leadT1ad

‘গাজায় পারমাণবিক হামলা’র ডাক দিচ্ছে আমেরিকা-ইসরায়েল

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৩৬
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত একটি এলাকা। ছবি: সংগৃহীত

২০২৫ সালের ২২ মে সকাল। হিরোশিমা শান্তি স্মৃতিপার্কে নীরবতা পালন হচ্ছে। এরপর বের করে আনা হলো ১৯৪৫ সালের পারমাণবিক হামলায় নিহত ব্যক্তিদের নামের তালিকা।

এই তালিকায় রয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৩০৬ জনের নাম। বহু খণ্ডের সেই তালিকার একটি খণ্ডে আছে শুধু অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের তালিকা। হিরোশিমা দিবসের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে, প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের সেই স্মৃতিসৌধের ভেতর দেখার সুযোগ দেওয়া হয়।

জাপান যখন হিরোশিমায় নীরবে মৃতদের স্মরণ করছিল, ঠিক সেই দিনই ফক্স নিউজে মার্কিন কংগ্রেসম্যান র‍্যান্ডি ফাইন গাজায় পারমাণবিক হামলার আহ্বান জানান।

র‍্যান্ডিই যে প্রথম এমন আহ্বান জানালেন, তা কিন্তু নয়। এর আগেও, ২০২৪ সালের মার্চে আরেক কংগ্রেসম্যান টিম ওয়ালবার্গ গাজায় হিরোশিমা ও নাগাসাকির মতো হামলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারও আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে, ইসরায়েলের এক মন্ত্রী আমিখাই এলিয়াহু বলেছিলেন, গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলা উচিত। সমালোচনার মুখে অবশ্য পরে তিনি দাবি করেন, তাঁর সে মন্তব্য ছিল ‘রূপক অর্থে’। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তখন তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। সংসদ কার্যবিবরণি থেকে বক্তব্যটি সরিয়ে ফেলে।

ইসরায়েল যখন গাজায় বর্বর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তখন পৃথিবীজুড়ে বহু জনসভা, অনেক বিশ্লেষক ও নাগরিক হিরোশিমা-নাগাসাকির সঙ্গে গাজার পরিস্থিতির তুলনা করছেন।

খোদ জাপানে আমেরিকান আর ইসরায়েলি এইসব মন্তব্যে ক্ষোভ জন্মেছে। কারণ, দেশটির জনগণ পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা নিজের শরীর-মন আর ইতিহাসে বয়ে বেড়াচ্ছে আজও। আর যুদ্ধবিরোধী ও ফিলিস্তিনপন্থী জনমত ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে জাপানে।

২০২৪ সালে সেই পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের সংগঠন ‘হিদানকিয়ো’ নোবেল শান্তি পুরস্কার পায়। তাদের একজন নেতা তোশিয়ুকি মিমাকি বলেন, এই সম্মান আসলে গাজার সাহায্যকর্মীদের প্রাপ্য।

সেই বছর পারমানবিক বোমা ফেলার বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানে নাগাসাকির মেয়র ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে শহরে আমন্ত্রণ জানাননি। এতে ইসরায়েল ক্ষুব্ধ হয়।

জাপানে এই জনমত শুধু নাগরিক পর্যায়েই নয়, রাজনৈতিকভাবেও প্রভাব ফেলছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে, নতুন বামপন্থী দল ‘রেইওয়া শিনসেংগুমি’ পার্লামেন্টে বড় জয় পায়। দলটির অবস্থান স্পষ্ট। তারা জায়নবাদবিরোধী ও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে।

জাপানে পারমাণবিক ধ্বংস আজও জীবন্ত স্মৃতি। সেই দেশের নাগরিকরা গাজার জন্য যে সহানুভূতি ও সংহতি প্রদর্শন করছেন, তা শুধু মানবিক নয়, ঐতিহাসিকভাবেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ।

যে দেশ একসময় পারমানবিক বোমার আক্রমণে এমন বিপর্যয় আর গণহত্যার শিকার হয়েছিল, তার মানুষরা আজ একই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। এই অবস্থান কেবল নৈতিক নয়। তার রয়েছে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা। সেই বার্তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে এখনও মানুষ বিভেদ, বিদ্বেষ ও সহিংসতার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি।

স্মৃতি আবার জেগে ওঠে

গাজা থেকে আসা দগ্ধ শিশুদের ছবি, কঙ্কালসদৃশ দেহ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত শহর—জাপানিদের মনে নিজেদের এক পুরনো স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। সৃষ্টি করে গভীর অভিঘাত। এমন কিছুর মাঝখান দিয়ে তারা নিজেরা পার হয়েছে। তারা এর বেদনা বোঝে।

১৯৪৫ সালের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ভয়াল দৃশ্য। সম্পূর্ণ গুড়িয়ে যাওয়া দুটো শহর। মার্কিন সেনারা যে সব ছবি তুলেছিল, সেগুলো পরে ফরাসি সিনেমা ‘হিরোশিমা মন আমোর’-এ ব্যবহৃত হয়।

আজকে গাজায় ইসরায়েলি সেনারা নির্যাতনের ছবি নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে বলছে ‘যুদ্ধাপরাধের লাইভ সম্প্রচার’। গাজায় ইসরায়েলিদের যুদ্ধ শুধু ধ্বংসলীলা নয়। এই বর্বর যুদ্ধ একটি মঞ্চায়িত সহিংসতাও। শিশু হত্যা সেখানে বিনোদন।

হ্যাঁ, জাপান এক সময় উপনিবেশবাদী শক্তি ছিল। তারা যুদ্ধাপরাধও করেছিল। কিন্তু হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা ফেলা হয়েছিল যুদ্ধ থামানোর জন্য নয়। তার লক্ষ্য ছিল বরং পরবর্তী দখলদার শক্তি হিসেবে আমেরিকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই জাপান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শান্তি আলোচনা চলছিল। হিরোশিমাকে টার্গেট করাও পূর্বনির্ধারিত ছিল না। বোমা ফেলার দিন শহরটির আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সেই শহর বেছে নেওয়া হয়।

যুদ্ধ নিয়ে ছড়ানো মিথ

যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে বলে আসছে—সেদিন জাপানে পারমাণবিক হামলা না হলে লাখো মার্কিন সেনা মারা যেত। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান দাবি করেছিলেন, এই হামলা করবার ফলে ৫ লাখ আমেরিকানের প্রাণ বেঁচেছে।

কিন্তু সামরিক বিশ্লেষকেরা দেখেছেন—হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিহত অধিকাংশই ছিল সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে অনেক কোরিয়ানও ছিলেন।

এই মিথটি চালু করে তারা কী বোঝাতে চায় যে জাপানি ও কোরিয়ান সাধারণ মানুষের প্রাণের কোন মূল্য নেই? এটাই আসলে বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আজও এই যুক্তি দিয়ে ইসরায়েলের সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।

পিয়ার্স মরগানের সাম্প্রতিক টক শো পিয়েরস মরগান আনসেন্সরড-এ, ইসরায়েলপন্থী কট্টরপন্থী বিশ্লেষক রাব্বি শমুলি বোতিয়াখ টেনেছেন হিরোশিমা ও নাগাসাকির প্রসঙ্গ। প্রশ্ন তুলেছেন—‘জাপানে শত-সহস্র সাধারণ নাগরিক, এমনকি শিশুদের হত্যার অনুমোদন দিয়ে ট্রুম্যান কি যুদ্ধাপরাধী?’

মরগান নিজেই উত্তর দেন—‘না’। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ট্রুম্যানই একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর হামলার নির্দেশ দেন। উইনস্টন চার্চিলের সিদ্ধান্তে ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষে ৩৮ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। মর্গান বলছেন যে তাদের কাউকেই যুদ্ধাপরাধী বলা যায় না।

ইতিহাসকে অস্ত্র বানানো

হিরোশিমার প্রসঙ্গ এখন আর কেবল ইতিহাসচর্চার বিষয় নয়। সেই ঘটনা ইসরায়েলের সমর্থকেরা গাজা ধ্বংসের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করছেন।

পিয়ার্স মরগানের আরেকটি সাম্প্রতিক পর্বে, কট্টর ডানপন্থী ক্লে ট্র্যাভিস, পার্ল হারবারে জাপানের হামলার সঙ্গে জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলার তুলনা টানেন। তিনি হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার সঙ্গে পার্ল হারবারের ঘটনাকে একসারিতে বসান। তারপর বলেন, পার্ল হারবারের পর যেমন জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলা ঠিক ছিল, তেমনই ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েলের গাজায় সাধারণ মানুষ হত্যা, বোমা বর্ষণ আর দুর্ভিক্ষ ঘটানো অন্যায় কিছু নয়।

এই ধরনের তুলনা ঐতিহাসিকভাবে একেবারেই অযৌক্তিক। এ থেকে শুধু এটুকু বোঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা ফেলার প্রচলিত মার্কিন মিথ আজও নতুন এক গণহত্যাকে সমর্থন করার হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

অনেকে চাচ্ছেন গাজার ধ্বংস কতটা ভয়াবহ তা বোঝাতে হিরোশিমার সঙ্গে তুলনা করতে। কিন্তু এরকম চেষ্টার মধ্যে একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হওয়ার শঙ্কা থাকে। পারমাণবিক বোমার ধ্বংস ও প্রচলিত বোমার প্রভাব এক নয়। ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র আছে। কিন্তু গাজার ঘন বসতি, ইসরায়েলের নিজের শহরগুলো এত কাছে যে সে নিজেও পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করতে হিসাব করার কথা।

স্মরণ যেন হয় প্রতিরোধ

২০১৯ সালে ইরানের বিরুদ্ধে হামলার সময় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা উঠেছিল। যদিও তখন বাঙ্কার-বাস্টার বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল। পারমাণবিক অস্ত্র এখন কেবল ইতিহাস নয়, সমসাময়িক হুমকি। আরও ভয়ের কথা এই যে ইসরায়েল স্বীকার করে না যে তার পারমাণবিক বোমা আছে। যে রাষ্ট্র নিজের অস্ত্রের অস্তিত্বই স্বীকার করে না, তার পক্ষে অন্য দেশকে ধ্বংস করার কথা বলা খুবই বিপজ্জনক।

৮০ বছর আগে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল। আমরা সেই ইতিহাস থেকে কিছু শিখিনি। আজ আবার পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের কথা বলছে আমেরিকা আর ইসরায়েল। তাই হিরোসিমা-নাগাসাকির কথা শুধু স্মরণ করলে হবে না। একে প্রতিরোধ করতে হবে। স্মরণ তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে।

লেখক: আদাম মিয়াশিরো, আমেরিকার স্টকটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই-এর ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত