বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বুননশিল্প’কে অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেসকো। দেশের জন্য গর্বের এই উপলক্ষ্যটি আনার যে প্রক্রিয়া, তা শুরুতেই আটকে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছে, ‘বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংবেদনশীলতা’র কথা তুলে ধরে টাঙ্গাইলের শাড়ির বদলে গোপালগঞ্জের নৌকাকে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে তৎপরতা চালিয়েছিলেন ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা। অথচ ইউনেসকোতে জমা দেওয়া তিনটি নথির মধ্যে গোপালগঞ্জের নৌকা ছিলই না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রদূতের ওই ইচ্ছা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে খুশি করতেই গোপালগঞ্জের নৌকার বিষয়টি সামনে এনেছিলেন রাষ্ট্রদূত তালহা। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ তালহা বলছেন, গোপালগঞ্জের নৌকা নিয়ে প্রস্তাব তাঁর ব্যক্তিগত ছিল না। এটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নৌকার বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হয়েছে।
খন্দকার মোহাম্মদ তালহা এখনো প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি ইউনেসকোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিও। ভারতের দিল্লিতে ইউনেসকো ২০০৩ কনভেনশনের ‘২০তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্ষদের’ যে সভায় সর্বসম্মতিক্রমে টাঙ্গাইল শাড়ির বুনন শিল্পকে ‘অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ইউনেসকোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজে (আইসিএইচ) দপ্তরও ফ্রান্সের প্যারিসে। এই সংস্থার সঙ্গে সবধরনের যোগাযোগে বিশেষ ভূমিকা রাখে প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস।
২০২৪ সালের ৫ এপ্রিল সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ফ্রান্স দূতাবাসের প্যাডে দুই পৃষ্ঠার একটি চিঠি পাঠান খন্দকার মোহাম্মদ তালহা। ওই চিঠির একটি কপি স্ট্রিমের হাতে এসেছে।
রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহার চিঠিইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংক্রান্ত ২০০৩ কনভেনশনের আন্তঃসরকার কমিটির ২০তম সেশনে বিবেচনার জন্য তিনটি নথি জমা দেওয়া হয়। এই কমিটির ১৮তম সেশনে ব্যুরো সদস্য ছিলেন খন্দকার মোহাম্মদ তালহা। কমিটির সাবেক একজন সদস্য হিসেবে নিজের ‘লব্ধ অভিজ্ঞতা’ থেকে মতামত দিতেই এই চিঠি লিখছেন বলে নিজেই উল্লেখ করেছেন। সে অনুযায়ী ‘কার্যকর পদক্ষেপ’ নেওয়ারও আহ্বান ছিল চিঠিতে।
চিঠির অনুলিপি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক বিষয়াবলি ও জাতিসংঘ উইংয়ের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের একান্ত সচিবকেও পাঠানো হয়।
চিঠিতে রাষ্ট্রদূত তালহা বলেন, ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর থেকে ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (আইসিএইচ) সংক্রান্ত আন্তসরকার কমিটির ২০তম সেশনে বিবেচনার জন্য তিনটি নথি (সুপারিশ) জমা দেওয়া হয়, যার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির বুননশিল্প রয়েছে। তবে এই নথিগুলো জমা দেওয়ার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা ইউনেস্কোতে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করা হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই পাশের দেশ ভারতের পাওয়ার প্রসঙ্গ ইঙ্গিত করে ওই চিঠিতে তালহা বলেন, শাড়ি নিয়ে আবেদন ‘বৈদেশিক সম্পর্কে প্রভাব’ ফেলতে পারে। এমন বিষয়ে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের পররাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গে আলোচনা না করাকে ‘রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬’-এর পরিপন্থী বলেও উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত তালহা।
ওই চিঠিতে খন্দকার মোহাম্মদ তালহা লেখেন, সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার টাঙ্গাইল শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) সনদ লাভ করেছে, যা বাংলাদেশে এবং প্রবাসে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ শিল্প মন্ত্রণালয় থেকেও টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই নিবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক ‘সংবেদনশীল’ হওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সমীচীন ছিল।
টাঙ্গাইল শাড়ির আবেদন নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলার পর চিঠির ২ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘গোপালগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নৌকা তৈরির শিল্প’কে অগ্রাধিকার দিতে সরাসরি সুপারিশ করেন এ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘জমাকৃত তিনটি নথির মধ্যে কোন নথিটি ২০২৫ সালে বিবেচনার জন্য উপযুক্ত তা নির্ধারণের লক্ষ্যে সব অংশীদারসহ একটি সমন্বয় সভা আয়োজনের অনুরোধ করছি এবং প্রাথমিকভাবে ‘ট্রেডিশনাল বোট-মেকিং আর্ট অব গোপালগঞ্জ’ শীর্ষক নথিটির লেখনি উন্নয়ন ও কারিগরি শর্তাবলি পূরণ করে সম্পূর্ণ নথিটি জমা দানের জন্য বিশেষভাবে সুপারিশ করছি।’
২০২৪ সালের ২৫ মার্চে জাতীয় জাদুঘরের ইউনেসকোর ঐতিহ্য তালিকাভুক্তের সুপারিশের চিঠিতে দেখা যায়, টাঙ্গাইল শাড়ির বুনন শিল্প ও ধামরাইয়ের তামা-কাঁসা শিল্পকে তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে গোপালগঞ্জের নৌকার উল্লেখ নেই।
জাতীয় জাদুঘরের প্রস্তাবের চিঠিএ নিয়ে জাতীয় জাদুঘরের তৎকালীন মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান স্ট্রিমকে জানিয়েছেন, তিনি টানা দেড় বছর সারা বাংলাদেশে ঘুরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। ইউনেসকোর তালিকাভুক্তির জন্য ৯টি ধাপ আছে। সেগুলো ফলো করে একটি তালিকা করেন। ওই তালিকায় গোপালগঞ্জের নৌকাও ছিল। তবে তা টাঙ্গাইলের শাড়ির মতো অত গুরুত্বপূর্ণ নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, খন্দকার মোহাম্মদ তালহা সেই সময়ের আওয়ামী লীগ সরকারকে খুশি করতেই শেখ হাসিনার বাড়ি গোপালগঞ্জ এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকাকে মিলিয়ে ‘গোপালগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নৌকা তৈরিকে’ ইউনেস্কোর ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে সুপারিশ করেন বলে তাঁদের ধারণা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খন্দকার মোহাম্মদ তালহা মোবাইল ফোনে স্ট্রিমকে বলেন, ‘আমি যে চিঠিটা লিখেছিলাম, সেখানে দেখবেন বলা হয়েছে—টাঙ্গাইল শাড়ির ফাইলটার বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা আছে। তাই এই ফাইল দিতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির কথা বলেছি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একা এটা ঠিক করে পাঠিয়ে দিলে হবে না। পরে আমার মন্ত্রণালয় (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) আমাকে ধরবে যে, আমি এটা কীভাবে করলাম।’
আর ঢাকা থেকে যেসব চিঠি ইউনেসকোতে পাঠানো হয়, সেগুলোতে অসংখ্য ভুল থাকে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘তাদের কাজের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। সেটা বোঝানোর জন্যই আমি ওই রেফারেন্স দিয়েছিলাম।’
গোপালগঞ্জের নৌকার বিষয়ে সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আপনারা জানেন। তখন জাদুঘরের ডিজি ছিলেন কামরুজ্জামান সাহেব। উনার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চলছিল। আমার মনে হয়েছিল উনি নৌকার ফাইলটা পাঠাবেন। ফাইলটা যদি ঠিকমতো লেখা না হয় এবং কমিটিতে গৃহীত না হয়, তবে সব দোষ আমার হবে। তখন দোষ আর কামরুজ্জামান সাহেবের থাকবে না। সব দোষ হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বা মিশনের। ফাইল ফেইল করলে আমাদের চাকরি থাকবে না। তাই আমি সুপারিশ করেছিলাম ফাইলের লেখনী ও কারিগরি শর্তাবলি ঠিক করে জমা দিতে। আমি কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ফাইলকে অগ্রাধিকার দিতে বলিনি।’