leadT1ad

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বাহাস

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ১২
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ২৪
জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত বিষয় ছিল ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। অভ্যুত্থানের পরপরই বিষয়টি করা না হলেও বছরের শেষ দিকে এসে বিষয়টি নিয়ে জোরালো হতে দেখা যায় অভ্যুত্থানের নেতাদের। এক পর্যায়ে ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করারও ঘোষণা আসে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। তাদের সেই ঘোষণার পরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে দায়িত্ব নিলে সরে আসেন উদ্যোক্তারা।

পরে চলতি বছরের শুরুর দিকে ঘোষণাপত্র নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকের শেষে পরবর্তী কর্মপন্থা হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের কাছ থেকে অভিমত চায় সরকার। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার পর গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে (৫ আগস্ট) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

জুলাই ঘোষণাপত্রে ‌অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে: প্রধান উপদেষ্টা

জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের দিনেই রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার বক্তব্যে নির্বাচন, অর্থনীতির সমসাময়িক বিষয় ছাড়াও জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রসঙ্গও উঠে আসে।

তিনি বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবো। তবে নির্বাচনের আগে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ।’

তিনি আরো বলেন, ‌‌ ‘আজ জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে, সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে আমরা জাতির কাছে জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছি। এই ঘোষণাপত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের মানুষের অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে।’

‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ছাপিয়ে আলোচনায় নির্বাচনের সময়সূচি

জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ নিয়ে বহুল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর তা নিয়ে আলোচনা খুব একটা দেখা দেয়নি। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নির্বাচনের তারিখ প্রসঙ্গেই কথা বলেছে। তবে এরমধ্যে কয়েকটি দল ঘোষণাপত্র ইস্যুতে কথা বলেছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের জুলাই ঘোষণাপত্র অপরিপূর্ণ: এনসিপি

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের পাঠ করা জুলাই ঘোষণাপত্র পরিপূর্ণ নয় বলে প্রতিক্রিয়ায় মন্তব্য করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বুধবার (৬ আগস্ট) রাজধানীতে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে বহুল আকাঙ্ক্ষিত জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছে। আমরা সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে আর কিছু বিষয় যদি ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকতো, তাহলে ঘোষণাপত্রটি পরিপূর্ণ হতো বলে আমরা মনে করি।’

এনসিপির লোগো। সংগৃহীত ছবি
এনসিপির লোগো। সংগৃহীত ছবি

আখতার হোসেন আরও বলেন, ‘ঘোষণাপত্রের পরিপূর্ণতার জন্য আমরা দীর্ঘ সময় সরকারের কাছে যে দাবিগুলো জানিয়ে এসেছি, তার কিছু বিষয় এখানে অনুপস্থিত। আমরা যদি একেবারে শুরুর দিকে খেয়াল করি, এখানে উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের কথা এখানে উল্লেখ করা হয় নাই। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্র পাওয়ার পেছনে ৪৭, ৭১ এবং ২৪ এর যে আন্দোলন, এর সব কিছুর সম্মিলন এই ঘোষণাপত্রকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারত।’

শহীদের সংখ্যা বিষয়ে আখতার বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্রে শহীদের সংখ্যার ব্যাপারে "প্রায় এক হাজার" শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানে ১৪০০ জন মানুষ শহীদ হয়েছেন। সেক্ষেত্রে সরকার গত এক বছরে শহীদ ও আহতের সংখ্যা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে, তার একটা ছাপ আমরা এই ঘোষণাপত্রে দেখতে পেলাম।’

এনসিপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের মানুষ যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে, গত ষোল বছরের জার্নিতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো, তার অনেক বিষয় এখানে অনুপস্থিত থেকে গেছে। যেমন পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা গণহত্যা, জুডিসিয়াল কিলিং, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, আবরার ফাহাদের হত্যার বিরুদ্ধে আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলন এবং মোদিবিরোধী আন্দোলনের কথা উল্লেখ থাকলে এই ঘোষণাপত্র পরিপূর্ণ হতে পারত।’

নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যখন এই ঘোষণাপত্রকে পরবর্তী সংস্কারকৃত সংবিধানের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, স্বভাবতই আমরা যে নতুন সংবিধানের দাবি জানিয়েছি, সেটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। আমরা এখনো নতুন সংবিধান এবং সেই সংবিধানের প্রস্তাবনার মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাই।’

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ প্রসঙ্গে আখতার হোসেন বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্রে আমাদের অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে হলো৷ আমরা ঘোষণাপত্র পেলাম, পরিপূর্ণতার অভাব রয়ে গেল।’ তবে 'দিনশেষে জুলাইয়ের স্বীকৃতির দলিল পাওয়াটা অর্জন' বলেও উল্লেখ করেছেন আখতার হোসেন।

জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি

এনসিপি পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের ঘোষণা গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সুগম করবে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ছবি: সংগৃহীত

বুধবার (৬ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মানুষের সেই সংঘবদ্ধ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ফ্যসিস্ট হাসিনা। এই অভ্যুত্থানের ফলে মানুষের মনে আবারও সৃষ্টি হয় এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আশা।

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যারা হতাশ হয়েছে বলেছে, তারা সারা জীবনই হতাশ থাকে।’

জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে জুলাই ঘোষণাপত্র, স্বাগত জানাই: তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছে। আমরা এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

বুধবার (৬ আগস্ট) রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ পার করছি। এর জন্য জনগণকে দেড় দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।’

সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন তারেক রহমান। ছবি বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে নেওয়া
সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন তারেক রহমান। ছবি বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে নেওয়া

এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশ করে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে। মতভেদ নিরসনে আলোচনা হবে। তবে জাতীয় পরিষদে গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর যাতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ না হয়, সেজন্য জাতীয় স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি, জাতীয় স্বার্থে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। ধর্ম, দর্শন, মত যাঁর যাঁর, রাষ্ট্র আমাদের সবার।’

প্রধান উপদেষ্টার জুলাই ঘোষণাপত্র একটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি: জামায়াত

প্রধান উপদেষ্টার ২৮ দফার জুলাই ঘোষণাপত্রকে একটি ‘অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি’ বলে আখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ‘কখন, কীভাবে’ এটি কার্যকর করা হবে উল্লেখ না করে ঘোষণাপত্রটিকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছে দলটি।

মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর আল-ফালাহ মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের।

তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। পরবর্তী সরকারের হাতে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাইয়ের চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের এই রূপরেখা প্রত্যাশা পূরণ না করায় জনগণের মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি।

জুলাই ঘোষণাপত্রকে আইনি ভিত্তি দিয়ে এটিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৯ দফা যা এক দফায় রূপান্তরিত হয়েছিল; সে বিষয়টিও ঘোষণাপত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। এ জন্য ৬টি কমিশন গঠন করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দুই পর্বে দুই মাসেরও বেশি সময় আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার জুলাই ঘোষণাপত্রে এসবের উল্লেখ নেই। ঘোষণাপত্রটি কখন কীভাবে কার্যকর করা হবে তাও উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।

সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবেন। তা না করায় জাতি হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করার দীর্ঘ দিনের যে ঐতিহ্য তা উপেক্ষা করে জুলাই ঘোষণার দিনেই নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে।‘ এরপরও জাতীয় স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে জামায়াত।

জুলাই ঘোষণাপত্র অর্জন: জোনায়েদ সাকি

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের অনুষ্ঠানে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের মঞ্চে ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এই ঘোষণাপত্র ২৪-এর জুলাইয়ের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানেরই অর্জন, সেকারণে এর আকাঙ্ক্ষাকে আমরা পূর্ণভাবে ধারণ করি। মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের মানুষের শত শত বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে আমরা মনে করি।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। সংগৃহীত ছবি
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। সংগৃহীত ছবি

তিনি যোগ করেন, কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন না করা হলে অতীতের মতোই পুরোনো বন্দোবস্ত আবারও ফেরত আসবে, জনগণকে অধিকারহীন করবে।

তিনি উল্লেখ করেন, কাজেই আমরা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানাবো, প্রতিটি মানুষ যেনও এক হয়ে জুলাইয়ের হত্যাযজ্ঞের বিচার, শহীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ায় জাগ্রত পাহারাদার হয়ে থাকেন। ন্যায়বিচার, সংস্কার, নির্বাচনের পথেই যা অর্জিত হবে।

জোনায়েদ সাকি বলেন, সংগঠিত মানুষই ইতিহাসের নির্মাতা, তারা জেগে থাকলে ফ্যাসিবাদ আর ফেরত আসতে পারবে না।

ঘোষণাপত্রের কয়েকটি দফা নিয়ে আপত্তি গণঅধিকার পরিষদের

ঘোষণাপত্রের কয়েকটি দফা নিয়ে আপত্তি তুলেছে গণঅধিকার পরিষদ। দলটির পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের ১৬ নং দফায় বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিলোপ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ইত্যাদি...২০২৪ সালে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে বাতিল হওয়া কোটার অংশবিশেষ (৩০ শতাংশ) হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে ফিরে না এলে নতুনভাবে আন্দোলনের সূচনা হতো না। এখানে দুর্নীতি প্রতিরোধ বা অন্য কোনও দাবিতেও আন্দোলন শুরু হয়নি। অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট কোটা সংস্কার আন্দোলন।’

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন রাশেদ খান। সংগৃহীত ছবি
সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন রাশেদ খান। সংগৃহীত ছবি

তিনি বলেন, ‘কিন্তু এই আন্দোলনের ইতিহাস বাদ দিয়ে মিথ্যা ইতিহাসের ওপর জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, গণঅধিকার পরিষদ ও ছাত্র অধিকার পরিষদের ১৮ থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস বাদ দিতে পরিকল্পিতভাবে জুলাই ঘোষণাপত্রে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। ইতিহাস বিকৃতি বড় ধরনের অপরাধ। জুলাই ঘোষণাপত্রের এই ইতিহাস আগামী প্রজন্মকে মিথ্যা শেখাবে। ঠিক ৭১ নিয়ে যেভাবে আমাদের মিথ্যা শেখানো হয়েছে। তাহলে আওয়ামী লীগের তৈরি ইতিহাস ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৈরি ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?’

জুলাই ঘোষণাপত্রের ১৭ নং পয়েন্ট নিয়েও প্রশ্ন তোলে গণঅধিকার পরিষদ। রাশেদ খান বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের ১৮ নং পয়েন্টে বলা হয়েছে, গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়.... হাসিনা কি সত্যিই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়? আজও আমরা জানি না কীভাবে হাসিনা ভারতে চলে গেলো?’

গণঅধিকার পরিষদের অভিযোগ, জুলাই ঘোষণাপত্র থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড, নরেন্দ্র মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড, পরিকল্পিত বিডিয়ার বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন সেনা অফিসারের হত্যাকাণ্ড, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি স্থান পায়নি।

‘এসব ঘটনা এই প্রজন্মের মস্তিষ্ক ও মনস্তত্ত্বে বিপ্লবের বীজ বপণ করে ও তারুণ্যকে বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করে। কিন্তু কেন ও কোন উদ্দেশ্য তারুণ্যের এই সংগ্রামকে জুলাই ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হলো না?’ প্রশ্ন পরিষদের।

সন্তুষ্ট নন মাওলানা মামুনুল হক

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার পাঠ করা জুলাই ঘোষণাপত্র, ঘোষণার আয়োজন এবং একটি মাত্র দলের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা— সব কিছুই প্রমাণ করে, ইসলামপন্থিদের মতামত, আত্মত্যাগ ও সাংগঠনিক ভূমিকাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এটি শুধু দুঃখজনক নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অবহেলার শামিল।

মামুনুল হক। সংগৃহীত ছবি
মামুনুল হক। সংগৃহীত ছবি

বুধবার (৬ আগস্ট) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা রক্ত দিয়েছেন— আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্র, প্রবাসী এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ভূমিকাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ১৯৪৭-এর আজাদী, ২০১৩-এর শাপলা চত্বর গণহত্যা, পিলখানা ট্র্যাজেডির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনারও কোনও উল্লেখ নেই। অথচ এগুলোই বাংলাদেশে স্বৈরাচার পতনের ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এ উপেক্ষা ইতিহাসের প্রতি চরম অবিচার।

মাওলানা মামুনুল হক বলেন, যারা বিগত দেড় দশক ধরে ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন—মূলধারার ইসলামী নেতৃত্বের এমন কেউই গতকালের মঞ্চে স্থান পাননি। তাদের সঙ্গে কোনও পরামর্শও করা হয়নি। বরং একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মতামতের ভিত্তিতেই সব কিছু চূড়ান্ত করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, অজস্র মানুষের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনার বাস্তবায়নকে ভবিষ্যৎ সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যা জুলাই অভ‍্যুত্থানের চেতনা ও সংস্কারের গণদাবির সঙ্গে তামাশা ছাড়া কিছু নয়। প্রধান উপদেষ্টা বিজয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতির সঙ্গে নির্মম সেই তামাশাটাই করলেন।

তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণার পূর্বে যদি ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হতো, তাহলে আমরা একটি বাস্তবসম্মত, গ্রহণযোগ্য এবং জাতীয় ঐক্যভিত্তিক রূপরেখা পেতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাও হয়নি। আবারও জনগণকে প্রতারিত করা হয়েছে।

মামুনুল হক সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নির্বাচনের আগে সব দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অধ্যাদেশ জারি করে ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জুলাই জাতীয় ঘোষণাপত্র’-কে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং তাতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। অন্যথায় এই ঘোষণাপত্র, নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গোটা উদ্যোগই জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।

ঘোষণাপত্রে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে: মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম

জুলাই ঘোষণাপত্রে একাত্তর, পঁচাত্তর, ৭ নভেম্বর ও নব্বইয়ের আন্দোলনসহ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় সাতচল্লিশ এবং পতিত ফ্যাসিস্ট আমলের সবচেয়ে নির্মম শাপলা হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও আলেম-উলামার প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ না করে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে করে ইসলামী আন্দোলন। দলটি বলছে, এতে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।

মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম। সংগৃহীত ছবি
মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম। সংগৃহীত ছবি

মঙ্গলবার পুরানা পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এমন দাবি করেন ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই)।

জুলাই ঘোষণার রাজনীতিকীকরণ হয়েছে, দাবি বার্গম্যানের

জুলাই ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের পতিত আওয়ামী লীগের চিত্রায়ণে একপাক্ষিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট)নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন,ঘোষণার কোন অংশগুলো তার কাছে একপাক্ষিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়েছে। ঘোষণার শুরুতে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বয়ানটি নিয়ে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে ইতিহাসের রাজনীতি নিয়ে যে সমালোচনা ছিল, এই ঘোষণায় সেটা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

ঘোষণার কিছু ভুলও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। যেমন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধপরবর্তী দেশ গঠনের বিষয়টি পুরো উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের তৎকালীন শাসনামলকে কেবল একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।

এ ছাড়া, যুদ্ধপরবর্তী দেশে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে ঘোষণায় দায় চাপানো হয়েছে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার দুর্বলতার ওপর। এখানে আপত্তি জানিয়ে বার্গম্যান বলেন, সে সময়ে আওয়ামী লীগ সন্দেহাতীতভাবেই অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে অভিযোগ কেবল নতুন সংবিধান প্রণয়নে আগ্রহীদের বয়ান জোরালো করতেই উত্থাপন করা হয়ে থাকতে পারে।

জুলাই ঘোষণায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উহ্য রাখার বিষয়টি নিয়েও আপত্তি জানান বার্গম্যান। তিনি বলেন, ঘোষণাটিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে হত্যার মতো ঘটনা পুরো অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ ওই হত্যাকাণ্ডের পরই দেশটি বহু বছরের জন্য সেনা শাসনের অধীনে চলে যায়।

১/১১-এর চক্রান্তে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে- ঘোষণার এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বার্গম্যান বলেছেন, কিছু স্থানে ভোট কারচুপির অভিযোগ থাকলেও, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনকে ধরা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচন।

আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলকে ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী দাবি করার বিষয়ে বার্গম্যানের মন্তব্য, দলটি শুরুতে অগণতান্ত্রিক ছিল না, বরং দিনকে দিন তারা অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয়েছে।

ঘোষণাজুড়ে আওয়ামী শাসনামলকে জনবিরোধী, স্বৈরাচারী, মানবতাবিরোধী, দেশকে মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণতকরণ, লুটপাটের মহোৎসব ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করার বিষয়ে তিনি বলেছেন, অভিযোগগুলোর অবশ্যই সত্যতা রয়েছে। তবে এগুলো খুবই একপাক্ষিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সাবেক ক্ষমতাসীন দলের এই কালো অধ্যায়ের পাশাপাশি আরেকটা অধ্যায় ছিল, যেমন ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি, নারী শিক্ষা, জলবায়ু নিয়ে সচেতনতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যা পুরো উপেক্ষা করা হয়েছে।

অবশ্য ঘোষণার কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেছেন তিনি। বার্গম্যান বলেন, জুলাই ঘোষণায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যথাযথ সম্মান দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, গত বছরের আন্দোলনে আহত-নিহতের অতিরঞ্জিত সংখ্যার বদলে যুক্তিসংগত সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে।

জুলাই ঘোষণাপত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়কেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন বার্গম্যান। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনের পর নিজের পরিণতির অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছেন ড. ইউনূস। তবে পুরো ঘোষণাটি আরও সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বার্গম্যান।

যা আছে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে’

ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের সুদীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। বাংলাদেশের আপামর জনগণ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রনয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ করেছিল।

এতে বলা হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়। আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছর ছাত্র-জনতার অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ১৯৯১ সালে পুনরায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

‘দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় এক-এগারোর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়। গত দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এবং একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অতি উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সংবিধানের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন করা হয় এবং যার ফলে একদলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, আইন-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে।’

ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, হাসিনা সরকারের আমলে তারই নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত পতিত দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ১৬ বছর ধরে নিরন্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষণ ও খবরদারিত্বের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে বহিঃশক্তির তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে। অবৈধভাবে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন) এ দেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে। আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে ছাত্র, চাকরিপ্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ওপর চরম নিপীড়নের ফলে দীর্ঘদিন ধরে জনরোষের সৃষ্টি হয় এবং জনগণ সকল বৈধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই চালিয়ে যায়। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিলোপ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন, বর্বর অত্যাচার ও মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, যার ফলে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ণনা দিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদী বাহিনী রাজপথে নারী-শিশুসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে। অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনগণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে, পরবর্তী সময়ে ৫ আগস্ট ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনরত সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সকল শ্রেণী, পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবিলায় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগ রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বলেও ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, জনগণের দাবি অনুযায়ী এরপর অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়। বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে বলেও ঘোষণাপত্রে উল্লেখ আছে।

ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ বিগত ১৬ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম কালে এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সকল ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে প্রয়োজনীয় সকল আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

‘বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসঙ্গত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশের জনগণ এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে যে একটি পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত হবে।’

ঘোষণাপত্রে এ-ও বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।

Ad 300x250

সম্পর্কিত