leadT1ad

বিশ্ব কুকুর দিবস

ভারতে ‘কুকুর বাঁচাও আন্দোলন’: রাজনীতির নতুন নাগরিক ভাষা

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৪৪
আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৫৫
ভারতে ‘কুকুর বাঁচাও আন্দোলন’। ছবি: রয়টার্স

২০২৫ সালের আগস্টে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি ও আশেপাশের এলাকা থেকে সব পথকুকুর সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। আদেশটি দুই সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর করতে বলা হয়েছিল। এই আদেশই জন্ম দেয় ‘কুকুর বাঁচাও’ আন্দোলনের। প্রথমে অনেকের কাছে বিষয়টি হাস্যকর মনে হলেও, শহুরে এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। আদালত শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে শহুরে নাগরিকদের নতুন রাজনৈতিক ভাষাও গড়ে উঠছে কিনা তা নিয়ে ভাবনার অবকাশও ঘটেছে।

কোথায় হয়েছে আন্দোলন

দিল্লির রামলীলা ময়দান, কনট প্লেস ও জন্তর মন্তর, মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দান ও আন্ধেরি, চেন্নাই, কলকাতা ও ভুবনেশ্বর—এসব শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মানববন্ধন, র‍্যালি ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আন্দোলনের ধরন ছিল শান্তিপূর্ণ—মানববন্ধন, ব্যানার, পোস্টার, মোমবাতি, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা। মূল দাবি ছিল কুকুরদের নির্বিচারে সরিয়ে না নিয়ে বন্ধ্যাকরণ ও টিকাদানের মাধ্যমে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা।

আন্দোলনকারীরা কে

শহুরে মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, প্রাণী অধিকারকর্মী ও উদারনৈতিক পেশাজীবীরা আন্দোলনের মূল অংশীদার। নারী অংশগ্রহণ বিশেষভাবে দৃশ্যমান ছিল। কুকুর-বিড়ালদের নিয়ে যারা কাজ করেন, সেই সব সংগঠনের অধিকাংশ নারী। বিশেষ করে তরুণদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আন্দোলনে ছিলেন দিল্লির স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের আশেপাশের কমিউনিটি কুকুরদের উপস্থিতিকে তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও কমিউনিটি স্পেস রক্ষার সঙ্গে এক করে দেখেন। সব মিলিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা সেই জনগোষ্ঠী, যারা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে একাত্ম নয়। বরং নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার রাজনীতির সঙ্গে এদের সাযুজ্য বেশি। ভারতে গো-রক্ষা আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যার ইতিহাস পর্যন্ত সবাই জানে। তবে তাদের কাউকে এ আন্দোলনে টুঁ শব্দটি করতে শোনা যায়নি।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব: বিজেপি ও আরএসএস

কুকুর বিতর্ক বিজেপি ও আরএসএস নেতাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। প্রাণী অধিকারকর্মী ও বিজেপি নেতা মেনকা গান্ধী এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সুপ্রিম কোর্টের আদেশের সঙ্গে একমত নন। অন্যদিকে, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিজয় গোহেল এবং দিল্লির মন্ত্রী পারভেশ বর্মা রাস্তার কুকুর সরিয়ে ফেলার পক্ষে অবস্থান নেন।

ভারতে ‘কুকুর বাঁচাও আন্দোলন’। সংগৃহীত ছবি
ভারতে ‘কুকুর বাঁচাও আন্দোলন’। সংগৃহীত ছবি

১৪ আগস্ট কটক-এ ভাগবত বলেন, “সব প্রাণীর জীবনধারণের অধিকার রয়েছে; দিল্লির পথকুকুর সমস্যার সমাধান শুধু সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সম্ভব, আশ্রয়কেন্দ্রে বন্দী করার মাধ্যমে নয়।” মেনকা গান্ধী মানব-কুকুর সহাবস্থানের পক্ষে লিখেছেন, “প্রায় ২৫,০০০ বছর ধরে মানুষ কুকুরের সঙ্গে বসবাস করছে; তারা আমাদের সুরক্ষা, মানসিক সহায়তা ও সঙ্গ দিচ্ছে।”

বিজয় গোহেল বলেন, “মূল সমস্যা হলো ১০ লাখ পথকুকুর যারা শিশু, বয়স্ক ও নারীদের কামড় দিচ্ছে। কুকুরপ্রেমী ও এনজিওরা আদালতের আদেশের পর প্রতিবাদ করছে, কিন্তু গরু বিষয়ে তারা চুপ কেন?” তিনি টকাতোরা স্টেডিয়ামে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত উদযাপনের জন্য বড় সমাবেশের আয়োজন করছেন।

প্রতিবাদের রাজনৈতিক বার্তা

কুকুর আন্দোলনের মূল ইস্যু ছিল প্রাণী অধিকার। কিন্তু এর ভেতরেই লুকিয়ে ছিল বড় রাজনৈতিক বার্তা। রাষ্ট্র যখন মানুষের ভিন্নমতকে দমন করে, তখন প্রাণীর প্রতি সহিংসতাও প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। আন্দোলনকারীরা বিদ্রূপ করে বলেছেন, “এ কেমন দেশ যেখানে ধর্ষক স্বাধীনভাবে ঘোরে আর শহরের নিরপরাধ কুকুর আটক হয়?’ কুকুর বাঁচানোর আহ্বান অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে গেছে মানুষের অধিকারের স্লোগানের সঙ্গে। আন্দোলনে জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল—আওয়ারা নেহি, হামারা হ্যায়। বেওয়ারিশ নয়, ওরা আমাদের।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল বোধ হয় কুকুরের পক্ষে আয়োজিত সমাবেশে ‘আজাদি’ স্লোগান। এটি বিজেপির জন্য আতঙ্কজনক। কারণ ‘আজাদি’ শ্লোগান রাষ্ট্রের দমননীতির বিরুদ্ধে নাগরিক কণ্ঠস্বরের প্রতীক। একসময় যে স্লোগান কাশ্মীর বা নাগরিকত্ব আন্দোলনে শোনা গিয়েছিল, তা কুকুর বাঁচানোর আন্দোলনেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

কখনো কখনো প্রাণীর জীবনও রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে। নাগরিক বিক্ষোভ আর প্রাণিপ্রেম এক হয়ে গেলে প্রতিরোধের ভাষা বিস্তৃত ও অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ভারতের রাজনীতিতে নতুন দিক

কুকুর বাঁচাও আন্দোলন কয়েকটা দিকে নজর ঘুরিয়ে দিয়েছে। আইনি-নির্দেশ বনাম মাঠের বাস্তবতার মধ্যে পুরোনো ব্যবধান আবার দেখা গেল। শহুরে মধ্যবিত্তের ছোট-ইস্যু দ্রুত ন্যায্যতা-মার্চে রূপ নেবে যদি মিডিয়া-নেটওয়ার্ক আর সংগঠন ছাড়া মানুষ একমত পোষণ করে। সবচেয়ে বড় কথা—সহানুভূতি-ভিত্তিক ইস্যু কখনো কখনো শক্ত-রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে।

কুকুর শুধু কুকুর নয়

এই আন্দোলন বলছে—শহরের বিচ্ছিন্ন নাগরিক অংশের মানুষের ছোট-খাট অনুভূতি ও নাগরিক সরল সহমর্মিতা রাজনৈতিক ভাষায় প্রতিফলিত হতে পারে। রাষ্ট্রের দমনমূলক আচরণ প্রাণিদের প্রতি হলেও নাগরিকেরা তার প্রতিবাদে ধাপে ধাপে প্রতিরোধের নতুন ভাষা তৈরি করবার সম্ভাবনা হাজির করতে পারেন। কুকুর বাঁচানোর আন্দোলনে যদি ‘আজাদি’র শ্লোগান শোনা যায়, তাহলে এর সঙ্গে আরো প্রতিরোধের স্মৃতি এসে হাজির হয়। তখন রাজনৈতিক শ্রেণিভিত্তিক প্রশ্নগুলো ভুলে যাওয়া আরও কঠিন হয়ে যায়। কোন দিন যদি ভারতের দলিত মানুষেরা দিল্লির নাগরিকদের প্রশ্ন করে—কুকুরের প্রাণ যদি মূল্যবান হয়, তাহলে আমরা কেন তোমাদের শ্লোগানের ভাগ পাব না? এর উত্তর কী হবে?

Ad 300x250

সম্পর্কিত