leadT1ad

পোষ্য প্রাণী: তাদের খাদ্য এবং চিকিৎসায় যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে

আতিকুর রহমান মিঠু
আতিকুর রহমান মিঠু

স্ট্রিম গ্রাফিক

মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সখ্যতা আবহমান কালের। বর্তমানে আমাদের দেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বাড়িতে পোষা প্রাণী বা ‘পেট’ রাখার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে কিংবা শখের বশে অনেকেই কুকুর, বিড়ল বা পাখি পালন করছেন। কিন্তু একটি প্রাণী যখন ঘরে আসে, তখন সে আর কেবল ‘প্রাণী’ থাকে না, হয়ে ওঠে পরিবারেরই একজন সদস্য। আর পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের সুস্থতা, খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক বিকাশের দায়িত্ব পুরোপুরি আমাদের ওপর বর্তায়। বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সময়, যেমন শীতকালে তাদের প্রয়োজন হয় বিশেষ যত্নের। আজকের কলামে আমরা আলোচনা করব পোষ্য প্রাণীর লালন-পালন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের খুঁটিনাটি নিয়ে।

প্রাণী পোষার আগে প্রস্তুতি ও পরিবেশ

যেকোনো প্রাণী ঘরে আনার আগে আমাদের নিজেদের মানসিক এবং পারিপার্শ্বিক প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আবেগের বশবর্তী হয়ে হুট করে একটি প্রাণী নিয়ে আসা উচিত নয়। প্রথমে চিন্তা করতে হবে, আপনি যে প্রাণীটি আনছেন—হোক তা কুকুর, বিড়াল কিংবা পাখি—তার জন্য আপনার বাসায় পর্যাপ্ত জায়গা এবং অনুকূল পরিবেশ আছে কি না।

বিশেষ করে কুকুর বা বিড়ালের মতো প্রাণীরা চলাফেরা করতে পছন্দ করে। তাদের জন্য খোলামেলা জায়গা বা আলো-বাতাসপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এছাড়া আপনি তাকে সময় দিতে পারবেন কি না, সেই বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। প্রাণী পালার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থ হলো, আগামী ১০-১৫ বছরের জন্য একটি প্রাণীর জীবনের দায়িত্ব নেওয়া।

শীতকালে বিশেষ সতর্কতা ও যত্ন

শীতকাল মানুষের মতো পোষা প্রাণীদের জন্যও বেশ চ্যালেঞ্জিং। এ সময় প্রাণীরা, বিশেষ করে যারা বয়স্ক বা খুব ছোট, তারা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ঠান্ডার কারণে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে তারা সহজেই বিভিন্ন ভাইনাস ও ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। তাই শীতের শুরুতেই তাদের জন্য ‘স্পেশাল কেয়ার’ বা বিশেষ যত্ন নিতে হয়।

উষ্ণতা প্রদান ও পোশাক:

শীতের সময় বিড়াল এবং ছোট লোমশ কুকুরদের জন্য উষ্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। কুকুররা সাধারণত বাইরের পরিবেশের সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে নিতে পারলেও, বিড়ালরা উষ্ণতার জন্য খুব কাতর থাকে। এ সময় তাদের জন্য জ্যাকেট, সোয়েটার বা আরামদায়ক পোশাকের ব্যবস্থা করা উচিত। বিশেষ করে ভোররাতে এবং সকালে যখন তাপমাত্রা সবচেয়ে নিচে নামে, তখন তাদের কাপড় পরিয়ে রাখাটা বুদ্ধিমানের কাজ। বর্তমানে বাজারে প্রাণীদের মাপমতো অনেক সুন্দর ও আরামদায়ক পোশাক পাওয়া যায়।

ঘরের ভেতরে রাখা:

শীতকালে পোষ্যদের যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে রাখাই উত্তম। উষ্ণতার খোঁজে তারা প্রায়শই বাইরে চলে যেতে চায়। বাইরে গেলে তারা হারিয়ে যেতে পারে অথবা অন্য অসুস্থ প্রাণীর সংস্পর্শে এসে রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই দরজা-জানালা বন্ধ রাখা এবং তাদের ওপর নজর রাখা জরুরি।

গাড়ির নিচে আশ্রয় ও দুর্ঘটনা রোধ:

যাদের বাসায় গাড়ি আছে, তাদের জন্য একটি বিশেষ সতর্কবার্তা রয়েছে। শীতের রাতে সদ্য বন্ধ করা গাড়ির ইঞ্জিন বা চাকার আশেপাশের জায়গা বেশ গরম থাকে। উষ্ণতার লোভে অনেক সময় রাস্তার কুকুর বা পোষা বিড়াল গাড়ির নিচে বা ইঞ্জিনের ফাঁকে আশ্রয় নেয়। সকালে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সময় চালক যদি খেয়াল না করেন, তবে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই শীতকালে গাড়ি বের করার আগে অবশ্যই গাড়ির নিচটা ভালো করে দেখে নেওয়া এবং প্রয়োজনে বনেট বা হুডে আওয়াজ করে তাদের সতর্ক করা উচিত।

ত্বকের যত্ন ও পরিচ্ছন্নতা

শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় পোষা প্রাণীদের ত্বক মানুষের মতোই শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়। এ সময় তাদের লোম পড়ে যাওয়া, ত্বকে খুশকি হওয়া বা চুলকানির মতো সমস্যা দেখা দেয়। তাই শীতে আপনার পোষা প্রাণীটির ঘন ঘন গোসল করানো যাবে না। ৭ থেকে ১০ দিন পরপর কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানো যেতে পারে। তবে গোসলের পর খুব দ্রুত তাদের শরীর শুকিয়ে ফেলতে হবে, যাতে ঠান্ডা না লাগে।

কুকুর বা বিড়ালকে গোসল করানোর সময় তাদের ত্বকের সুরক্ষায় ভিটামিনসমৃদ্ধ শ্যাম্পু ব্যবহার করা ভালো। এছাড়া শরীরের লোমহীন স্থানগুলো—যেমন নাক, মুখ, চোখের চারপাশ এবং পায়ের তলায়—পেট-ফ্রেন্ডলি ময়েশ্চারাইজার, লোশন বা নারকেল তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে তাদের ত্বক ফাটা রোধ হবে এবং তারা আরাম পাবে।

খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা

ঋতুভেদে প্রাণীদের খাবারের চাহিদাও পরিবর্তন হয়। শীতকালে শরীর গরম রাখতে প্রাণীদের শরীরে ‘শিভারিং’ বা কাঁপুনি হয়, যা তাদের শরীরের কোষ থেকে প্রচুর শক্তি বা ক্যালরি ক্ষয় করে। এই শক্তির ঘাটতি পূরণ করতে শীতকালে তাদের খাবারের পরিমাণ এবং মান—উভয়ই বাড়াতে হয়।

বাড়তি প্রোটিন: কুকুর ও বিড়ালের খাবারে আমিষ বা প্রোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। মাছ, মাংস, ডিমের পরিমাণ সাধারণ সময়ের চেয়ে একটু বেশি দেওয়া উচিত।

ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খাবারের সঙ্গে মাল্টিভিটামিন ড্রপ বা ওষুধ মেশানো যেতে পারে। তবে অবশ্যই তা ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।

কুসুম গরম পানি: ঠান্ডার সময় প্রাণীরা পানি পান করতে চায় না, ফলে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাদের সবসময় কুসুম গরম পানি খেতে দিলে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং ঠান্ডাজনিত গলা ব্যথা থেকেও রক্ষা পায়।

অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে, বাড়ির তৈরি খাবার নাকি প্যাকেটজাত খাবার—কোনটি ভালো?

আসলে এটি নির্ভর করে আপনি প্রাণীটিকে কীভাবে অভ্যস্ত করছেন তার ওপর। বাড়ির তৈরি খাবার দিলে তাতে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটের ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে, বাজারে বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের ‘রেডিমেড ফুড’ বা ‘ক্যাট ফুড/ডগ ফুড’ পাওয়া যায়, যা বেশ সুষম। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে দিনে অন্তত একবেলা প্যাকেটজাত খাবার এবং বাকি সময় বাড়ির তৈরি খাবার দেওয়া একটি ভালো সমাধান হতে পারে।

পাখির যত্ন: একটু বাড়তি সতর্কতা

পাখিরা কুকুর-বিড়ালের চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। তাদের শরীর ছোট হওয়ায় ঠান্ডা তাদের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। সামান্য আঘাতেই তাদের ব্রঙ্কাইটিস, ট্রাকিয়াইটিস বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগ হতে পারে।

বাসস্থান: পাখির খাঁচা এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে সরাসরি ঠান্ডা বাতাস বা কুয়াশা ঢোকে না। বারান্দায় খাঁচা থাকলে শীতকালে তা ঘরে নিয়ে আসা উচিত। যদি বাইরে রাখতেই হয়, তবে খাঁচার তিন পাশ চট বা মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে বাতাস চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকে।

খাবার: পাখিদের জন্য বাজারে বিভিন্ন ধরনের সিড মিক্স পাওয়া যায়। শীতকালে তৈলবীজ জাতীয় খাবার (যেমন সূর্যমুখীর বীজ) তাদের শরীর গরম রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া ডাল ও পোল্ট্রি ফিডও খাওয়ানো যেতে পারে। পানির সঙ্গে ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম মিশিয়ে দিলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

ভ্যাকসিনেশন বা টিকাদান কর্মসূচি

পোষ্য প্রাণীর সুস্থতার মূল চাবিকাঠি হলো সঠিক সময়ে সঠিক টিকা প্রদান। বিশেষ করে শীত আসার আগেই তাদের কৃমির ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় টিকাগুলো দেওয়া উচিত।

কুকুর: কুকুরের জন্য ক্যানাইন ডিসটেম্পার, পারভোভাইরাস, হেপাটাইটিস এবং রেবিস (জলাতঙ্ক) ভ্যাকসিন অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত সিক্স-ইন-ওয়ান বা এইট-ইন-ওয়ান ভ্যাকসিনগুলো বছরে একবার বুস্টার হিসেবে দিতে হয়।

বিড়াল: বিড়ালের ক্ষেত্রে ফ্লু এবং রেবিস ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন। বিড়ালের ফ্লু বা সর্দিজ্বর খুব ছোঁয়াচে এবং কষ্টদায়ক, তাই এর টিকা আগে থেকেই দেওয়া উচিত।

পাখি: পাখিদের জন্য রানীক্ষেত এবং ফাউল পক্সের টিকা নিয়মিত দিতে হয়। সাধারণত ৬ মাস বা ১ বছর পরপর এই টিকাগুলোর শিডিউল থাকে।

যেকোনো টিকা দেওয়ার আগে অবশ্যই রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং টিকার কার্ড বা রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব

আমরা প্রায়ই প্রাণীর শারীরিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিলেও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভুলে যাই। অথচ প্রাণী অধিকার কর্মী এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, পোষ্য প্রাণীর মানসিক প্রশান্তি তাদের আয়ু এবং সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।

একঘেয়েমি কাটাতে এবং তাদের মানসিকভাবে প্রফুল্ল রাখতে করণীয়:

সঙ্গী নির্বাচন: প্রাণীরা একা থাকতে পছন্দ করে না। সম্ভব হলে জোড়ায় জোড়ায় প্রাণী পালা উচিত। যেমন—একজোড়া পাখি বা দুটি বিড়াল একসাথে থাকলে তারা একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করে এবং একাকিত্বে ভোগে না।

মালিকের সঙ্গ ও ভালোবাসা: দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় আপনার পোষ্যকে দিন। তাদের সঙ্গে খেলাধুলো করা, কথা বলা বা আদর করা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য টনিকের মতো কাজ করে।

গ্রুমিং: তাদের লোম আঁচড়ে দেওয়া বা পরিষ্কার করে দেওয়াকে গ্রুমিং বলে। এটি শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয় নয়, এটি মালিক এবং প্রাণীর মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় করে।

পরিশেষে, একটি প্রাণী যখন আমাদের আশ্রয়ে থাকে, তখন তার ভালো-মন্দের সবটুকু দায়ভার আমাদের। শীতের প্রকোপ থেকে তাদের রক্ষা করা, পুষ্টিকর খাবার দেওয়া, সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো এবং সবচেয়ে বড় কথা—তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। মনে রাখবেন, তারা হয়তো আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারে না, কিন্তু আমাদের আচরণ, স্পর্শ এবং যত্ন তারা গভীরভাবে অনুভব করতে পারে। একটু সচেতনতা এবং ভালোবাসাই পারে আপনার প্রিয় পোষ্যটিকে সুস্থ ও দীর্ঘজীবী করতে।

লেখক: কিউরেটর, জাতীয় চিড়িয়াখানা

Ad 300x250

সম্পর্কিত