leadT1ad

‘শহিদ’ শব্দটি বাংলা অঞ্চলে যেভাবে প্রচলিত হলো

আদিতে শহিদের ধারণা বাংলা অঞ্চলে মুসলমানি ধারণা আকারেই হাজির ছিল। কিন্তু কীভাবে এই শব্দ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের মধ্যে ঠাঁই করে নিল, তার উৎস খুঁজতে চোখ ফেরাতে হবে এখানকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে।

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২: ২০
আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২: ৪৮
স্ট্রিম গ্রাফিক

শহিদ ও শাহাদাতের ধারণা আদিতে মুসলমানের হলেও উপমহাদেশে মুসলমানের পাশাপাশি হিন্দু, শিখ—সব পরিচয়ের মানুষই ‘শহিদ’ হয়েছে। ‘শহিদ’ ধারণাটি আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ায় একটি প্রায়-সর্বজনীন রাজনৈতিক ধারণা আকারে হাজির।

বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ‘শহিদ’ ধারণাটি কীভাবে আম-বাংলার রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বে ঠাঁই পেল, তার ইতিহাস কখনোই বাংলা ভাষার পরিধির ভেতরে থেকে লেখা সম্ভব নয়। তবু বাংলা ভাষার চিহ্নশালায় এই শব্দের বিবিধ সেরেস্তা সন্ধান করা দরকার। কিছু চিহ্ন টুকে রাখি।

আদিতে শহিদের ধারণা বাংলায় মুসলমানি ধারণা আকারেই হাজির ছিল। শহিদের ধারণা ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তা একটা সাধারণ ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা। বাংলায় হিন্দুসমাজও মুসলমানি সাহিত্যের সমঝদার ছিলেন বলে সেই সূত্রে তাঁরা শহিদ ধারণাটির সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। যেমন ১৮৬১ সালে বর্ধমানের রাজা মহতাবচান্দ বহাদুরের পৃষ্ঠপোষকতায় মুন্সী মহম্মদী, গোলাম রব্বানী ও দুর্গানন্দ কবিরত্ন ফারসি থেকে ‘হাতেম তায়ী’ বইটি অনুবাদ করেন এবং তারকনাথ তত্ত্বরত্ন এটি সম্পাদনা করেন। সেখানে এক গল্পে হাতেম বলেন, ‘সহিদ-ব্যক্তিরা সৰ্ব্বদা জীবিত আছে।’

ঠিক কোন সময় জানি না, একটা পালাবদল আসে ‘শহিদ’ শব্দের প্রয়োগে। সম্ভবত খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন যখন যুগপৎ শুরু হয়, হিন্দি পাঞ্জাবি নানা অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের নবপর্যায় দেখা দেয়, তখন বাংলায় রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের ভাষায় ‘শহিদ’ শব্দটি সর্বজনীন তাৎপর্য লাভ করে।

শহিদের ধারণার স্থানিক সাহিত্যিক অনুরণন মূলত ছিল দুই প্রকার। বাংলায় শহিদের ধারণার প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইসলামের আদিযুগের, বিশেষত কারবালার কাহিনিতে শাহাদাতের কথা। বাংলার মুসলমান সমাজ যুগে যুগে যে কাহিনিতে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত বোধ করেছে কারবালা তার অন্যতম, যা মধ্যকালীন মুসলমান সাহিত্যের বড় বিষয়।

মীর মশাররফ হোসেন কারবালার ‘শহিদ’দের নিয়ে রচনা করেন ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (১৮৮৪)। আম-মুসলমানের জারিগানের মূল বিষয়ও কারবালার শহিদ। আবার সারিগানেও কারবালার শহিদের কথা বলা হতো। ১৯০৫ সালে নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা’র দ্বাদশ ভাগে মোক্ষদাচরণ ভট্টাচার্য্য ‘নিরক্ষর কবি ও গ্রাম্যকবিতা’য় একটি সারিগীত উল্লেখ করেন:

‘আগম নিগম হদিশ কোরাণ পয়দা যার হাতে।

জনম ফৌত আসমান পানি সে দেয় দুনিয়াতে৷

ইমাম হোসেন হজরতের পোতা সহিদ কারবালাতে।

রামের সীতা চুরি গেল অশোকের বনেতে৷

হায় রে হায় এসব খেলা যে খেলেরে ভাই।

লোকে তারে বলে আল্লা হরি কৃষ্ণ সাঁই৷’

মামুলি প্রসঙ্গেও মুসলমানেরা কারবালার শাহাদাতের প্রসঙ্গ টানত। মুন্সী গরিবউল্লার ‘দেলারামের পুথি’তে (১৮৫৬) প্রেমকাতর শাহ তাঁর প্রেমাস্পদকে বলেন, ‘না পেলে তোমার তরে, আরাম না হবে মোরে, সহিদ হইব তোমার এস্কির করবলায়।’

শহিদ বিষয়ক দ্বিতীয় মুসলমানি প্রয়োগ বাংলার পীর বিষয়ক জনস্মৃতিতে। আদম শহীদ থেকে শুরু করে ইসমাইল শহীদ, গোরাপীর প্রমুখের কাহিনিতে পীরকে শহিদ হতে দেখা যায়। এই পীরদের বিষয়টি ভদ্রলোকের সাহিত্যে আসে ভদ্রলোকেরা যখন আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসাহিত্য সন্ধান শুরু করেন তখন।

১৯০৯ সালে ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ পত্রিকার পঞ্চম পর্য্যায়ে হরগোপাল দাস কুণ্ডু, বল্লাল সেনের সঙ্গে তুরকান সহীদের লড়াইয়ের লোকশ্রুতি নিয়ে লেখেন। সেখানে কুণ্ডু মতপ্রকাশ করেন যে বাবা আদমই তুরকান সহীদ।

তেমনি ১৯১০ সালে অচ্যুতচরণ বিদ্যানিধি তাঁর ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইয়ে শাহজালালের অনুচরদের মধ্যে হামজা সহিদ, হুসেন সহিদ প্রমুখের উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, ‘সহিদ শব্দে বিধৰ্ম্মীর সহিত কোনরূপ সংঘর্ষে নিহত।’

এ সময়টা স্বদেশির। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে কিছু টানাপোড়েন তখন দেখা গিয়েছিল। ফলে কুণ্ডুর লেখায় শহিদ পীরের মর্যাদা যে মুসলমানের পাশাপাশি হিন্দু সমাজেও ছিল, সেটা বিশেষ গুরুত্বে উল্লখ করা হয়েছে। কুণ্ডু লেখেন যে শেরপুর হিন্দুপ্রধান অঞ্চল হলেও পীরের দরগার প্রতি হিন্দু-মুসলমানের সমান ভক্তি, এবং ‘সেরপুরের প্রত্যেক জমিদারই এই তুরকান সহীদের দরগায় সিরনি দিয়া থাকেন।’ শেষে তিনি লিখেছেন, ‘ফল কথা হিন্দু-মুসলমানে সম্প্রীতি চিরকালই ছিল; পূৰ্ব্বে ধৰ্ম্মানুষ্ঠানাদি লইয়া হিন্দু-মুসলমানে বিবাদ হইয়াছে বলিয়া শুনি নাই, কিন্তু ভেদনীতিপরায়ণ রাজপুরুষদের কল্যাণে আমাদিগকে অল্পদিন পূর্বে সে দৃশ্য দেখিতে হইয়াছে। ইহাতে লাভ কাহার, আশা করি প্ৰতিবেশী মুসলমানগণ একটু বিবেচনা করবেন।’

বাংলার রাজনীতিতে ‘শহিদ’ শব্দটির পরিপূর্ণ সাঙ্গীকরণ যিনি করেন, তিনি সুভাষ বসু। সুভাষ সর্বভারতীয় পরিসরে রাজনীতি করতেন এবং হিন্দুস্তানি ভাষা-শব্দের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে ‘আজাদি’ শব্দের মতোই শহিদ শব্দকে বাংলার রাজনীতিতে শক্তিশালী করায় সম্ভবত তাঁর ভালো অবদান আছে।

যোগেশচন্দ্র বসু ‘মেদিনীপুরের ইতিহাস, প্রথম ভাগ’-এ (১৯২১) মেদিনীপুরের নানা থানের বিবরণ দিতে গিয়ে লেখেন, ‘চন্দন সহিদ, ইয়াদগার সাহ, বীর পলওয়ান হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বীর নিকট হইতেই সমভাবে শ্রদ্ধা ও পূজা পাইয়া থাকেন।’

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের নতুন বিবেচনার এই মুহূর্তে শহিদ ধারণাটির বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য লেখকদের চোখে ধরা পড়ে। ১৯১১ সালে চন্দ্রশেখর সেন ‘কলিযুগ’ কাব্যে লেখেন:

‘মহাবল-পরাক্রান্ত সেই মুসলমান।

পুণ্যের প্রতাপ যা’র সহায়-সম্বল,

“দীন”-“দীন”-রবে যা’র ধরা কম্পমান,

“বলং বলং ব্রহ্ম বলং” যারে দেয় বল।

“ধৰ্ম্মযুদ্ধে মুতোবাপি তেন লোকত্ৰয়ম জিতম।” দিবানিশি এই মন্ত্র জপিছে ইসলামি;—

“জেহাদে” মরিলে হ’বে অমর-“সহিদ,”

অনায়াসে “রুহ তা’র হ’বে স্বৰ্গগামী।’

এখানে মূলত ইসলামায়নের সোর্ড তত্ত্বের কাব্য বিবরণ তুলে ধরেন চন্দ্রশেখর সেন।

সে সময় ক্ষুদিরাম প্রমুখ বিপ্লবীরা জান দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের ‘শহিদ’ আকারে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। শহিদ তখনও একটা মুসলমানি ধারণা। ১৯১৩ সালে শেখ আবদুর রশীদ ‘হজরত মহম্মদের জীবনচরিত ও ধর্ম্মনীতি’ গ্রন্থে লেখেন, ‘সহিদ (ধৰ্ম্মের জন্য প্ৰাণত্যাগ)’। ১৯২৫ সালে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্পাদিত ‘শিশু-ভারতী’তে মাখনলাল রায়চৌধুরী ‘খেলাফতের অবসান’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘যাহারা শত্রু নিপাত করিয়া যুদ্ধে জয়ী হইত, তাহাদিগকে “গাজী” ও যাহারা যুদ্ধে হত হইত, তাহাদিগকে “শহিদ” বলা হইত। শহিদ ও গাজী উভয়েই স্বৰ্গলাভ করিত। এইরূপ ধৰ্ম্মের প্রেরণাই ইসলামের পৃথিবীজয়ের একটা প্রধান কারণ।’

তবে দেশের জন্য আত্মত্যাগের ভাষা, আবেগ, চিহ্ন, আয়োজন কখনোই ধর্মসুলভ পবিত্রতা, রুহানিয়াত ইত্যাদি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। ফলে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের উদয়ের যুগে এর অন্যবিধ ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রস্তুতি অস্বাভাবিক নয়। ১৯১৬ সালে আবদুল গফুর সিদ্দিকী ‘শহীদ তিতুমীর’ গ্রন্থ রচনা করেন। বইটি আমি দেখিনি। তবে এতে তিতুমীরকে সৈয়দ আহমদ শহীদের ন্যায় ধর্মের শহিদ আকারে নাকি একই সঙ্গে দেশের জন্য শহিদ আকারে দেখানো হয়েছে, তা জানা প্রয়োজন।

ঠিক কোন সময় জানি না, একটা পালাবদল আসে ‘শহিদ’ শব্দের প্রয়োগে। সম্ভবত খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন যখন যুগপৎ শুরু হয়, হিন্দি পাঞ্জাবি নানা অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের নবপর্যায় দেখা দেয়, তখন বাংলায় রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের ভাষায় শহিদ শব্দটি সর্বজনীন তাৎপর্য লাভ করে। ১৯২৩ সালে মতিলাল রায় ‘বিপ্লবী শহীদ কানাইলাল’ নামে বই লেখেন। তারপর প্লাবন আনেন নজরুল, বাংলা ভাষায় ও বাঙালির কল্পনায়। ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থে (আগস্ট ১৯২৪) ‘শহীদী-ঈদ’ কবিতায় নজরুল লিখেছেন:

‘শহীদের ঈদ এসেছে আজ

শিরোপরি খুন-লোহিত তাজ,...

মনের পশুরে কর জবাই,

পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।

কশাই-এর আবার কোরবানী!—

আমাদের নয়, তাদের ঈদ,

বীর-সুত যারা হ’ল শহীদ,

অমর যাদের বীরবাণী।’

সেই সময় শিখদের জাতীয় আন্দোলনের ভাষায় শহিদ শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকা চতুর্বিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯২৪ সালে লেখা হচ্ছে, ‘যাহারা ধর্মের জন্য প্রাণ দেন বা অন্যপ্রকারে দুঃখ বরণ করেন, তাহাদিগকে শহীদ (martyr) বলে। ভারতীয় শিখদের এইসব কাজে যোগ দিবার জন্য আমেরিকা হইতে একদল শিখ শহিদী জথা গঠন করিয়া এদেশে আসিয়াছেন।’

তবে বাংলার রাজনীতিতে শহিদ শব্দটির পরিপূর্ণ সাঙ্গীকরণ যিনি করেন, তিনি সুভাষ বসু। সুভাষ সর্বভারতীয় পরিসরে রাজনীতি করতেন এবং হিন্দুস্তানি ভাষা-শব্দের সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে ‘আজাদি’ শব্দের মতোই শহিদ শব্দকে বাংলার রাজনীতিতে শক্তিশালী করায় সম্ভবত তাঁর ভালো অবদান আছে।

সুভাষ বসু ১৯২৯ সালে ‘তরুণের আহ্বান’ বক্তৃতায় বলেন, ‘আমরা আমাদের আচরণ ও চরিত্রের দ্বারা এ কথা যেন প্রমাণ করিতে পারি যে আমরা মহান শহীদ যতীন্দ্রনাথ দাসের স্বদেশবাসী হইবার যোগ্য। বন্দেমাতরম।’

১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্রে বলেন, ‘ভগবানের নামে এবং অতীতে যাঁহারা ভারতীয় জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন তাঁহাদের নামে, এবং পরলোকগত যে সকল শহীদ আমাদের সম্মুখে বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের মহান আদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন তাঁহাদের নামে—আজ আমরা ভারতীয় জনসাধারণকে আমাদের পতাকাতলে সমবেত হইতে এবং ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য অস্ত্রধারণ করিতে আহ্বান করিতেছি।’

ফলে গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশক থেকে বাংলার রাজনৈতিক ভাষায় শহিদ শব্দটি সর্বজনীন তাৎপর্যে ব্যবহৃত হতে থাকে। যেমন সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন:

‘হাজার হাজার শহীদ ও বীর

স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর

ভুলিনি তাদের আত্মবিসর্জন।’

ফের লিখেছেন :

‘বোম্বাই থেকে শহীদ জীবন আনে সংহতি,

ছড়ায় রক্ত প্লাবন, এদেশে বিদ্যুৎগতি।’

লেখক: প্রাবন্ধিক; সাংবাদিক।

Ad 300x250

সম্পর্কিত