ট করতেই তারা সাংবাদিকদের পদ্ধতিগতভাবে লক্ষ্যবস্তু পরিণত করে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ১৭৮ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন। সাংবাদিকতার ইতিহাসে এমন ভয়াবহ নজির কমই আছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শরীফের মতো প্রতিবেদকদের ইসরায়েল সরাসরি হুমকি মনে করে। কারণ তারা যুদ্ধের কুয়াশা ভেদ করে এমন চাক্ষুষ ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ হাজির করেন, যা আন্তর্জাতিক আদালতে ব্যবহৃত হতে পারে। যে প্রমাণ কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

শরীফের ছিল দুনিয়াজোড়া বিশাল দর্শকশ্রেণি। ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতা তিনি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন। এর মধ্যেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। উত্তর গাজার অবরোধের বাস্তবতা তাঁর চাইতে ভাল আর কে বলতে পারত! জোরপূর্বক গাজাবাসীদের উচ্ছেদ যে জাতিগত নিধনে রূপ নিয়েছে, শরীফ তা দুনিয়ার কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। এসব মিলিয়ে শরীফ একাধিকবার হুমকি পেয়েছিলেন ইসরায়েলি বাহিনীর কাছ থেকে। শরীফ ছিলেন সেই সাংবাদিক যাকে ইসরায়েল নিশ্চুপ করাতে চেয়েছিল। তাঁকে হত্যা করা শুধু একজন সাংবাদিককে হত্যা নয়। শরীফকে হত্যা মানে বিশ্বের চোখ অন্ধ করার চেষ্টা, যাতে গাজার ঘটনাগুলো নীরবে, সাক্ষীহীনভাবে ঘটতে পারে।

আল-জাজিরা ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের দমনমূলক ও বৈরী আচরণের শিকার। তাদের ইসরায়েলের ভেতরে কাজ করতে দেওয়া হয় না। ২০২১ সালে আল-জাজিরার গাজার অফিস ধ্বংস করা হয়। শরীফ আর আল-জাজিরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বৃহত্তর আক্রমণের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ইসরায়েলিরা শরীফকে অভিযুক্ত করতে চেয়েছে হামাসের সঙ্গে যুক্ত বলে। তবে এটা সবাই জানে যে, এই ধরনের সম্পর্কের অভিযোগ এক প্রকার অজুহাত। ২০২২ সালে শিরিন আবু আকলেহ হত্যাকাণ্ডের সময়ও একই কায়দা ব্যবহার করেছে ইসরায়েল। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে তিনি সরাসরি ইসরায়েলিদের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন। শরীফের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে একই কৌশল। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে সাংবাদিকরা হয়ে উঠেছেন তথ্যযুদ্ধের সহজ বলি। তাদের অনাহারে রাখা, হুমকি দেওয়া, হত্যা করা শুধু হত্যা ভাবলে ভুল হবে। এই হত্যা তথ্য আর সত্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস। এই হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল ঠিক করে দিতে চায়—আমরা কোন বয়ান শুনব, আর ইতিহাসে কী লেখা থাকবে।

শেষ আবেদন

শরীফের শেষ কথা ছিল অনেকটা উইলের মতো। নিহত হওয়ার আগে রেখে যাওয়া বার্তায় বিশ্বকে এক দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তিনি—‘গাজাকে ভুলে যেও না’। তাঁর উত্তরাধিকার কী কেবল নিস্তব্ধতা? কিন্তু সাক্ষীদের মুছে ফেলা মানেই সত্য মুছে ফেলা নয়।

যখন বিশ্বশক্তিগুলো দোদুল্যমান, কিন্তু জনগণ ফিলিস্তিনে ঘটে যাওয়া গণহত্যার বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে, তখন মানুষের সামনে একটাই পথ থাকে। আর তা হল সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা, যাঁরা সত্য প্রকাশের জন্য সবকিছু বাজি রাখে। এই মানুষগুলোকে রক্ষা না করলে ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়গুলো নথিবিহীনভাবে হারিয়ে যাবে। পরাজিত হবে সত্য।

গাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতরে আনাস আল শরীফের কণ্ঠস্বর রয়ে গেছে। কান না পাতলেও বোমার শব্দে, আহতদের আর্তনাদে, ক্ষুধার্ত শিশুদের চিৎকারে তাঁর কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যাবে। সেই কণ্ঠ আমাদের বলছে, আমরা যেন সেই গল্পগুলো হারিয়ে যেতে না দিই, যেগুলো মুছে দিতে ইসরায়েল মরিয়া।

লেখক: তেহরান টাইমসের সাংবাদিক

Ad 300x250

ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে কোটি কোটি টাকা খরচায় গুপ্তচরবৃত্তি করেছে আ. লীগ

আনাস আল শরীফ: মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে সাংবাদিকতা

মার্কিন শুল্ক ১৫ শতাংশেরও কমে নামানোর চেষ্টা করছে সরকার: বাণিজ্য উপদেষ্টা

জাতীয় যুবশক্তির ইশতেহার ঘোষণা, নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির

সম্পর্কিত