প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনে রাষ্ট্রের ৩৫৮ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধনের অভিযোগে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালকসহ ছয়জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে প্রকল্পটিকে লাভজনক দেখিয়েছিলেন বলে মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে।
গত ১৩ নভেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১-এ মামলাটি দায়ের করেন।
আজ রোববার (১৬ নভেম্বর) দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের মামলা দায়েরের তথ্য জানান।
মামলার আসামিরা হলেন- বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. মিজানুর রহমান, সাবেক মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক মো. হারুন-অর-রশীদ, প্রকল্প পরিচালক আব্দুল মতিন চৌধুরী এবং প্রকল্প সম্ভাব্যতা যাচাই প্রণয়ন কমিটির সদস্য আহমেদ মাহবুব চৌধুরী (অতিরিক্ত প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার) ও মৃণাল কান্তি বনিক (পরিচালক)।
দুদকের এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে ‘রোলিং স্টক অপারেশনস ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ৫০টি ব্রড গেজ (বিজি) এবং ৭৫টি মিটার গেজ (এমজি) লাগেজ ভ্যান কেনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই ক্রয়ের জন্য মোট ৩২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকার বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছিল। প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) বলা হয়েছিল, এই লাগেজ ভ্যানগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষকদের উৎপাদিত শাকসবজি, ফল ও অন্যান্য পচনশীল পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হবে।
তবে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, প্রকল্পটি গ্রহণের আগে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি), বাস্তবসম্মত বাজার চাহিদা বা লজিস্টিকস প্রতিবন্ধকতা বিশ্লেষণ করা হয়নি। কৃষক বা ব্যবসায়ীদের চাহিদা যাচাই না করেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই ক্রয় প্রস্তাব করা হয়।
এজাহারে আরও বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রকল্পটিকে লাভজনক হিসেবে দেখান। সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি প্রকল্পটিকে অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপযোগী হিসেবে ব্যাখ্যা করে। ডিপিপিতে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল যে, এই খাত থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা মুনাফা অর্জিত হবে।
কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) লাগেজ ভ্যানগুলো থেকে আয় হয়েছে মাত্র ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। দুদক এই আয়ের গরমিলকে ‘প্রকল্প লাভজনক দেখানোর জন্য হিসাব বিকৃতি’ বলে উল্লেখ করেছে।
এজাহারে বলা হয়, রেলওয়ের অবকাঠামোতে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই লাগেজ ভ্যানগুলো কেনা হয়, যার মাধ্যমে আসামিরা অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে রাষ্ট্রীয় ৩৫৮ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেছেন। এই অভিযোগে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলাটি রুজু করা হয়েছে।
এ বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিক অনুসন্ধানেই স্পষ্ট যে, এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্রয় ছিল। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কেনা হয়েছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডিপিপি অনুমোদন করিয়ে অভিযুক্তরা রাষ্ট্রকে ৩৫৮ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেছেন।’